X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তি আছে

লীনা পারভীন
১৫ মার্চ ২০২২, ২০:৩৮আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২২, ২০:৪৫

লীনা পারভীন বাজারে আগুন অথচ মাসটা ফাগুন। এই মাসে মনে থাকার কথা বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া। কিন্তু চারদিকে ফাল্গুনের আলাপ বাদ দিয়ে চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার আগুনের আলাপ। এই টানাপড়েন সময়ের মাঝে আমাদের মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর একটি বক্তব্য যেন সেই আলাপে ‘ঘি ঢেলে’ দিলো। ফাগুনের হাওয়াও সেই আগুনকে থামাতে ব্যর্থ। কী বলেছেন আমাদের মাননীয় তথ্যমন্ত্রী?

তিনি সম্প্রতি তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘পৃথিবীতে সবসময় দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, কখনও কমেনি। যখন বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়, তখন এক আনা অর্থাৎ ১৬ পয়সায় কয়েক কেজি চাল পাওয়া যেত, কিন্তু বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছে। অর্থাৎ দেখতে হবে, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে কিনা।

‘গত ১৩ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে চারগুণ আর নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ, মধ্যম আয়ের মানুষেরও ক্রয়ক্ষমতা তার কাছাকাছি রয়েছে।’

ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গত কয়েক বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধি অনেক কম বলে দাবি করেন তথ্যমন্ত্রী।

তার ভাষায়, “বাংলাদেশে আগে দাবি-দাওয়া হতো একজন শ্রমিকের মজুরি হতে হবে সাড়ে তিন কেজি চালের মূল্যের সমান। আর এখন একজন শ্রমিক কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ কেজির চালের মূল্যের সমান মজুরি পায়, যার অর্থ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে।”

আমি পত্রিকা থেকে হুবহু মন্ত্রীর কথাটুকু তুলে দিলাম। মন্ত্রী কি ভুল কিছু বলেছেন? না। আসলেই তিনি ভুল বলেননি। তাহলে তাঁর কথা নিয়ে এত সমালোচনা চলছে কেন? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এটা সাদা চোখেই বলে দেওয়া যায়। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সঞ্চয়ী হয়েছে এটাও সত্য। মন্ত্রী আসলে যে জায়গাটুকু মিস করেছেন সেটি হচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি তার চাহিদাও বেড়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক, আগে যে মানুষটি হয়তো শুধু দুইবেলা খাবারের সংস্থান করতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকতো, সেই মানুষই এখন তিনবেলা খাবার নিশ্চিত করতে চায়। গায়ের কাপড়টা একটু শখ অনুযায়ী কিনতে চায়। সন্তানকে একটু ভালো জায়গায় পড়াতে চায়। সন্তানের মুখে কেবল ভাত তুলে দেয়াতেই পিতামাতার শান্তি হয় না। তারা তাদের সন্তানকে তার শখের জিনিসটাও দিতে চায়।

আসেন একটু অঙ্ক করি। ধরে নিই একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। আয় করার লোকের সংখ্যা একজন। এবং তাদের মাসিক আয় মোট ২০ হাজার টাকা। পাঁচ জনের পরিবারে মাসিক চাল লাগে কম করে ধরলেও ৩০ কেজি। তেল একদম মেপে মেপে ব্যবহার করলেও ৫ লিটার লাগবেই। তার বাইরে কাঁচা বাজার আছে, আছে শুকনা বাজার। সেগুলো মিলে ধরে নিলাম সপ্তাহে কোনও মাংস খাবে না এবং তিন দিন মাছ খাবে। তাহলে ৫২ টাকা করে কেজি ধরলে ৩০ কেজি মোটা চালের দাম আসে প্রায় ১৬০০ টাকা। ৫ লিটার তেলের দাম ৯০০ টাকা। পেঁয়াজের কেজি ৫০ টাকা ধরলে একদম কম করেও ৩ কেজির দাম আসে ১৫০ টাকা। বেড়েছে কাঁচা মরিচের দামও। কাঁচা মরিচ এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজিতে। তালিকা করতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তাই খসড়া ধরে নিচ্ছি, ৫ জনের পরিবারে মাসিক শুকনা বাজার লাগে ৩০০০ হাজার টাকার, কাঁচা বাজার লাগবে ৪০০০ টাকার। তাহলে খাবার খরচ আসে মোট ১০ হাজার টাকা। তার বাইরে আছে বাসা ভাড়া। ২০ হাজার টাকা আয়ের পরিবারের বাসা ভাড়া ধরে নিলাম মাসিক ৮ হাজার টাকা তো হবেই। তার বাইরে কত রইলো? নাহ। কুলোচ্ছে না। কুলায় না আসলে। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ কে দেবে? কেবল খেতে পারাই কি মানুষের উন্নত হওয়া নিশ্চিত করে? পোশাক, চিকিৎসা খরচ, সামাজিকতা, সেসবের হিসাব কই?

মাননীয় মন্ত্রীর হিসাবে কোথাও ভুল নেই, কিন্তু একজনের আয়ের সিংহভাগই যদি খরচ হয়ে যায় কেবল অন্নের পেছনে– তাহলে বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, মানবিকতা সেগুলোর হিসাব আসবে কোথা থেকে? খাবারে পুষ্টির হিসাবটি তাহলে এখনও বিলাসিতাই থেকে যাচ্ছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমার আগামী প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারছি না এই উন্নয়ন দিয়ে।

তাই বলি, আমাদের মাননীয়দের আরেকটু গভীরে গিয়ে কথা বলা দরকার আছে। আরেকটু জনবান্ধব হলে বরং সমস্যার সমাধান করা অনেক সহজ হয়ে যায়। বর্তমানে বাজারের যে অবস্থা, এটি বাস্তব। একে অস্বীকার করে কোনও উন্নয়নকেই বিশেষায়িত করা যায় না। বরং সমস্যাকে স্বীকার করে কীভাবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের প্রাপ্য ফসলটুকু সবার জন্য নিশ্চিত করা যায় সেই কৌশল খুঁজে বের করা দরকার। এভাবে করে কিছু মুনাফালোভীর পেটেই চলে যাচ্ছে সব সুবিধা। মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদীরা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে সরকারের সব সাফল্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের মন্ত্রীরা সেটিকে বুঝতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। উন্নয়ন যতদিন সমানভাবে সবার ঘরে না আসবে ততদিন মানুষের মনে স্থান করে নেওয়া কষ্টদায়ক হবে। উন্নয়ন মানে মাথা থেকে চিন্তার বোঝা কমে যাওয়া, পেট চালানোর দায়মুক্তি। এমন উন্নয়ন যেন না হয়, যেখানে কিছু লোক সুবিধা পাবে কিন্তু বেশিরভাগ ভোটারের মাথায় চিন্তার বোঝাটাও মাথাপিছু আয়ের মতো তিনগুণ বা চারগুণ বেড়ে যাবে।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ