X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

শরিফ উদ্দিন: হিরো না ভিলেন?

প্রভাষ আমিন
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:০১আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:০১

প্রভাষ আমিন হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের অপসারিত উপ-সহকারী পরিচালক শরিফ উদ্দিন। তার অপসারণের প্রতিবাদে নজিরবিহীনভাবে রাজপথে নেমে আসেন দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শরিফ উদ্দিনকে অপসারণের পর থেকেই গণমাধ্যমে তার উপস্থিতি। প্রতিদিনই তার পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো ‘শরিফময়’। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালতেও। অধিকাংশের চোখে শরিফ উদ্দিন হিরো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসী বীর। আবার অনেকে বলছেন, দুদককে ব্যবহার করে শরিফ উদ্দিন দুদকেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছিলেন। বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে ‘অতি উত্তম’ মান পাওয়া শরিফ উদ্দিন হঠাৎ অপসারণের মতো কী এমন অপরাধ করলেন, প্রশ্ন আছে সেটি নিয়েও।

এটা ঠিক, দুদকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। দুদককে সবসময় কাজ করতে হয় দুর্নীতিবাজদের নিয়ে। আর বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজরাই শক্তিশালী, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে তারা। তাই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেই নানামুখী চাপে পড়তে হয় দুদক কর্মকর্তাদের। আবার দুদক কর্মকর্তাদের সামনে থাকে লোভের পাহাড়ও। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই চাপ এবং লোভ সামলানো সহজ কাজ নয়। আর দুদকে যারা কাজ করেন, তারাও তো এই বাংলাদেশেরই মানুষ। তবু দুদকে নিয়োগ দেওয়া হয় বাছাই করা কর্মকর্তাদের। আমরা ধরে নিচ্ছি, তারা সততা, নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে কাজ করছেন। তারপরও দুদকের ভেতরেও যে কালো বিড়াল আছে, তার প্রমাণ তো দুদিন আগে আদালতেই আছে। পুলিশের সাবেক ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুদকের সাবেক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে আট বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর ঘুষ দেওয়ার অপরাধে তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে ডিআইজি মিজানের। রায় ঘোষণার পর আদালতে ডিআইজি মিজান বলেছেন, দুদকে বাছির নয়, আরও বাছির আছে। তিনি সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন তাদের খুঁজে বের করতে। দুদকে যে আরও বাছির আছে সেটা অনুমান করাই যায়। হাতেনাতে ধরা হয়তো অত সহজ নয়।

আগেই বলেছি দুদকে দায়িত্ব পালন করা ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং। একইসঙ্গে বিষয়টি স্পর্শকাতরও। দুদককে যেকোনও পদক্ষেপ নিতে হয় অনেক ভেবেচিন্তে। দুদক কাউকে চিঠি পাঠালে বা ডেকে পাঠালে বা কারও সম্পদের অনুসন্ধানে নামলেই সমাজ সেই ব্যক্তির কপালে দুর্নীতিবাজের তকমা এঁটে দেয়। পরে অনুসন্ধানে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও সেই কলঙ্ক তিলক পুরোটা মোচন করতে পারেন না তিনি। আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আদালত মিডিয়া আর সোশাল মিডিয়া। প্রচলিত আদালতে বিচার হওয়ার আগেই মিডিয়া ট্রায়াল একজন মানুষকে নানারকম সাজা দিয়ে দেয়। তাই বলে দুদক হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, তেমনটি আশা করাও ভুল।

যেকোনও পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাদের দশবার ভাবতে হবে। ছায়াতদন্তে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরেই যেন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে দুদকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, তারা চুনোপুঁটি নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। রাঘব বোয়ালদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকেন। চুনোপুঁটি থেকে রাঘব বোয়ালের দিকে এগোতে গেলেই নানা জাল তাদের গতি আটকে দেয়। ফারমার্স ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক গিলে খাওয়া লোকেরা সমাজে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্থপাচারকারীরাও উড়ে যায় নিশ্চিন্তে। সরকারি দলের অনেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে ছাপা হয়। দুদক মনে হয় পত্রিকা পড়ে না। তারা সেদিকে ফিরেও তাকায় না। আবার দুদক যদি সরকারি দলের কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেও, সন্দেহ যায় না। কিছু দিন পরই দুদক সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

এটা ঠিক শরিফ উদ্দিন চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে অনেক স্পর্শকাতর মামলা অনুসন্ধান করছিলেন। কক্সবাজারে তিনটি বড় প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জালিয়াতি তদন্ত করতে গিয়ে অনেক বড় বড় সাপের লেজে পা দিয়েছেন তিনি। আমলা, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক অনেকের নাম এসেছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করার জালিয়াতিতেও নাম এসেছে অনেক রাঘব বোয়ালের। কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। তার আগেই তাকে বদলি করে দেওয়া হয়। কিন্তু বদলি হলেও যথাযথভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া এবং নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়া নিয়ে নানা টালবাহানা করেন শরিফ। তার আকস্মিক অপসারণে অনেকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নানা স্পর্শকাতর মামলার তদন্ত এবং রাঘব বোয়ালদের দিকে আঙুল তোলার যোগসূত্র খুঁজছেন। শরিফ উদ্দিনের অপসারণ নিয়ে এত আলোচনার কারণও সেটিই।

পারসেপশন হলো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান নেওয়াতেই চাকরি খোয়াতে হয়েছে শরিফ উদ্দিনকে। আর ধারণা কখনও কখনও সত্যির চেয়েও শক্তিশালী।

তবে শরিফ উদ্দিনের চাকরি খোয়ানো নিয়ে এত আলোচনা তাকে অপসারণের ধরন নিয়ে। দুদকের চাকরিবিধির ৫৪(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনও কারণ না দর্শাইয়া কোনও কর্মচারীকে নব্বই দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা নব্বই দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারিবে।’ এই ধারায় কাউকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয় না। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়াই যে কাউকে অপসারণ করা যায়। এটা বাংলাদেশের সংবিধান, প্রচলিত আইন এবং বিচারের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারচেয়ে বড় কথা হলো, যার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং মামলা ছিল সেই এনামুল বাছিরকেও বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাৎক্ষণিক অপসারণ নয়। সেখানে শরিফ উদ্দিনের ব্যাপারে এমন সর্বোচ্চ অস্ত্রের প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন আছে। অনেকে বলছেন, শরিফ উদ্দিন কোনও প্রভাবশালী মহলে ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার। দুদক চেয়ারম্যান মইনুদ্দিন আব্দুল্লাহ কানাডা থেকে প্রচারিত একটি অনলাইন টিভিকে বলেছেন, শরিফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অন্তত ১৮টি অভিযোগ আছে। আর সব অভিযোগে কারণ দর্শাতে হলে তিন-চার বছর সময় লেগে যাবে। তাই তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমি দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য সত্য বলেই ধরে নিচ্ছি।

কিন্তু শরিফ নিশ্চয়ই ১৮টি অপরাধ একদিনে করেননি। আগে থেকেই তাকে শুধরানো বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়নি কেন? কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের জালিয়াতির তদন্ত করার পরই বুঝি দুদকের ‘অতি উত্তম’ কর্মকর্তা ‘অতি অধম’ বনে গেলেন। চেয়ারম্যান ১৮টি অভিযোগের কথা বললেও সচিব মাহবুব হোসেন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে শরিফের বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ এনেছেন। শরিফের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ চাকরিবিধি না মানা, শৃঙ্খলা না মানা, স্বেচ্ছাচারী আচরণ করা। শরিফের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, দুদককে না জানিয়েই অভিযুক্তদের অন্তত ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা, উদ্ধার করা ৯৪ লাখ টাকা এক বছর চার মাস নিজের হেফাজতে রাখা। শরিফ অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেননি। দাবি করেছেন, তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে এসব করেননি। যে উদ্দেশ্যেই করুন, তিনি যে চাকরির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ৯৪ লাখ টাকা এক বছর চার মাস নিজের জিম্মায় রেখে দেওয়া কোনও বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে শরিফের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সত্যি হলেও কোনোটাই তাকে ৫৪(২) ধারায় তাৎক্ষণিক অপসারণের মতো গুরুতর নয়। এখানেই মূল প্রশ্ন। কক্সবাজারের বড় প্রকল্পে জালিয়াতিতে বড়দের নাম আসার সঙ্গে ৫৪(২) ধারার প্রয়োগই তাকে আসলে ‘হিরো’ বানিয়ে দিয়েছে।

তবে চাকরি হারানোর পর থেকে শরিফ উদ্দিন যা করছেন, তাতে দুদকের অভিযোগ সত্যি মনে হচ্ছে এবং সন্দেহ আরও বাড়ছে। তিনি স্বাভাবিকভাবে দুদকে আবেদন করতে পারতেন, আদালতে যেতে পারতেন। তা না করে তিনি দুদক কর্মীদের উসকানি দিয়ে মাঠে নামিয়েছেন। তিনি রহস্যজনকভাবে গোপন স্থান থেকে বক্তব্য পাঠাচ্ছেন, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। কিন্তু শরিফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে তো কোনও মামলা হয়নি, তাহলে তিনি কেন পালিয়ে আছেন। আর তার বক্তব্য তো তিনি আদালতে বলতে পারতেন। তা না করে তিনি গোপন স্থান থেকে, দেশের বাইরে থেকে সম্প্রচারিত বিভিন্ন বিতর্কিত অনলাইন টিভিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। তার আইনজীবী নির্বাচন, রহস্যজনক আচরণ, পালিয়ে থাকা সবকিছুই সন্দেহজনক। প্রশ্নটি সামনে আসছে, তিনি কি সত্যিই ‘হিরো’, নাকি দুদককে ব্যবহার করে দুদকের তথা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কোনও ভিলেন?

শরিফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা ১৩টি অভিযোগ সত্যি হলেও প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে রাজি নই। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাৎক্ষণিক অপসারণও গ্রহণযোগ্য নয়। আমি চাই শরিফ উদ্দিন প্রকাশ্যে এসে আদালতে তার প্রতি হওয়া অন্যায্য আচরণের প্রতিকার চাইবেন। কোনও ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি যেন না হন তিনি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ