X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন ‘কেন গেলো’ প্রশ্নে

জোবাইদা নাসরীন
১৯ জুন ২০২১, ১৫:০৪আপডেট : ১৯ জুন ২০২১, ১৫:২১

জোবাইদা নাসরীন শুধুমাত্র চিত্রনায়িকা পরীমণিই নয়, দেশে কোনও নারী যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের শিকার হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব সময় অস্থির হয়ে যায় সে নারীকে নিয়ে। অপরাধের শিকার নারী সেই জায়গায় কেন গিয়েছিল? কয়টায় গিয়েছিল? দিনে গিয়েছিল নাকি রাতে? তার সাথে কারা ছিল? তার পরনে কী ছিল? এতসব প্রশ্নের পাশাপাশি যোগ হয় মেয়েটি কত খারাপ সেটির ওপর রচনা লেখার প্রতিযোগিতা।

অন্যদিকে যিনি অপরাধটি ঘটিয়েছেন, তিনি কেন এত রাতে ওখানে ছিলেন? ওখানে তিনি কী করছিলেন? তিনি কী পরে ছিলেন? কিংবা তার অন্য কোনও পরিচয় কি আছে? সব জায়গাতেই ধোঁয়াশা। যেন তার নাম লিখতে যেমন মানা, মুখে আনাও পাপ। মজার বিষয় হলো তার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন পরীমণি নিজেই। কিছু পত্রিকায় প্রথম দিন তার নাম পরিচয় প্রকাশ করেনি।

পরীমণির ক্ষেত্রে নতুন এই পুরুষতান্ত্রিক ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ এর ক্ষেত্রে আরও কিছু ‘রসালো’ উপাদান যুক্ত হয়েছে। কারণ পরীমণি ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন একটি ক্লাবে, যেটি বোট ক্লাব বলে পরিচিত। যদিও বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই হয়তো পাড়ার কিশোরদের ‘ক্যারাম খেলা’র ক্লাবের বাইরে আর কোনও ক্লাবের কর্মপরিধি সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না বলেই আমার ধারণা। এমনকি এই ঘটনার আগে বোট ক্লাব বলে কোনও ক্লাব আছে বলে খোদ ঢাকা শহরের বেশিরভাগ মানুষই জানতেন না।

ক্লাব বলতে এখনও আমাদের দেশে একবারেই পুরুষের দখলকৃত একটি পরিসরকে বোঝায়। খোদ ঢাকা শহরেই লেডিস ক্লাব, ঢাকা ক্লাব (যেগুলো মূলত অভিজাত শ্রেণির) বাদে অন্য সব ক্লাবে নারীর উপস্থিতি খুব বেশি সামাজিকভাবে গৃহীত নয়। এমনকি অফিসার্স ক্লাব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবেও মেয়েদের উপস্থিতি একেবারই হাতে গোনা। তার কারণটাও একেবারেই সামাজিক।

আড্ডা দেবে পুরুষ, তাস খেলবে, জুয়া খেলবে কিংবা নাচ-গান-সবই পুরুষের মনোরঞ্জনের অংশ। নারীর তো দায়িত্ব ঘরের। যে মেয়েরা ক্লাবে যায় সে মেয়েরা যে ‘ভালো’ মেয়ে নয়, এটাই আমাদের মননে বাসা বেঁধে আছে।

তাই পরীমণির ঘটনায় সেই ক্লাবই যুক্ত হয়ে আরও  পোয়া বারো করেছে পুরুষতান্ত্রিক নারী বিদ্বেষী অবস্থান। যার কারণে যখন পরীমণিকে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে তখনই দেখা গেলো পরীমণি যে নিয়মিত বিভিন্ন ক্লাবে যেতেন সেটি প্রমাণের চেষ্টার মধ্য দিয়ে পরীমণি কীভাবে ‘ভালো’ নারীর তরিকা ভঙ্গ করেছেন এবং যা জন্য এই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে সেটি প্রমাণের চেষ্টা চলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে। এমনকি আলোচনার খোরাক হয়েছে কোন ক্লাবে কবে গিয়ে তিনি গ্লাস ভেঙেছেন এবং কী পোশাকে গিয়েছেন সেটিও। ধর্ষণের শিকার নারীর পেশাগত পরিচয়ও এখানে নারী বিদ্বেষী। তিনি নায়িকা কিংবা যেই হোক না কেন সমাজের চর্চিত ‘ভালো মেয়ে’র সীমানার বাইরে যদি তিনি জীবন-যাপন করেন এবং যৌন নিপীড়ন বা হেনস্তার শিকার হন তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন ‘খারাপ মেয়ে’। আর এই তকমাকে অবলম্বন করে আলোচনা চলতে থাকে তখন আরও খোলাসা হয়ে ওঠে সমাজে বিরাজমান, ধর্ষণ মনস্কতা এবং মিসোজিনি ( নারীর প্রতি বিদ্বেষ)। যার কারণে ধর্ষণের চেষ্টার মতো অপরাধের চেয়ে বড় বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে একজন নিজের মতো করে জীবন-যাপন এবং নারীর চলা ফেরার স্বাধীনতা।

স্পষ্ট করে বলতে চাই আপনি যখন অপরাধীকে প্রশ্ন না করে অপরাধের শিকার নারীকে নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তার মানে হলো– আপনি এই বিষয়টিই প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন যে, বাংলাদেশে এখন এই অবস্থা যে যেখানে- সেখানে যখন-তখন একজন নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। আর সেই ধর্ষক আপনিও হতে পারেন।

সুতরাং অপরাধের বিচার না চেয়ে এসব গালগল্পে অংশগ্রহণ করে আপনি নিজেও নিজেরই পরিচয় এবং চরিত্রই প্রকাশ করছেন।

আর ধর্ষণ বা যৌন হেনস্তার শিকার নারীর চরিত্র যখন-তখন পোস্ট মোর্টেম করা যায়, তখন পুরুষতান্ত্রিক মগজ সব সময় কাজ করে কখন এবং কী করে তাকে ‘খারাপ মেয়ে’ বানানো যায়। আর ‘খারাপ মেয়ে’ বানাতে পারলেই বেশিরভাগের সমর্থন আদায় সহজ হয়ে যায়। সে-তো আমরা ইয়াসমীনকে ধর্ষণ এবং হত্যা থেকেই দেখে আসছি। পুলিশ থেকে শুরু করে প্রায় সকলেরই এক চিন্তা, মেয়েটির ‘খারাপ বা চরিত্রহীন’ পরিচয়টাই যেন ধর্ষককে সামাজিকভাবে মুক্তি দেওয়ার একমাত্র রাস্তা। কিন্তু আইনের দিক থেকে একজন ‘খারাপ মেয়ে’কেও যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণ করা যায় না। তার বলা ‘না’ মানেই ‘না’। সেখানে আপনার বানানো সত্যের অবকাশ নেই। পরীমণির ঘটনায়ও আমরা দেখেছি পুলিশের কাছে সেই রাতে গেলেও তার মামলা অভিযোগ প্রথমে আমলে নেয়নি।

পরীমণিকে যদি সেই সময় অসুস্থ্য কিংবা অপকৃতিস্থ মনে হয় পুলিশের কাছে তাহলে তখনও তাদের প্রয়োজন ছিল তাকে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেওয়া কিংবা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যদিও পুলিশ বলেছে, তাকে একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তারা নিয়েছিল।

প্রথমত ধর্ষণের চেষ্টা এবং পরবর্তীতে সেটিকে বৈধ করার জন্য নারীকে ‘মন্দ’ বানানোর সংস্কৃতি একভাবে যেমন নারী বিদ্বেষকেই জোরদার করে, তেমনি নারী নিপীড়নও বৈধতা পায়। এর মধ্য দিয়ে আমরা আসলে বিশাল এক বড়সড় ধর্ষকামিতার আওয়াজ পাই।

আমাদের জন্য আরও বিস্ময় হয়ে আসে যখন আইন প্রণেতারাও সংসদে এই বিচারের পক্ষে- বিপক্ষে ভাগ হয়ে যান। কোনও কোনও আইন প্রণেতা নারীর স্বাধীনতার সীমা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

পাঠক, লক্ষ্য করুন, আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত যৌন হেনস্তার বিচার। অথচ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে মাদক আইনে। সংসদে আলোচনা হওয়ার কথা নারীর নিরাপত্তা বিষয়ে অথচ সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে মদের লাইসেন্স। মূল আলোচনা কোথাও নেই। কেন নেই?  কারণ আলোচনার মূল জায়গায় গেলেই ধর্ষকামিতার চাষ-বাস বন্ধ!

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ