X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

উর্দুর সঙ্গে বাংলার কোনও বিরোধ ছিল না

স্বদেশ রায়
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০৬আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০৬

স্বদেশ রায় আমাদের ভাষা আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই। অর্থাৎ যে সময়ে পাকিস্তান সৃষ্টিটা অনেকখানি বাস্তবতা বা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ সময়ে এই আন্দোলনটি শুরু করেছিলেন ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনিই মূলত আমাদের ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক গুরু। এরপরে পার্লামেন্টে বা জনপ্রতিনিধি পর্যায়ে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।  তারপরে এই আন্দোলন নানান সময়ে রাজনীতিকদের মাধ্যমে, বেশি ক্ষেত্রে ছাত্রদের মাধ্যমে, এছাড়া শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ মানুষও এগিয়ে নেন।

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শিক্ষাবিদ ও বহু ভাষাবিদ। তিনি তার লেখায় মোটেই উর্দুর পক্ষে প্রস্তাবকারী জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য খণ্ডন করতে গিয়ে উর্দুকে খাটো করেননি। খাটো করেননি যে এলাকাগুলো নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হবে– তার ভাষাকে। তিনি শুধু সংখ্যাগুরুর ভাষা হিসেবে বাংলাকে এক নম্বর রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছিলেন। তবে সেটা কখনোই একক নয়, অন্যতম। আরও অন্যান্য ভাষা যাতে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পায়, তিনি তারও পক্ষে ছিলেন। পার্লামেন্টের আন্দোলনও এর বাইরে ছিল না। কারণ, অনেক ভাষার দেশে একটি ভাষায় যদি রাষ্ট্রীয় কাজ চালানো হলে বাকি ভাষাগুলোর মৃত্যু না ঘটলেও বিকাশে বাধা পায়। ভাষার বিকাশ একটি চলমান বিষয়। ভাষা যেমন বায়োলজিক্যাল, অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক অঙ্গের সৃষ্টি তেমনি এটা মনোজাগতিক ও চিন্তাজাগতিক।

বাঙালির সব থেকে বড় বিজ্ঞানী সত্যেন বোস এমনকি বাঙালির বিজ্ঞান শিক্ষার জনক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বাঙালি যাতে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা করতে পারে সে ব্যবস্থার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। নিজেরা কিছু কাজও করে যান। এরা কিন্তু কখনোই বিজ্ঞান চর্চার উর্বর ক্ষেত্রের ভাষা জার্মানি বা ইংরেজির বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য দেননি বা সে ভাষা চর্চায় নিরুৎসাহিত করেননি। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান শিক্ষাকে মাতৃভাষায় নিয়ে আসা। কারণ, মানুষ যা ভাবে বা চিন্তা করে তার প্রকাশ সব থেকে ভালোভাবে ঘটে মাতৃভাষায়। এ কারণে যেকোনও মাতৃভাষাকে ওই জাতির জন্যে বাঁচিয়ে রাখা ও বিকাশ বা বিবর্তন একান্ত দরকার। সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবেশের আনুকূল্য না পেয়ে যে বহু ভাষার পৃথিবীতে বিবর্তন ঘটেনি, অনেক ভাষা এখন ফসিল ভাষা, কোনও ভাষা একেবারে হারিয়ে যাওয়া ভাষা, এই ঘটনা পৃথিবীর জন্যে আদৌ ভালো নয়। ওই সব নরগোষ্ঠী প্রাকৃতিকভাবে ধীরে ধীরে অন্য ভাষাভাষী হয়ে গেছেন, কিন্তু ওই ঘটনাগুলো কোনোমতেই পৃথিবীর আর দশটি সাধারণ বিবর্তনের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। কারণ, প্রত্যেকটা ভাষার সঙ্গে ওই ভাষার অর্জিত ও উপলব্ধ জ্ঞান থাকে। তাই কোনও ভাষা হারিয়ে গেলে, তার সঙ্গে মানুষের হাজার বছরের কিছু না কিছু জ্ঞান হারিয়ে যায়। আর এ কথা আমরা সকলেই জানি, মানুষ প্রাণিকুল থেকে পৃথক হয়ে আজ যে প্রাণীদের মধ্যে এক অনন্য উচ্চতায়, এটা ঘটেছে শুধু ভাষার কারণে। ভাষাই মানুষকে এই অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে। তাই পৃথিবীর কোনও ভাষার সঙ্গে কোনও ভাষার দ্বন্দ্ব নেই। বরং ভাষা সবসময়ই অন্য ভাষার বা  পরস্পরের সহায়ক। আর এ বিষয়টি অনেক ভালো বুঝতেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তাই তিনি কোনও ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার বিরোধ সৃষ্টি করেননি। তিনি পাকিস্তান নামক একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে যাতে ভাষার ওপর কোনও আঘাত না পড়ে সেই দর্শনই উপস্থিত করেছিলেন।

বাস্তবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে ভাষা নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল এর মূল কারণ, রাষ্ট্রের দর্শন ধর্ম হওয়া এবং রাষ্ট্রীয় নেতারা আদর্শহীন হয়ে যাওয়া। বাস্তবে আধুনিককালের বা পুরাকালের কখনোই কোনও প্রকৃত রাষ্ট্রের দর্শন ধর্ম ছিল না বা ধর্ম কোনও রাষ্ট্রের দর্শন হয় না। ধর্ম যখনই কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত হয় তখনই ওই রাষ্ট্র পঙ্গু হয়ে যায়; রাষ্ট্রনায়ক অর্থহীন হয়ে পড়েন।  আর রাজনীতিবিদরা যখনই কোনও ধর্ম বিশ্বাসে রাষ্ট্র চালাতে চান– তখনই তাঁরাও আদর্শহীন হয়ে যান। এমনকি সত্য হলো, কোনও রাজনীতিবিদ যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনোরূপ ধর্মকে মেনে নেন বা আপস করেন, উনি আর তার পরমুহূর্ত থেকে রাজনীতিবিদ থাকেন না। তিনি ধর্মকে ব্যবহার করে অনেক দিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারেন, এ ধরনের পুরোহিততন্ত্র, চার্চতন্ত্র পৃথিবীতে যে ছিল না তা নয়। তবে সে সময়টাকে বর্বর সময় বলা হয়। সভ্য সময় বলা হয় না। অন্যদিকে ভাষা সম্পূর্ণরূপে সভ্যতার অংশ ও বাহক। তাই রাষ্ট্রে ধর্ম যোগ হলে যেকোনও সভ্যতার মতো ভাষার সঙ্গেও তার সংঘাত হবে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে তাই ভাষার সঙ্গে যে সংঘাত ঘটেছিল, তার মূল কারণ ছিল ধর্ম।

আজ ভাষা আন্দোলনের শুরুর ৭৫ বছর পরে এসে এই সত্য বলতে হবে, ভাষার সঙ্গে ওই যে সংঘাত ঘটেছিল, এর মূল কারণ যে ধর্ম- এ কথাটি সেদিন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে রাজনীতিবিদরা বলতে পারেননি। কারণ, তারা সবাই তখন ধর্মের পুকুরে গোসল করে ঘাটে উঠেছেন মাত্র। এ কারণে রাজনীতিবিদরাই খুব কৌশলে সাধারণজনের কাছে উর্দু বনাম বাংলা এই ছবি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। আর এ ধরনের অপকর্মের কুফল কতটা হয় তা আমরা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। এই উর্দুর বিপরীতে বাংলাকে নিয়ে গিয়ে, উর্দুকে শত্রু বানাতে গিয়ে- বাংলা ভাষা নিয়ে এক ধরনের জিঙ্গোইজমের পথে হেঁটেছিলাম আমরা। শুধু বাংলাকে আঁকড়ে ধরার এক উগ্র চেতনার কারণে অন্য ভাষাকে দূরে ঠেলেছি। এই কিছু দিন আগ অবধি ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ইন্টারন্যাশনাল হোটেলগুলোর সাইন বোর্ড নিয়েও কথা উঠতো। এমনই কূপমণ্ডূকতায় আমরা আটকে যাই। এবং এই উগ্র চিন্তাধারার থেকে স্বাধীনতার পরে দেশের নাগরিকদের যেখানে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে, শিশুদের অন্তত তিন থেকে চারটা ভাষা শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল, তার বদলে শুধু বাংলা শেখাতে গিয়ে আজ কী দুরবস্থা সমাজের শিক্ষাক্ষেত্র, প্রশাসনসহ নানান পেশায়, তা নিশ্চয়ই আর বলার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি বাংলা ভাষার বিকাশও থেমে গেছে। কারণ, বাংলা ভাষার বিকাশ হয়েছে সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি, উর্দু, ম্যান্ডারিন, ল্যাটিন, জার্মানি, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষার মিলনের ফলে। শুধু বাংলার প্রাকৃত শব্দগুলো পরিবর্তিত হয়ে ও তার ভাষারীতি মেনে আজকের এই বাংলা ভাষা হয়নি। কিন্তু এ সত্য সবার মানতে হবে, উনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে বাংলা ভাষার যে বিকাশ ঘটেছিল, তা এখন থেমে গেছে। ভাষা একটা চক্রের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।

এর মূল কারণ, একটা পর্যায়ে ভাষাকে অনেক বেশি আদর করতে গিয়ে তাকে ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে মানুষ করার চেষ্টা করেছি। আর তার ফলই এখন ঘটছে। এমনকি আমরা মানুষের মনের ভাষাও পড়েনি। কারণ, আমরা দেখেছি, মানুষ ইংরেজি, রুশ নোবেল পড়তে চায়, মানুষ উর্দুর গালিব, আমির খসরু, মান্টো পড়তে চায়। মানুষ পার্সি’র রুমি পড়তে চায়। আর এগুলো শুধু অনুবাদে নয়, কারও কারও আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে মূল ভাষায় পড়ার। আর মূল ভাষায় পড়লে সেখান থেকে সে ঘড়ায় করে একটু বাড়তি জল নিয়ে আসে নিজের ভাষার জন্যে। তাই রাজনৈতিক ময়দানের ভাষায় উর্দুকে যে সেনাবাহিনীর ভাষা বানানো হয়েছিল, ওখানেই আমরা আটকে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম, প্রিয় গালিবের ভাষা উর্দু।

তাই ভাষা আন্দোলনের ৭৫ বছর পরে এসে এ সত্য আমাদের স্বীকার করতে হবে, গালিবের ভাষা আমাদের শত্রু ছিল না। আমাদের মূলত শত্রু ছিল পাকিস্তান নামক একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র।  পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যদি একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র অর্থাৎ ধর্মীয় রাষ্ট্র না হতো তাহলে তার কিন্তু কোনও নাগরিকগোষ্ঠী বা ভাষাভাষীকে চেপে রাখার প্রশ্ন উঠতো না। সে রাষ্ট্রটিকে নিয়ে সবার জন্যে একটা সংবিধান তৈরি করতে বসতো রাজনীতিকরা। আর সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সব বড় ভাষাই রাষ্ট্রীয় ভাষা হতো। ধর্মের জন্যে রাষ্ট্রের নামে ভাষার ওপর বা কোনও জনগোষ্ঠীর ওপর কোনও জবরদস্তি করার প্রয়োজন পড়তো না।

যাহোক, পাকিস্তান যা করেছিল তা এখন অতীত। অতীতের ইতিহাসের প্রকৃত সত্য পর্যালোচনার দরকার আছে। কারণ,  অতীত ইতিহাস সত্যের ওপর না দাঁড়ালে ভবিষ্যৎকে এগোতে অসুবিধা হয়। আর এ কারণেই এই সত্য বলা। তবে এখন এই ভাষার প্রশ্নে সব থেকে বড় প্রয়োজন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর হয়ে গেলো; অথচ ভাষার বিকাশ ঘটছে না কেন?

তাহলে এ সত্য মানতে হবে, যে নামেই রাষ্ট্র পরিচালনা করুন না কেন, ভাষার বিকাশের প্রকৃত পরিবেশ কেউই সৃষ্টি করতে পারছেন না। ভাষার বিকাশের জন্যে যে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব যারা পালন করছেন তাদের হয়তো সত্যি অর্থে সেটা নেই। তবে মোটা দাগে যা দেখা যায়, গত পঞ্চাশ বছরে ভাষার বিকাশের দিকে নজর দিয়েছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনরা খুবই কম। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ধর্মকে লালন করার দিকে যতটা নজর দিয়েছেন, ভাষাকে লালন করার দিকে তার শতভাগের একভাগও নজর দেননি।

তাই মূলত রাজনীতি ও ভাষা এখনও সেই পাকিস্তানি বৃত্তে আটকে আছে। এই বৃত্ত ভাঙার কাজ করাই এখন মূলত একুশে ফেব্রুয়ারি পালন।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ