X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ

আবদুল মান্নান
০৭ মার্চ ২০২১, ১৮:৫৮আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২১, ১৩:৫৯

আবদুল মান্নান
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু এক ভয়াবহ গণহত্যার মধ্য দিয়ে। সেই বাংলাদেশ আগামী ২৬ মার্চ পূরণ করতে যাচ্ছে তার স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে থাকার পঞ্চাশ বছর—  সুবর্ণজয়ন্তী। ফেলে আসা পঞ্চাশ বছর যেন এক রূপকথা, চিতাভস্ম হতে  উঠে আসা রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো। জন্মের সময় দেশটি যে ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল তা বর্তমান প্রজন্ম চিন্তাই করতে পারবে না। বিদেশ থেকে খয়রাতের চাল না এলে বেশিরভাগ বাড়ির উনুনে হাঁড়ি চড়তো না। দেশের আশিভাগ মানুষ দিনে আনে দিনে খায়। জুতা স্যান্ডেল ছিল না সিংহভাগ ভাগ মানুষেরই। ছিল না গায়ে কোনও কাপড়। মহিলাদের একটা বা দুটোর বেশি পরার কাপড় ছিল না। তাও অনেক ক্ষেত্রে রিলিফে পাওয়া। অধিকাংশ মানুষের মাথার ওপর কোনও চালা ছিল না। বিশ্বের তাবৎ প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন দেশটির কোনও ভবিষ্যৎ দেখতে পায়নি। পেয়েছিলেন একজন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বলতেন ‘আমার দেশের মানুষ আছে আর আছে মাটি। এদের দিয়েই আমি আবার উঠে দাঁড়াবো’। তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তিনি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে শুধু দাঁড়াতে শেখাননি, হাঁটতে শিখিয়েছেন। ঠিক সেই সময় ঘরের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকরা তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। তারপর দীর্ঘ একুশ বছরে পিছনে চলা। যেই চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল তা কলমের এক খোঁচায় বাতিল করে দিলেন দেশের প্রথম সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে বানানোর চেষ্টা করলেন মিনি পাকিস্তান। যেসব দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন, ঠিক বেছে বেছে তাদের এই দেশে রাজনীতি করতে দিয়েছিলেন। বানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। বিমান বাহিনীর প্রধান করার জন্য জার্মানি হতে উড়িয়ে এনেছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক এম জি তোওয়াবকে। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করেছিলেন ইসলামি জলসার নামে সিরাত সম্মেলন। সভাপতি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তোওয়াব বিশেষ অতিথি। সাঈদী দাবি করেছিলেন চাঁদ তারা মার্কা পতাকা আর জাতীয় সংগীত আর দেশের নামের আগে ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাখার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিতে হবে। জিয়ার উপ-সামরিক আইন প্রধান তোওয়াব অঙ্গীকার করেছিলেন এসব করা হবে। এটি জিয়ার বাংলাদেশে।

জিয়ার পর এলেন আরেক জেনারেল, এরশাদ । তিনি তার পূর্বসূরির ধারাবাহিকতা ধরে রাখলেন। এক গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে পতন হলো এরশাদের। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেন জেনারেল জিয়ার পত্নী বেগম জিয়া। ধারণা করা হয়েছিল তিনি নিজেকে শুধরে নিয়ে তাঁর প্রয়াত স্বামীর নীতি বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনীতির সূচনা করবেন। তিনি সেদিকে হাঁটলেন না। হাঁটলেন তাঁর প্রয়াত স্বামীর পথে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলো। তাঁর প্রথম দফার শাসনামলের একমাত্র অর্জন দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করলে মানুষ কিছুটা আশার পথ দেখতে পেয়েছিল। চেষ্টা করেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু যতটুকু তিনি আশা করেছিলেন ততটুকু তাঁকে যেতে দেওয়া হয়নি। মূল বাধা পঁচাত্তরের পরবর্তীকালে গঠিত আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্র। একটি সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে সবকিছু ঠিক করা সম্ভব নয়। তারপরও  তিনি সংসদের মাধ্যমে সংবিধানে জেনারেল জিয়া কর্তৃক সংযোজিত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার কার্য শুরু করেছিলেন।

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে প্রথম যে কাজটি করেন তা হচ্ছে কৃষি উপকরণের ওপর ভর্তুকি বৃদ্ধি করে কৃষিতে একটি বিপ্লব ঘটানো। তিনি জোর দেন দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে তিনি নজর দেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও তাঁর বিশেষ নজর ছিল। তারপরও সেই পুরনো প্রশাসন যন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা তো রয়েই গেছে। ২০০১-এর নির্বাচনে আবার এলেন বেগম জিয়া আর তার দল বিএনপি। সাথে গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে একাত্তরের ঘাতকরা। তাঁর এই যাত্রার শাসন ছিল ভয়াবহ। দেশে পরিচালিত হতে লাগলো সমান্তরাল দুটি প্রশাসনের অধীনে। একটির নেতৃত্বে তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান তারেক রহমান আর একটি তার অধীনে। তারেক রহমান দুর্নীতিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ হয়ে উঠলো ধর্মীয় উগ্রবাদীদের এক অভয়ারণ্য। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য বাংলাদেশ হয়ে উঠলো অবৈধ অস্ত্রের নিরাপদ রুট। সবকিছু তারেক রহমানের তত্ত্বাবধানে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড মেরে হত্যা করার চেষ্টা করা হলো সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে।

বাস্তবে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর। শুরুটা তেমন একটা সহজ ছিল না। বেগম জিয়ার ২০০১-০৬ ও ২০০৭-০৮ সালের দুটি সরকারই অনেক কিছুই ওলট পালট করে দিয়েছিল। ২০০৭-০৮-এর ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন আহমদ সরকার ছিল সাংবিধানিকভাবে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কাজ ছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তারা সেই কাজ বাদ দিয়ে শুরু করলেন যত ধরনের তাদের এখতিয়ার-বহির্ভূত কাজ আছে তা। শেষ পর্যন্ত অনেকটা বাধ্য হয়ে ২০০৮ সালে নির্বাচন দিয়ে তারা শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে গেলো। এরইমধ্যে তাদের আমলেও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের অনেক কিছুই ভেঙে পড়েছে। বেগম জিয়ার পূর্বের শাসনামলে তাদের ঝুড়িতে এত পাপ জমা হয়েছিল যে ২০০৮-এর নির্বাচনে তাদের পরাজয় ছিল অবধারিত। তারপরও এখন পর্যন্ত তাদের অনেক নেতা বলে থকেন দেশে এক এগারোর সরকার এসেছিল নাকি জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংস করতে। যে দল নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে সেই দলের ধ্বংস ঠেকানো কার সাধ্য? এখন তো তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দুর্নীতির দায়ে একজন দণ্ডিত পলাতক আসামি।

বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে তাঁর কন্যার হাত ধরে দেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। এরইমধ্যে দেশ মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের যে তিন জন সরকার প্রধান করোনা মোকাবিলায় সফলতা দেখিয়েছেন, কমনওয়েলথ মহাসচিব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার একজন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন কীভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মার ওপর বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সেতু বানানো সম্ভব নিজের টাকায়। প্রয়াত লেখক শওকত ওসমানের একটি কথা মনে পড়ে।  তিনি বলেছিলেন, বাপের শুধু বেটা হয় না বেটিও হয়। আর প্রথাবিরোধী প্রয়াত লেখক আহমদ ছফা বলেছিলেন বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হচ্ছে ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। পঞ্চাশ বছরের মাথায় এসে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলা বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত ধরে অনেকদূর এগিয়েছে। তারপরও অতিক্রম করতে হবে আরও অনেক পথ। বাবা সব সময় দুর্নীতির কথা বলতেন। পারেননি তাকে তেমন একটা দমন করতে। কন্যার সামনে এটি এখনও একটি বড় দৈত্য। তিনি যদি এটাকে দমন করতে পারেন তাহলে তিনিও পিতার মতো ইতিহাসের আর এক মহানায়ক। সরকার বর্তমানে অতিমাত্রায় আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র পরিচালনায় এটি একটি অশনি সংকেত। তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপর বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের অনেক কিছু নির্ভরশীল।

আজ ঐতিহাসিক সাতই মার্চ। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ যতদূর পথ অতিক্রম করেছে, পরের পঞ্চাশ বছরে যেন তারচেয়ে অনেক বেশি পথ অতিক্রম করে, এই প্রত্যাশা দেশের মানুষের । জয় হোক বাংলা আর বাঙালির। জয় বাংলা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ