X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
০৪ এপ্রিল ২০২১, ১৯:৩৬আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২১, ১৯:৩৬

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২০১৫ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিক্ষকের জন্য বিনিয়োগ, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ’। ওই প্রতিপাদ্য আলোচনার পর আরও পাঁচটি শিক্ষক দিবস পার হয়েছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ শিক্ষকদের জন্য কতটা বিনিয়োগ করতে পেরেছে? শিক্ষকদের জন্য বিনিয়োগ বলতে সাধারণভাবে শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী ও সুযোগ-সুবিধায় বিনিয়োগ করাকেই বোঝাবে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে আজও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো তৈরি ও বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাই শিক্ষায় বিনিয়োগ যদি ‘কাজীর গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই’ প্রবাদের মতো কাগজে-কলমে হয় অথবা শিক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্যের মধ্যে কেবল সীমাবদ্ধ থাকে; তবে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগও যে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সম্মানের দিক দিয়ে শিক্ষকরা সমাজের উঁচু স্তরের মানুষ— এমন মুলা ঝুলিয়ে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রণয়ন না করলে শিক্ষা ব্যবস্থার কখনই আমূল পরিবর্তন হবে না। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়— প্রতিটি পর্যায়ের শিক্ষকের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ অবস্থার অবসানই কেবল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি।

যুক্তরাজ্যে একজন শিক্ষকের চেয়ে বাংলাদেশের একজন শিক্ষক কম বেতনে কর্মে নিযুক্ত হন। তবে বাংলাদেশের জিডিপি বিবেচনায় যুক্তরাজ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী নয়। তাই ভারতের একজন শিক্ষক যে বেতন পান, এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তার কাছাকাছি বেতন দাবি করাটা কি অযৌক্তিক? কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের শিক্ষক সমাজের। ভারতের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর ধারে-কাছেও নেই বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পড়া ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের শিক্ষকদের জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। আর ওই বেতন কাঠামোয় পাকিস্তানের একজন শিক্ষক যে সম্মানী পান বাংলাদেশের শিক্ষকরা তার থেকে অনেক কম বেতনে কাজ করেন। তারাও শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে।

বাংলাদেশের কাছাকাছি যেসব দেশের জিডিপি, তার মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান, ইথিওপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া এবং সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নন; প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনের আকাশ-পাতাল তফাৎ। মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষকদের অবস্থাও একই। আমাদের দেশের শিক্ষকদের কম বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে যতটা না অর্থনৈতিক সংকট দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী সংকীর্ণ মানসিকতা। বাংলাদেশের মানুষ সাদা পুরনো পাঞ্জাবি গায়ে, ভাঙা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতলওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনও হেঁটে মাইলের পর মাইল গিয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তিকেই শিক্ষক বলে জানে। ধরেই নিই, শিক্ষকরা হবেন অতিভদ্র, বিদ্যার ভারে তাদের মাথা নোয়াবে। সাদাসিধা জীবনযাপন করবেন তারা। আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানি, পাঠান, মোগল, ইংরেজ অথবা স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষক মানেই উপর্যুক্ত চিত্র মানসপটে ফুটে ওঠে। আমরা ভুলেই গেছি, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। এখন একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থী পড়াতে ইন্টারনেট ঘাঁটতে হয়। কিন্তু শিক্ষকদের যদি আর্য-মৌর্য যুগের সম্মানী দেই, তবে তাদের পক্ষে কি শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব?

শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত করে গড়তে চাইলে শিক্ষকদের সম্মানীর ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। বৈদিক যুগের গুরু-দক্ষিণা ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা শিক্ষকের জীবন নির্বাহ অথবা পাল যুগের বিহারগুলোয় থাকা খাওয়ার বিনিময়ে ছাত্র পড়ানোর ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষকই বৈদিক যুগের মতো গুরু-দক্ষিণা নিয়ে অথবা পাল যুগের মতো লজিং থেকে ছাত্র পড়ান। আর যারা সরকারি বেতন পান, তাদের অবস্থাও খুব ভালো, এমন নয়।

সম্মানজনক সম্মানী না পেলেও কোনও সময়ই শিক্ষকদের সম্মানের কমতি হয়নি। প্রায় সব যুগেই শিক্ষকতা মহান পেশা হিসেবে পেয়েছে স্বীকৃতি। এই ডিজিটাল যুগে এসে অবশ্য শুধু সম্মান দিয়ে শিক্ষকদের সংসার আর চলছে না। সারা মাস দোকান থেকে বাকি নেওয়ার পর অথবা মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার মতো যখন পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না; তখন একজন শিক্ষকের সম্মান অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত দোকানদার আর বাড়িওয়ালার কাছে বানের পানির মতো ভেসে যায়। তাদের অকথ্য গালিগালাজ আর কটু কথায় শিক্ষকের সম্মান জানালা দিয়ে পালায়।

২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য স্থায়ী পে-কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। এরইমধ্যে অনেক পানি গড়িয়েছে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি।

নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের ‘অস্ত্র নয়, শিক্ষায় বিনিয়োগ করার’ আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাও তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করছি।

পরিশেষে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় না আসা পর্যন্ত সরকার যত উদ্যোগই গ্রহণ করুক না কেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন অসম্ভব। একজন ভালো মানের কারিগরের পক্ষেই উচ্চমানের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই অধিক হারে শিক্ষকতা পেশায় আসবেন, যখন তাদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা হবে। তাই সরকারের উচিত প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করে সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
কামালের ২৯ বছরের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না সবুজ!
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ