X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা মরি বা বাঁচি, আইন তুমি নিরাপদে থাকো

শেগুফতা শারমিন
২২ মে ২০১৭, ১৭:৫৮আপডেট : ২২ মে ২০১৭, ১৮:০০

শেগুফতা শারমিন শনিবার মানে ছুটির দিন। রাত নয়টায় ইলফোর্ড থেকে বাসে উঠেছি। সম্ভবত ২৫ নম্বর বাস। নামবো হলবোর্নে। সেখান থেকে বাস পাল্টে রাসেল স্কয়ার। সব মিলিয়ে ঘণ্টা খানেকের ব্যাপার। মেট্রোতে যেতে পারতাম, তুলনামূলক দ্রুত এবং নির্ঝঞ্ছাট বিবেচনায়। কিন্তু সারাদিন তিনটার বেশি রাইড নেওয়ায় সেদিনের সব বাস ফ্রি এবং রাতের লন্ডন দেখতে দেখতে যাওয়ার লোভে, বাসই বেছে নিলাম। তার ওপর হাতে সময়ও আছে। দোতলা বাসের একদম সামনের সিটে বসে বিলাতি শহর দেখি। আর আকাশ পাতাল ভাবি। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাই নাই। টের যখন পেলাম, তার বেশ আগেই হলবোর্ন ছেড়ে বাস ততক্ষণে অক্সফোর্ড স্ট্রিটের কাছে! দিনের আলোয় দুদিন দু’বার অফিসের কলিগদের সাথে অক্সফোর্ড স্ট্রিট থেকে রাসেল স্কয়ার হেঁটে গেছি। কিন্তু রাতের বেলা, একা একা? তদুপরি, লন্ডনে তখন আমার বয়স মাত্র এক সপ্তাহ! কী করি? নিচে নেমে বাস ড্রাইভারকে বললাম ঘটনা। বুদ্ধি দিলো, পরের স্টপেজে নেমে ওমুক নম্বর বাস ধরে চলে যাও। নামলাম। বাস রুটের আগামাথা কিছুই বুঝি না। এই বাস সেই বাস এই রাস্তা ওই রাস্তা করে শেষ পর্যন্ত বাস বাদ দিয়ে মেট্রোতে চড়ে রাসেল স্কয়ারে ফিরলাম। হোটেল রুমে যখন পৌঁছলাম, তখন রাত বাজে বারোটা।
পুরোটা সময় ক্লান্ত লাগছিল, ঘুম পাচ্ছিল সেজন্য ঘরে ফেরার তাড়া ছিল। অথচ সত্যি বলি আমার ভয় করেনি। এতটুকু। বিদেশ অচেনা অজানা, একা একা। এজন্য একধরনের অভিমান হচ্ছিল মনে। কিন্তু ভয় বলতে যা বোঝায়, সেটা আমি একটুও অনুভব করিনি।
আরেকবার, তারও আগের ঘটনা। পারো মানে ভূটানের এক মনাস্ট্রিতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের ওপর। সমতল থেকে প্রায় ৪০ মিনিটের ড্রাইভ। পুরা রাস্তায় কোনও মানুষ নাই। মনাস্ট্রিতে যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় শতাধিক নানা বয়সী বৌদ্ধভিক্ষু। আসলো, কথা বললো। মনাস্ট্রি ঘুরিয়ে দেখালো। পুরো এলাকায় আমি তখন একমাত্র মেয়ে। একেবারে একলা গেছি, সঙ্গে স্বজন, বন্ধু কেউ নাই। ঘণ্টা খানেক ঘুরে ফিরে নেমে আসলাম। তখনও কিছু মাথায় আসেনি। ফিরে আসার প্রায় মাস ছয়েক পর একদিন মনে হলো, আরেহ! বিষয়টা তো ভয়ঙ্কর হতে পারতো।
এইতো মাস কয়েক আগে। কাজের জন্য গেছি নেদারল্যান্ডের উতরেখক্টে। উইক এন্ডের শনিবারে আরেকটা কাজ এবং পারিবারিক বন্ধু পরিবারের সাথে দেখা করতে উতরেখক্ট থেকে জার্মানির বন। এক্সপ্রেস ট্রেনে তিন ঘণ্টা। লোকালে ঘণ্টা চারেক। রবিবার দুপুরে কাজ সেরে গেছি বন্ধুর বাসায়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত, সপ্তাহখানেক ভাতের অভাবে কাতর আমি গল্পগুজব করে ভর পেট ভাত খেয়ে ভাতঘুমে। ঘুম যখন ভাঙলো তখন রাত নয়টা। আমার ফেরার ট্রেন ছিল বিকাল ৫টায়। সেই রাতে আর ট্রেন নাই। পরদিন সকাল নয়টায় আমার মিটিং উৎরেখক্টে। ভোর চারটায় বন স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। ছয় সিটের ছোট কামরায় মুখোমুখি সিটে দুই বয়সের দুই ভদ্রলোক। আমার ছোট্ট কিন্তু ভারী ব্যাগটা ওপরের বাঙ্কারে রাখতে সাহায্য করলেন। তখনও বাইরে অন্ধকার। ঘুমে চোখ ভেঙে আসে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি নিশ্চিন্তে। কোনও ভয় নেই। কোনও দ্বিধা নেই।

এই যে ঘটনাগুলো। অলস সময়ে নিজেই মনে মনে ফিরে দেখি। একবার ভাবি রাত ১১টায় গুলিস্তান মোড়ে যদি বাস ভুল করে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কি ঘটতে পারতো। অথবা ছোট একটা ট্রেনের কামরায় একটা একলা মেয়ে ভোররাতে? আর মনাস্ট্রির বদলে যে জায়গাটার নাম আসতে পারে তা তো আবার মুখে নেওয়া মানা। তো এই তিন ঘটনাতেই একটা মেয়ের কী কী অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হতো। নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি। শুধু একটা মেয়ে কেন? একটা ছেলে হলেও আমরা অনেক সময় সাহস পাবো না। কারণ, ছিনতাইয়ের ভয় আছে, অজ্ঞান পার্টির হাঙ্গামা আছে। আছে আরো নানা আতঙ্ক।

এরকম কেন হয়? কেন অক্সফোর্ড স্ট্রিট আর গুলিস্তানের ভেতর এই তফাৎ? কেন ডাচ রেলওয়ে আর বাংলাদেশ রেলওয়ের ভেতর এই পার্থক্য? এটা কি শুধু মানুষ খারাপ বলে? তাইলে কি বলতে হবে, ডাচ ট্রেনের প্যাসেঞ্জাররা সবাই খুব ভালো। আর বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীরা সবাই খুব খারাপ। সেই রাতে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে যত মানুষ ছিল সবাই ধোয়া তুলসি পাতা? আর গুলিস্তানে যারা দাঁড়িয়ে থাকে সবাই চোর, ছিনতাইকারী আর ধর্ষক?

যেই তাড়নায় গুলিস্তানের মানুষ তাড়িত হয়, সে একই তাড়নায় তাড়িত হয় অক্সফোর্ড স্ট্রিটে মধ্য রাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষও। কিন্তু ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে রকমফের আছে। কারণ গুলিস্তানে একটা ঘটনা ঘটে গেলে  কোনও বিচার হবে না। অথচ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে একটা ঘটনা সে- ব্যাগ ছিনতাই হোক, ইভ টিজিং হোক বা ধর্ষণ। অপরাধী পার পাবে না। বিচার হবে এবং শাস্তি তাকে পেতেই হবে। এই শাস্তির ভয়ে মানুষ ভালো হয়ে থাকে। আইন মানুষকে সোজা রাস্তায় থাকতে বাধ্য করে। আমাদের দেশে বাসে বা ট্রেনে খুব সহজেই একটা মেয়েকে হয়রানি করা যায়। খুব সহজেই ছিনতাই করা যায়। অজ্ঞান করে  ফেলে রাখা যায়। এমনকি ট্রেন থেকে মেরে ফেলে দেওয়া যায়। কোনও বিচার হয় না। বিচার হয় না বলেই ঘটনাগুলো বন্ধ হয় না। ঘটতেই থাকে ঘটতেই থাকে। হত্যা, ছিনতাই  এদেশে ডাল ভাত হয়ে গেছে। কেউ আর এ নিয়ে কথা বলে না।

ইদানিং মানুষ ধর্ষণ নিয়ে কথা বলে। ধর্ষণের প্রতিবাদ করে। কিন্তু বিচার হয় না। সুতরাং ধর্ষণ কমে না বরং বাড়ে। সারাদেশের পরিবেশ ধর্ষণের অনুকূলে । ভুলে গেলে চলবে না, এদেশে লতিফুর রহমানের মতো ক্ষমতাবান মানুষের মেয়ের ধর্ষণের বিচার হতে ১৮ বছর লাগে। সে দেশে সামান্য হযরত আলীরা কিভাবে মেয়ের ধর্ষণের বিচার পাবে?

কারও কোনও কথা বলতে হবে না। গড়পড়তা কোনও পুরুষকেও আর ধর্ষণের দায় নিতে হবে না, যদি কিনা ধর্ষণের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়। একসময় এদেশে এসিড সন্ত্রাস ছিল ভয়াবহ। আমাদের শৈশব কৈশোরের একটা আতঙ্ক ছিল এসিড। সেই এসিড সন্ত্রাস এখন অনেকটাই কমে এসেছে। কেন এই পরিবর্তন? কারণ আইন কঠোর হয়েছিল এবং  বেশ কিছু ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগও হয়েছিল। প্রায় ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মানুষ দেখেছিল এসিড ছুঁড়লে কি শাস্তি পেতে হয়। এদেশে ধর্ষণও কমে আসবে যদি আইন একটু কঠোর হয়।

আইন এবং শিক্ষা দুটোই দরকার মানুষকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে। গত কয়েকদিন যাবৎ ‘না মানে না’ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এই আলোচনা হচ্ছে কোথায়? কয়েকজন মানুষের মধ্যে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু এই আলোচনাটাতো হওয়া দরকার স্কুলে। প্রাইমারি স্কুলে। জি ভুল পড়েন নাই। জীবন চলার জন্য এটা খুব সাধারণ তথ্য। এই তথ্যটুকু বাইরের দেশের ছেলে-মেয়েরা স্কুলের গণ্ডিতেই পেয়ে থাকে। সেজন্য ওরা উন্মুক্ত সম্পর্ক তৈরি করতেও পারে এবং কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানে। ছেলেরা মেয়েদের আর মেয়েরা ছেলেদের সম্মান করার এই শিক্ষাটা ছোট্ট বয়সেই স্কুল আর পরিবার থেকেই পেয়ে আসে। অথচ আমাদের সাফাতরা দুইটা বিয়ে করে ফেলার পরও জানে না যে, না মানে না! জানে না, নারী মানে শুধু সম্ভোগ নয়, সম্মানেরও। জানে না, বন্ধুর দাওয়াতে আসা, একসাথে ডিনার করা মানে বিছানায় যাওয়ার সম্মতি নয়। এটাই বাস্তবতা।

মৌসুমী চিৎকারে, পরস্পর গালাগালিতে তাই কাজ হবে না। তেল পড়তে হবে রাষ্ট্র নামের যন্ত্রের নাট বল্টুতে। একেকটা ধর্ষণের ঘটনাকে রঙ্গমঞ্চের নাটক বানিয়ে ফেললে চলবে না। এত পুঙ্খানুপুঙ্খু ঘটনার বিবরণ দরকার নাই। একটা মেয়ে যখন অভিযোগ করেছে যে, সে ধর্ষণের শিকার সেটাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। তা নাহলে বলতে হবে যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ।

আমাদের এখন গল্প শোনানো হচ্ছে, রাতের বেলায় হোটেলের দাওয়াত মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়! আমরা অনেকেই মানছি না। কিন্তু হয়তো একদিন আমাদের এই সিদ্ধান্তও মেনে নিতে হবে। ১৯ বছর আগে শাজনীনের বেডরুম নিরাপদ ছিল না। আমরা আতঙ্কিত হয়েছিলাম। আমাদের বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল, ‘বড়লোকের’ (!) ব্যাপার স্যাপার! আমরাও মেনে নিয়েছিলাম। পাঁচ বছর আগে মধ্যবিত্ত সাগর রুনির বেডরুমও নিরাপদ ছিল না। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, বেডরুমের নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিতে পারবে না। আমাদের বেডরুম নিরাপদ নয়। আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমরা দেখেছি, আমাদের রাজপথ নিরাপদ নয়, ডা. নাজিয়ার ক্লিনিক নিরাপদ নয়, খাদিজার ক্যাম্পাস নিরাপদ নয়, দিপন ভাইয়ের অফিস নিরাপদ নয়, তনুর যেখানে ছিল সে জায়গাটিও নিরাপদ নয়।

আমি নারী হই বা পুরুষ; আমার জন্য, তোমার জন্য, আমাদের জন্য আসলে কোনও কিছুই এদেশে নিরাপদ নয়। নিরাপদ শুধু আইনের ধারাগুলো মোটা মোটা বইয়ের পৃষ্ঠায়। যেখানে তারা কালো অক্ষরে ঘুমিয়ে আছে এক কালো ঘুম, অত্যন্ত নিরাপদে। তাদের ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত আমরা যাপন করতে বাধ্য হই এক অনিরাপদ আতঙ্কের জীবন।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
হত্যা মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের দুই কর্মকর্তার জামিন
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ