X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-সৌদি আরব সম্পর্ক

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:০৫আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:০৫

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৫ ভাগ মুসলমান। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের প্রায় শতভাগ মানুষই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ভ্রাতৃপ্রতিম এই দুই দেশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব থাকলেও উভয় রাষ্ট্রের অধিবাসীরা মুসলমান হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের নানা সংকটকালে সৌদি আরবের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দুর্যোগকালে তারা শর্তহীন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। ১৯৭৪ সালে জেদ্দা সফরকালে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের সহায়তার জন্য সৌদি সরকারকে অনুরোধ করলে তারা ১ কোটি ডলার সাহায্য ঘোষণা করে ভ্রাতৃপ্রতিম এ দেশের জনগণের জন্য তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে।

বাংলাদেশ-সৌদি আরব তথা বাংলা ও আরব অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিচার করলে অপূর্ণ ইতিহাসই কেবল নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি ওই সম্পর্ক যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহমান সে বিষয়টিও অস্বীকার করা হবে। প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের সঙ্গে আরব অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ভৌগোলিকভাবে উভয় অঞ্চলের মধ্যে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব হলেও ইসলাম পূর্ব যুগেও উভয় অঞ্চলের মধ্যে স্থল ও জলপথে যোগাযোগ ছিল। তখন বাংলাদেশ ও সৌদি আরব নামে স্বতন্ত্র কোনও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব না থাকলেও উভয় অঞ্চলের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইসলাম পূর্ব যুগে আরব বণিকদের ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, আরব বণিকরা পশ্চিম এশিয়া, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসায়িক পণ্য বিনিময় করতেন।

ওই সময়ে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে আরব বণিকরা বাণিজ্যিক রুট হিসেবে বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করতেন। তারা চট্টগ্রাম বন্দরে যাত্রাবিরতি করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাড়ি জমাতেন। ওই সময়ের প্রামাণ্য কোনও ইতিহাস গ্রন্থে এ বিষয়ের উল্লেখ না থাকলেও পরবর্তীকালে অর্থাৎ অষ্টম হতে দশম শতকের আরব মুসলিম ভূগোলবিদদের গ্রন্থে ভারত মহাসাগর তথা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এবং বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলের সমুদ্রবন্দর, বাণিজ্য এলাকা ও পণ্যসামগ্রী সম্পর্কে অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকায়ই প্রমাণ করে যে তারা বাংলা সম্পর্কে জানতেন। বাংলায় আগমন করে তথ্য সংগ্রহ অথবা বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আগমনকারী আরব বণিকদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপরই নির্ভর করে ওই ইতিহাস রচিত হয়েছে। সেই বিবেচনায় প্রাচীনকালেও এ রুট সম্পর্কে আরবদের ধারণা ছিল বা যাতায়াত ছিল। ওই যাতায়াতের মূল কারণ অবশ্যই ছিল ধর্ম প্রচার নয়, ব্যবসা বাণিজ্য। তবে পারস্পরিক মেলামেশার কারণে উভয় অঞ্চলের মানুষ একে অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। যা তাদের একে অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে।

মধ্যযুগে মুসলিম বাংলার সঙ্গে ওই সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। আরব অঞ্চল থেকে বহু সুফি-সাধক আগমন করেন বাংলায়। যারা ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারে নিজেদের উৎসর্গ করেন। প্রাচীনকালে বাংলার সঙ্গে আরব অঞ্চলের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম বাংলায় তা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। এ অঞ্চলের মানুষেরা ধর্মীয় তীর্থস্থান মক্কা ও মদিনায় হজ উপলক্ষে গমন করায় বাণিজ্যের পাশাপাশি আর একটি নতুন সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এছাড়া তৎকালীন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বাংলার শাসকরা আরব অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় বাংলা ও আরবের মধ্যে বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুলতানি বাংলার শাসকদের মধ্যে সুলতান গিয়াস-উদ-দীন আযম শাহের সময়ে তাঁর প্রেরিত অর্থে মুসলিমদের পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদিনায় বহু স্থাপনা গড়ে ওঠে। বাংলার অর্থেই সেখানে নির্মিত হয়েছে অনেক মাদ্রাসা, সরাইখানা। খনন করা হয় আরাফাতের খাল। পুণ্যভূমি আরবের দরিদ্র মানুষদের জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি নিয়মিত অর্থ সাহায্যও প্রেরণ করতেন। আধুনিক সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ বিবেচনা করে অনেকে হয়তো ওই ইতিহাস বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু ঐতিহাসিক প্রমাণ এ কথার পক্ষেই রায় দেয়।

ঔপনিবেশিক শাসনামলেও বাংলার সাথে আরব অঞ্চলের ধর্মীয় কারণে সুসম্পর্ক ছিল। ওই সময়েও বাংলা থেকে মুসলমানরা হজে গমন করতেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ওই সময় আরবের প্রভাব না থাকলেও হাজী শরীয়তুল্লাহর মতো অনেক সমাজ সংস্কারকই আরব অঞ্চলের ধর্মগুরুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলায় সমাজ সংস্কারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। আর ওই সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করলে তা এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলে সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের পাকিস্তানের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। সৌদি আরবই প্রথম রাষ্ট্র যে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি প্রদান এবং কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করে। তাই পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার সাথেও সৌদি আরবের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সৌদি সরকারের সমর্থন পাকিস্তানের প্রতি থাকলেও সময়ের সাথে সাথে ওই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয় এবং এ দেশের মানুষের নানা সংকটে বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়ে সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে হজকে কেন্দ্র করে প্রথম বাংলাদেশ সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই যোগাযোগে বাংলাদেশের আহ্বানে সৌদি আরব সাড়া দেওয়ায় নতুন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রও তৈরি হয়। পাশাপাশি মুজিব সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৌদি আরব বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের জন্য ১ কোটি ডলার সাহায্য ঘোষণা করলে ওই সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলেও এই সম্পর্ক চলমান ছিল এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে অর্থ সাহায্য প্রদান করে। বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন, শিল্প, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানের প্রসার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সৌদি আরব বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সাহায্য ও ঋণ মঞ্জুর করে। এছাড়া কৃষি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাসস্থান নির্মাণ, শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে।

বাংলাদেশে তেল আমদানিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হতো। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে সাহায্য ও সহজ শর্তে তেল পাওয়ার আবেদন করা হয়। ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে সৌদি আরব ১৯৭৬ সালের ৫ অক্টোবর ১০ লক্ষ অপরিশোধিত তেল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। অর্থনৈতিক সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যের সৌদি আরবের বাজারে কম চাহিদা থাকায় ওই বাণিজ্য গতি পায়নি। কিন্তু বাংলাদেশ সৌদি আরব সম্পর্ক আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণকে কেন্দ্র করে। ১৯৭৬ সালে ২১৭ জন শ্রমিক প্রেরণের মাধ্যমে ওই সম্পর্কের সূচনা হয়। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবই সবচেয়ে বেশি শ্রমিক আমদানি করে।

সামরিক শাসন পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনামলে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। এ দেশের মুসলমানদের হজে গমন ও শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা, সৌদি আরব কর্তৃক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য প্রদান করার ধারাও অব্যাহত ছিল। সৌদি আরবে বর্তমানে বিশ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত থাকলেও নানা কারণে ২০০৮ সালের দিকে তারা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

তবে বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞায় সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ-সৌদি আরবের মধ্যে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যা এদেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে বলে আমরা আশা করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ