X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব শান্তির দূত বঙ্গবন্ধু

ড. সাজ্জাদ হোসেন
২৬ মে ২০২১, ১১:৫৬আপডেট : ২৬ মে ২০২১, ১৬:০৭

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালের ২৩ মে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত হন বিশ্বশান্তির অগ্রদূত এবং নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘শান্তির দূত শেখ মুজিব, জুলিও কুরি শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম’ মুখরিত হয় সারাদেশ। ৪৮ বছর পার হলেও মিছিলের ভিড়ে সবার সঙ্গে উচ্চারিত সেই স্লোগান আজও বাঙালির স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর সাহসী নেতৃত্ব আর বিশ্বব্যাপী শোষিতের পক্ষে তার উচ্চকিত অবস্থানের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি পদক’ প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই নেতা যিনি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর সমৃদ্ধি ও উন্নতি নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে সংকট দেখা দিলে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করেন। এই লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় আয়োজিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত– শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’ আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু এই দর্শনে অবিচল থেকে মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন।

বিশ্ব শান্তি পরিষদের জুলিও কুরি শান্তি পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে বিশ্ব শান্তি পরিষদের অন্যতম শীর্ষ নেতা শ্রী রমেশ চন্দ্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদকে’ ভূষিত করেন।

নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের সাত মার্চ ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরিহার করে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে বিশ্বের সুনাম অর্জন করেন। এছাড়াও বিশ্ব মানবতায় নানামুখী অবদান রাখার কারণে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে। এটি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। এই সম্মান প্রাপ্তির পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনও ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তিপদক সমগ্র বাঙালি জাতির’। এ মহান অর্জনের ফলে জাতির পিতা সেদিন পরিণত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে। নিজের জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী অর্জন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। যদিও বঙ্গবন্ধুর যে বিশালত্ব তা কোনও পদকের মাপকাঠিতে নির্ণয় করা যায় না। তারপরও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ পদক প্রাপ্তির ৪৮ বছর পূর্তি আমাদের মানবিক বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা জোগায়।

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বঙ্গবন্ধু একাধিকবার কারাবরণ করেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ সালে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু।

মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি ১৯৭১, বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি ১৯৭২, বাংলাদেশের মৈত্রী সম্পর্কে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংঘাতময় পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশ বিশ্বসভায় ন্যায়নীতি অনুসৃত দেশ হিসেবে প্রশংসিত হয়।

সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’ সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ঢাকায় অনুষ্ঠেয় এশীয় শান্তি সম্মেলন ঘিরে ১৯৭৩ সালে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। দৈনিক বাংলার খবরের (মে ২১, ১৯৭৩) বরাত দিয়ে বাংলা ট্রিবিউন জানায়, এই দিন বিভিন্ন স্পট ঘুরে পত্রিকাগুলো সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরে। বিশ্ব শান্তির তিন সম্মানিত ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতিতে শেষবার তুলির কাজ করছেন শিল্পীরা। এই তিন জন সংগ্রামী নেতা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হো চি মিন ও বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র। ‘শান্তির সপক্ষে সংগ্রাম’ এই স্লোগানে শহরজুড়ে প্ল্যাকার্ড শোভা পায়। শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয় এতে। এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পুরস্কার তুলে দেওয়ার কথা আগেই জানানো হয়।

বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে এবং শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য স্মরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক দিয়ে আসছে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, কবি ও রাজনীতিক পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহরু, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভসহ বহু বরেণ্য বিশ্বনেতা এই পদকে ভূষিত হন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা আর সাম্প্রদায়িক চেতনার কোনও স্থান ছিল না। একাত্তরের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পঁচাত্তরে একদল বিপথগামী ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রস্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির চর্চা। কিন্তু এই অপচর্চাকে রুখে দিয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই করোনাকালে, দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহকালে একজন ‘জুলিও কুরি শেখ মুজিব’-এর শূন্যতা পৃথিবীর মানুষ অনুভব করছে। বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু তাঁর শান্তির আদর্শ ও দর্শন রয়ে গেছে আমাদের সামনে। সাধারণ বাঙালির আস্থার ঠিকানা বঙ্গবন্ধু। শোষিতের মুক্তির দিশারী জুলিও কুরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সারা বিশ্বে।

লেখক: অধ্যাপক; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
আজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
হৃদয় বিদারক সেই ঘটনার ১১ বছরআজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ