X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাংবাদিক নির্যাতনে ডিসিকে শাস্তির ‘আইওয়াশ’

ডা. জাহেদ উর রহমান
২০ আগস্ট ২০২১, ১৭:৩৫আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২১, ১৭:৩৫

ডা. জাহেদ উর রহমান শেষ পর্যন্ত ‘সুলতানা সরোবর’ হয়ে উঠতে পারেনি কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের ঐতিহ্যবাহী ‘নিউটাউন পার্ক’ নামের পুকুরটি। কাবিখার টাকায় সংস্কার করে পুকুরটির নামকরণ নিজের নামে করতে চেয়েছিলেন কুড়িগ্রাম জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীন।

জেলার মাসিক উন্নয়ন সমন্বয় সভায় নামকরণের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেজুলেশন করিয়েছিলেন সুলতানা পারভীন। শুধু সেটাই নয়, তিনি এই পুকুরের সামনে রাতের বেলা দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজের ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস শেয়ার করেন। এই স্ট্যাটাসে পুকুরটির নাম ‘সুলতানা সরোবর’ সে তথ্যটিও উল্লেখ করেন তিনি।

সবকিছু একেবারে ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু ডিসির ‘বাড়া ভাতে ছাই’ দেন বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম। তার একটি রিপোর্টে এই নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অকল্পনীয় রকম অন্যায় ক্ষমতাভোগী ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর’ অহমে তীব্র আঘাত করে এটি।

এক ‘তুচ্ছ’ সাংবাদিককে শায়েস্তা করতে মোটেও দেরি করেননি তিনি।

মধ্যরাতে আরিফুল ইসলামের বাড়িতে ঢুকে তাকে ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত আরিফুলকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়। তার বাড়িতে আধা বোতল মদ এবং গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু এবারও ভাগ্য ডিসির পক্ষে থাকে না। এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ডিসি এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপর তিন কর্মকর্তার ওপর চাপ তৈরি হয়। সরকার বিভাগীয় তদন্ত শুরু করে।

সম্প্রতি এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত এবং সংশ্লিষ্টদের বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশের খবর মিডিয়ায় এসেছে। শাস্তির প্রস্তাবগুলো এরকম– তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীনকে লঘুদণ্ড হিসেবে দুই বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। তৎকালীন আরডিসি নাজিম উদ্দিনের ক্ষেত্রে পদাবনতির সুপারিশ করা হয়েছে। আর এনডিসি এসএম রাহাতুল ইসলাম তিন বছর বেতন বৃদ্ধির সুবিধা হারাবেন। সবচেয়ে কঠোর শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে সেই রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করা সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমার ক্ষেত্রে। তাঁকে চাকরিচ্যুত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সাংবাদিক আরিফুলের ওপরে যা হয়েছে সেটা শুধু দেশের সব সংবাদকর্মীর স্বার্থের বিষয় না,এটা পুরো জাতির স্বার্থের বিষয়। গণতন্ত্র বলতে আমরা ন্যূনতম যা বুঝি, তাতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই কারণেই সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের অলিখিত ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ বলে বিবেচনা করা হয়। সবকিছুর পরও যেহেতু আরিফুল বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক ছিলেন, তাই এই পোর্টালটির আরিফুলের ব্যাপারে কিছু বেশি আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক।

‘ডিসি সুলতানার শাস্তি কেবল ইনক্রিমেন্ট স্থগিত!’– বাংলা ট্রিবিউন শাস্তির সংবাদটি প্রকাশের ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবেই শিরোনাম করেছে এটি। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এখানে একটা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন আছে। মানে বাংলা ট্রিবিউন এই অতি লঘু শাস্তির খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই লঘু শাস্তি যেটাকে আদৌ শাস্তি বলা যায় না, সেটা কি খুব অস্বাভাবিক? খুব অপ্রত্যাশিত?

যারা এই ঘটনার তদন্ত করে শাস্তির সুপারিশ করেছেন তাদের এই সিদ্ধান্তে যে চরম স্ববিরোধিতা আছে, সেটা খেয়াল তারা করেনি। কিংবা খেয়াল করলেও সেটা তোয়াক্কা করার কোনও কারণ তারা খুঁজে পাননি।

প্রশ্ন হচ্ছে, তদন্তে ডিসিকে কি অপরাধী হিসেবে পাওয়া গেছে? নিশ্চয়ই পাওয়া গেছে, না হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ কেন? যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আরিফুলের ওপরে এই বর্বর কাণ্ড ঘটনা হয়েছে, সেটা এই ডিসিকে কেন্দ্র করেই। তাহলে এ ঘটনার মূল দায় তাকে দিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না?

যারা ডিসির হয়ে আরিফুলের ওপরে ব্যবস্থা নিয়েছেন তাদের মধ্যেও যে দু’জন সিনিয়র, তাদের তুলনামূলক অনেক কম শাস্তি দেওয়া হয়েছে। মূল ‘কোপ’টা পড়েছে এদের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়র, ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার ওপর। অথচ রিন্টুসহ সবাই ডিসির স্বার্থে কাজ করছিলেন।

শাস্তির খবরের পর দেশের একটা শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাকে আরিফুল বলেন, তাঁকে নির্যাতন করার ঘটনায় মূল দায়ী ব্যক্তি সুলতানা পারভীন ও নাজিম উদ্দিন। তাঁদের নামমাত্র শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। রিন্টু বিকাশ চাকমাকে বানানো হচ্ছে ‘বলির পাঁঠা’। তিনি বলেন, তাঁর জানামতে ঘটনার রাতে রিন্টু বিকাশ চাকমা দৃশ্যমান কোনও অপরাধ করেননি, শুধু বিচারিক নথিতে সই করেছিলেন। সব নির্দেশনা দিয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন এবং তাঁর কথায় স্পষ্ট ছিল যে ডিসির নির্দেশে এসব করছেন।

এ ঘটনায় আরেকটি ব্যাপার খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসে। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অধীনে কাজ করা কর্মকর্তারা কি সেই কর্মকর্তার ক্রীতদাসে পরিণত হন? প্রশ্নটা এই জন্য এসেছে যে ধরে নেওয়া যাক ডিসি সুলতানা তার অধীনস্থদের নির্দেশ দিলেন সাংবাদিক আরিফুলকে এনে হেনস্তা করে, পিটিয়ে, মোবাইল কোর্টে মাদক মামলা দেওয়ার জন্য। এ রকম নির্দেশ মানতে অধীনস্থরা কি বাধ্য ছিলেন? নিতান্ত ক্রীতদাসে পরিণত না হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অন্যায় আদেশ অনুসরণ কি কেউ করে?

এই দেশে সব মানুষ সমান আচরণ পায় না। আরিফুলের জায়গায় যদি অখ্যাত কোনও পোর্টালের মফস্বল সাংবাদিক হতেন তাহলে যতটুকু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটুকুও হতো না। কিন্তু সারা দেশে ঘটনাটি যেহেতু বেশ আলোড়ন তুলেই ফেলেছে, তাই এর মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নিলে তো অন্তত সংকট সামাল দেওয়া যেত- এমন একটা ভাবনা তো প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসতে পারতো। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, একজন ডিসির অপরাধের দায়ে নেওয়ার তো কোনও দরকার ছিল না পুরো জনপ্রশাসনের। কিন্তু তারা যা করলেন, সেটা পরিস্থিতিটাকে নতুন করে আবার সমালোচনার মুখোমুখি করেছে। কেন করলেন এমন?

একটা সার্ভিসের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কোনও অপরাধের ক্ষেত্রে একটা ন্যায্য শাস্তির ব্যবস্থা করেন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য যেন সেই সার্ভিসের আর কেউ এমন অপরাধ করতে সাহস না পায়। তাই বলাই যায়, যে শাস্তির প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা আসলে কোনও সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়নি। আসলে আরিফুলের ঘটনাটি প্রকাশিত হয়ে পড়া এবং সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হওয়ার কারণে একটা ‘আই ওয়াশ’ দরকার ছিলই। সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।

বাংলাদেশের প্রশাসন ও পুলিশের নানা পর্যায়ে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার সর্বগ্রাসী হয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। এখন এসবের জন্য সত্যিকার ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করা হলে ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ পরিস্থিতি হবে। জেনেশুনে প্রশাসনের ওপর মহল সেটা করতে যাবে কেন? এই আইওয়াশের পরে সমালোচনা হচ্ছে, তাতেও কি তাদের ভ্রূক্ষেপ আছে?

এই রাষ্ট্রে ‘সরকারি কর্মকর্তা’ বলে কিছু থাকার কথা ছিল না।  বাংলাদেশের সংবিধানে ‘কর্মকর্তা’ বলেই কিছু নেই। আছে  ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’। অর্থাৎ ‘সরকারি কর্মকর্তা’ বলে যাদের আমরা চিনি তারা আসলে এই রাষ্ট্রের কর্মচারী। এমনকি কোনও ক্ষেত্রে সরকারের অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও ব্যক্তিও যদি সংবিধান, আইন এবং অন্যান্য বিধিবিধানের বাইরে কাজ করতে চান, তাহলে এই কর্মচারীদের উচিত সেটা পালন না করে রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা।

 জানি ওপরের কথাগুলো বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব ইউটোপিয়ান শোনাচ্ছে। এই দেশে আমলাতন্ত্র বহুদিন থেকেই সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যেকোনও নির্দেশ পালনের জন্য বসে আছে। তাদের মননে রাষ্ট্র বা জনগণ নেই। তাই আলোচ্য ঘটনাটিতে তাদের এই ‘আইওয়াশ’ দিয়ে কর্তব্য পালনের পর আমরা যতই সমালোচনা করি না কেন, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।

তাই বাংলা ট্রিবিউন তাদের শিরোনামে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিলেও আমি এটাকে একেবারেই প্রত্যাশিত বলে মনে করি।

বিভাগীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে আরিফুল ন্যায়বিচার পাননি। তিনি জানিয়েছেন থানায় মামলা করেছেন। আশা করেছেন আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন তিনি। সম্প্রতি ঘটা অতি চাঞ্চল্যকর এক ঘটনায় পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া এবং আদালতের সেটা বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা দেখে আমাদের মনে সেই পুরনো প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়েছে - অতি শক্তিমানদের ক্ষেত্রে আইনের তথাকথিত লম্বা হাত লম্বা থাকে না। তাই আরিফুল আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন সেই বিশ্বাস আমার মনে অন্তত নেই। আরিফুলের বিরুদ্ধে তারা আছেন, যাদের ওপর ভিত্তি করে সরকার টিকে আছে।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
সরকারি চাকরির আশ্বাস ও ভুয়া নিয়োগপত্র দিয়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
আইসিসি এলিট প্যানেলে প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার সৈকত
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ