X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানুষ কেন বিএনপিকে ভোট দেবে?

প্রভাষ আমিন
০৭ অক্টোবর ২০২১, ১৮:১৩আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২১, ১৮:১৩

প্রভাষ আমিন মানুষ কেন বিএনপিকে ভোট দেবে?: শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগের হাত থেকে বাঁচার জন্য জনগণ বিএনপিকে ভোট দেবে: মির্জা ফখরুল।

এই প্রশ্ন আর উত্তরেই লুকিয়ে আছে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণ শেষে ফিরে গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, ‘বিএনপি জানে যে তাদের আর কোনও সম্ভাবনা নেই, সে কারণেই তারা নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। একটা দল কীভাবে জিতবে? তার নেতৃত্ব কোথায়? একজন এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। আরেকজন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে দেশান্তরি, সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে। তাহলে জনগণ কোন ভরসায় ওই দলকে ভোট দেবে। জনগণ কখন ভোট দেয়। তারা তো দেখে ক্ষমতায় যাবে কে। যদি এখন এটাই হয় যে একজন এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, আরেকজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তারা তো ইলেকশনও করতে পারবে না। দেশের মানুষ বিএনপির সময়ে কী পেয়েছে আর আওয়ামী লীগের সময়ে কী পেয়েছে, সেটির তুলনা করতে হবে। জনগণ কাকে ভোট দেবে, আওয়ামী লীগের বাইরে আর কে আছে? কারা, কেন, কী কারণে, কোন সুখের স্বপ্নে, কোন আশায় বিএনপিকে ভোট দেবে?’

পরদিন মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আওয়ামী লীগের হাত থেকে বাঁচার জন্য জনগণ বিএনপিকে ভোট দেবে। তারা দেশের যে অবস্থা তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের জীবনের কোনও নিরাপত্তা নেই। জীবিকারও কোনও নিরাপত্তা নেই। চারদিকে ভয় ও ত্রাস। সন্ত্রাস ছাড়া আর কোনও কিছুই নেই। মানুষ অতিষ্ঠ। দেশের মানুষ শাসক দলের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। তাই তারা বিএনপিকে ভোট দেবে।’

যেখানে বাংলাদেশের মানুষ এক মেয়াদ পরপরই পরিবর্তনে অভ্যস্ত, সেখানে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে একযুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে। এই থাকার পেছনে আওয়ামী লীগের কৌশল বা অপকৌশল যেমন আছে, বিএনপির দায়ও কম নয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তারা আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও জয়ের চেয়ে মনোনয়ন বাণিজ্যেই তাদের মনোযোগ বেশি ছিল।

এটা মানতেই হবে, গত এক যুগে বাংলাদেশ বদলে গেছে। উন্নয়নকে মানদণ্ড ধরলে বাংলাদেশ এখন স্বর্ণযুগ পার করছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তো আমাদের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে গেছে। তবে শুধু পদ্মা সেতু নয়; গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, আয়– সব খাতেই চমকপ্রদ সব অর্জন আছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে, উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতিও। বাংলাদেশে সড়ক বা সেতুতে নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। শেয়ার বাজার, ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের প্রবল ঘাটতি আছে। হাজার কোটি টাকা পাচার বা লোপাটের ঘটনা আছে অনেক। যুবক, ডেসটিনি আর বিভিন্ন ই-কমার্স মিলে মানুষের ২১ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। সুশাসন থাকলে এগুলো ঠেকানো যেত।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মানুষকে স্বস্তি দিলেও দেশে আসলে রাজনীতিই নেই। গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের সূচকে বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ পরিবর্তন চাইতেই পারে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন বিএনপিকে ভোট দেবে? আওয়ামী লীগকে বদলে বিএনপিকে আনলে কী এমন পরিবর্তন হবে? যদিও ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে। তবু বিএনপির সর্বশেষ ৫ বছরের দুঃশাসনের কথা মানুষ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল যেটা বলেছেন, সেখানেই লুকিয়ে আছে বিএনপির ব্যর্থতা। ‘আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে বাঁচতে মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে’– তার মানে বিএনপির নিজেদের কোনও অর্জন বা যোগ্যতা নেই। গত এক যুগে তারা জনগণের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারেনি। আর আওয়ামী লীগ থেকে বাঁচতে বিএনপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনলে বিএনপির হাত থেকে তাদের কে বাঁচাবে? ভোট দিয়ে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেবে কেন মানুষ। ‘আওয়ামী লীগ থেকে বাঁচতে মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে’ এই নেতিবাচক ভোটের আশায় বসে না থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেদিন বিএনপিকে ভোট ইতিবাচক যুক্তি তুলে ধরতে পারবেন, অতীতে ভুলত্রুটি স্বীকার করে মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন; সেদিন তাদের রাজনীতি নতুন করে শুরু হবে। আওয়ামী লীগ খারাপ। কিন্তু বিএনপিও তো ধোয়া তুলসি পাতা নয়। এক খারাপকে বিদায় করে আরেক খারাপকে আনার দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে।

বিএনপির আরেকটা বড় সংকট তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী– নেতৃত্ব। আগামী নির্বাচনে বিএনপির নেতা কে? এই প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়াই তাদের নেতা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া এখন বিএনপির কোনও পদে নেই। সরকারের অনুগ্রহে তিনি এখন কারাগারের বদলে নিজ বাসায় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন বটে, তবে বিএনপি যেন তাকে ভুলেই গেছে। বেগম খালেদা জিয়ার যা বয়স, শারীরিক যে অবস্থা তাতে তিনি আবার নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবেন, এটা বিশ্বাস করার লোক বিএনপিতেও খুব বেশি নেই। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিক মামলার দণ্ড নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন। লন্ডন থেকেই তিনি দল চালাচ্ছেন। কিন্তু এভাবে একটি দল চালানো যায়, কিন্তু সে দলকে আন্দোলন বা নির্বাচনে ক্ষমতায় আনা কঠিন। তাছাড়া দেশে-বিদেশে তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। তাই আওয়ামী লীগ বাঁচতে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হলে নেতৃত্ব আগে ঠিক করতে হবে।

একটা কথা বলা হয়, সিদ্ধান্তহীনতার চেয়ে ভুল সিদ্ধান্তও ভালো। এই কথাটা বিএনপির ক্ষেত্রেও খাটে। তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, সিদ্ধান্তহীনতা। একবার নির্বাচন বয়কট, একবার অংশগ্রহণ, একবার সংসদ বয়কট, একবার যোগদান, কখনও আন্দোলন, কখনও ঢিমেতালে, কখনও ড. কামালের সঙ্গে, কখনও জামায়াত- বিএনপি আসলে নিজেদের করণীয় ও ভবিষ্যৎ স্থির করতে পারছে না। আওয়ামী লীগের মতো বড় ও শক্তিশালী দলকে হটাতে হলে নিজেদের লক্ষ্য ঠিক করতে, সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে হবে, নেতৃত্ব ঠিক করতে হবে। হাওয়াই কথা বলে লাভ হবে না।

আমরা গণতন্ত্র চাই, সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, যাতে মানুষ নিজেদের ভোট দিতে পারে, পছন্দের নেতৃত্ব বেছে নিতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্র মানে যেন শুধু এক দুঃশাসক বদলে আরেক দুঃশাসককে ক্ষমতায় আনা না হয়। গণতন্ত্রের পথ ধরে আসে সুশাসন, মানবাধিকার, টেকসই অগ্রগতি, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
কুড়িয়ে পাওয়া সাড়ে চার লাখ টাকা ফিরিয়ে দিলেন ইজিবাইকচালক
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
ঢাকার পর্দায় আবার গডজিলা-কিং কং দ্বৈরথ
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
বিপজ্জনক অবস্থা থেকে ফিরেছেন খালেদা জিয়া: মির্জা ফখরুল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ