X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় উৎসব ‘গাছ কাটা’!

গোলাম মোর্তোজা
১৮ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৪৫আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৫৩

গোলাম মোর্তোজা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর প্রতি আমাদের ভেতরে একটা তীব্র মোহ কাজ করে। যে কোনও প্রতিবাদ-বিক্ষোভে প্রধান লক্ষ্য থাকে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো। গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ, ফুটপাত-রোড ডিভাইডারের রেলিং উপড়ে ফেলায় আমরা খুবই দক্ষ। তবে এসব কিছুকে ছাড়িয়ে যায় আমাদের গাছ কাটার দক্ষতা। গাছ কাটায় আমরা সব সময় অতি উৎসাহী। বলা যায় ‘উৎসব’ উদযাপনের মতো করে আমরা গাছ কাটি। যেন গাছ কাটা আমাদের কোনও জাতীয় উৎসব। কেন বলছি জাতীয় উৎসব, সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা।
১. একশ বছরের বেশি বয়স, এমন গাছ বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। কিছু আছে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীতে। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী বললে অনেকেই চিনবো না। চিনবো ‘উত্তরা গণভবন’ বললে। প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলের কার্যালয়। বঙ্গবন্ধুর সময় ১৯৭২ সালে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীকে ‘উত্তরা গণভবন’র হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ১৮৯৭-১৯০৮ সাল, ১১ বছর ধরে এই রাজবাড়ীটি নির্মাণ করা হয়। সেটা ছিল রাজা প্রমথনাথ রায়ের সময়কাল। ১৮৯৭ সালে এখানে যে রাজবাড়ী ছিল, সেটা ১৮ মিনিট স্থায়ী একটি ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর নির্মাণ করা হয় এই ভবনটি। ৪১ একর জায়গার এই রাজবাড়ীতে বড় ছোট বহু বছরের নানা রকমের গাছ আছে। যার অনেকগুলোর বয়স শত বছরের বেশি। সেই গাছের অনেকগুলো ইতিমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। যারা দেখাশোনা করার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই গণপূর্ত বিভাগই গাছগুলো কেটেছে। এখন নাটোর জেলা প্রশাসন তৎপর হয়েছে। চিঠি চালাচালি, তদন্ত কমিটি... অনেক কিছু হচ্ছে। দু’একজনের ছোটখাট শাস্তিও হয়ত হবে।

একশ বছরের বেশি বয়সী গাছগুলো কি ফিরিয়ে আনা যাবে? গাছ কাটার মতো এতো বড় অন্যায় সংগঠিত হলো, কর্তারা কেউ কিছু জানলেন না? জানলেন পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশের পর?

২. যশোর রোড, মুক্তিযুদ্ধের সড়ক। ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯৭১ সাল, লাখ লাখ মানুষ ভারতে ঢুকেছিল এই ‘যশোর রোড’ ধরে। দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোকে ছায়া দিয়েছিল শতবর্ষের পুরনো গাছগুলো। যেগুলো ‘যশোর রোডে’র দু’পাশে বিস্তির্ণ এলাকা ছায়াশীতল করে দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝখানে  ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ওপারে ভারত। একই রকম সড়ক একই রকম গাছ। ওপারের গাছগুলো এখনও আছে। এপাড়ের গাছগুলোও ছিল। গাছকাটা যেহেতু ভারতীয়দের ‘উৎসব’ নয়, তারা গাছগুলো মাঝখানে রেখে দু’পাশ দিয়ে রাস্তা চওড়া করেছে। কয়েক বছর আগে কয়েশ’শ গাছ আমরা কেটে ফেলেছি। ঐতিহ্য ইতিহাস, শত বছর- এগুলো আমাদের কাছে বিবেচনার বিষয় নয়।

আমাদের কাছে প্রধান বিষয় ‘উন্নয়ন’। গাছ কেটে রাস্তা চওড়া করে আমরা ‘উন্নয়ন’ করেছি।

৩. শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া বাংলাদেশের অত্যন্ত সমৃদ্ধ জাতীয় উদ্যান। না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর যে, বাংলাদেশে এমন বন আছে। চুরি করে এই বনের গাছকাটা নিয়মিত বিষয়। বহু রকমের পশু-পাখি, বন্যপ্রাণীর আবাস লাউয়া ছড়ার উদ্যান। বহু বছরের বহু রকমের গাছ আছে এই উদ্যানে। উদ্যানের মাঝখান দিয়ে সমান্তরালভাবে চলে গেছে রেল লাইন। ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে কখনও কখনও দু’একটি গাছ ভেঙে রেল লাইনের ওপর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তা সরিয়েও ফেলা হয়। বছর তিনেক আগে হঠাৎ করে বড় কর্তাদের মনে হলো, এভাবে ট্রেন চলাচল নিরাপদ নয়! গাছ ভেঙে পড়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে!! সুতরাং রেল লাইনের দুই পাশের বড় বড় গাছ কেটে ফেলতে হবে। হিসেব করে দেখা গেলো কেটে ফেলতে হবে এমন বড় গাছের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। নিরাপত্তার নামে মূলত লুটপাটের আয়োজন করা হচ্ছিল। পরিবেশবিদরা হৈচৈই শুরু করলেন। ২৫ হাজার গাছ কাটার অবস্থান থেকে সরে আসা হলো। ভেতরে ভেতরে ঘোষণা না দিয়ে গাছকাটা চলতে থাকল।

৪. ১৯৯৭ সালের আগে পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন যুদ্ধাবস্থা ছিল, তখন গহীন জঙ্গলও ছিল। কাচালং রিজার্ভ, মায়ানি রিজার্ভ... এমন নামের বহু সংরক্ষিত বন ছিল। দেড় দু’শ বছরের পুরনো গাছের জঙ্গল ছিল। দিনের বেলা সেসব বন ছিল রাতের মতো অন্ধকার। এসব জঙ্গলই ছিল শান্তিবাহিনীর ঘাঁটি। চুক্তির পর শান্তিবাহিনী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। দু’থেকে তিন বছরের মধ্যে জঙ্গলগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলা হলো। এখন আর বড় কোনও গাছ নেই বললেই চলে।

পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো প্রায় ন্যাড়া করে ফেলা হয়েছে।

৫. প্রতি বছর ঢাকা শহরের ভালো রোড ডিভাইডার ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়। পুরনো গাছগুরো ধ্বংস করে নতুন গাছ লাগানো হয়। এ যেন নিয়মিত ভাত খাওয়ার মতো বিষয়। গত দু’বছর ধরে যা অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি মাত্রায় চলছে। ঢাকার কিছু অঞ্চলে রোড ডিভাইডারের মাঝে পুরনো কিছু গাছ ছিল। গুলশান অঞ্চলে যা লক্ষ্য করা যেত। বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ রেখেও যে ফুটপাত বানানো যায়, বনানী গুলশানের দু’একটি রাস্তায় তা করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকা শহরের আর কোনও রাস্তার ফুটপাতে গাছ রাখা হয়নি। নির্দয়ভাবে গাছগুলোকে হত্যা করা হয়েছে।

৬. ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আসলেন। হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম চন্দ্রিমা উদ্যান আর সংসদ ভবনের মাঝের কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ডালকাটা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিবেচনায়। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্যে যা করা দরকার, তা নিশ্চয় করতে হবে। গাছের ডাল না কেটেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় কিনা, তা সম্ভবত আমাদের বিবেচনাতেই থাকে না।

নিরাপত্তা বিবেচনাতেও পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক পহাড়ের জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। বাংলাদেশের চেয়েও ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মেঘলায়, মনিপুর, মিজোরামে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ভারত কিন্তু তাদের পাহাড়ের জঙ্গল কেটে এভাবে পরিষ্কার করেনি। মাঝে মাঝে ভাবি, তারা গাছ না কেটে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কী করে!

৭. ব্রিটিশদের গড়ে তোলা চা বাগানের অনেকগুলোর মালিক হয়েছে নব্য ধনী বাঙালিরা এই ধনী বাঙালিদের অনেকে চা বাগান কিনে প্রথমে শেড ট্রিগুলো ধ্বংস করেছে। কেউ কেউ কয়েক কোটি টাকায় শেড ট্রি বিক্রি করেছে। শেড ট্রি ছাড়া চা বাগান সমৃদ্ধ হয় না। কিন্তু ‘উৎসব’ করে বাঙালি মালিকরা অনেক ছায়া দেওয়া বড় বড় গাছগুলো বিক্রি করে দিয়েছে।

৮. ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার বিরোধী আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলনেও শত শত নতুন পুরনো গাছ ধ্বংস করা হয়েছিল। ঢাকা শহরকে বৃক্ষশূন্য করার প্রথম উদ্যোগটি নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। পরবর্তী কোনও সরকার সেই ধারা থেকে বের হয়ে আসেননি।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ওসমানি উদ্যানের গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে আন্দোলন করে তা ঠেকানো হয়েছিল। এখন সুন্দরবনও রক্ষা পাচ্ছে না। চুরির পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে ধ্বংসের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ