X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৌলবাদের কু-নজর

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৬ মার্চ ২০২২, ১৬:৫২আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২২, ১৬:৫২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা মাত্র ৩ মিনিট ৭ সেকেন্ডের ভিডিও। এতেই জাত গেলো জাত গেলো রব উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২তম ব্যাচের বিদায়ী অনুষ্ঠানের ভিডিও সেটি। একটি হিন্দি গানের সঙ্গে যুগল নাচ দেখে ‘বক ধার্মিক’দের যেমন ‘ওজু নষ্ট’ হয়েছে, তেমনি কিছু আধুনিকদের নাকি বদ হজম হয়েছে। সময় টেলিভিশন বলছে, অনুষ্ঠানে পরিবেশিত নৃত্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঝড় আসলে উঠেনি, হয়েছে শরীর জ্বালাপোড়া।

এই নৃত্যই দুটো ছেলে করলে এত কথা হতো না। সমালোচকদের মধ্যে পুরুষ আছে, দেখলাম অতি ঝকমকে পোশাকের নারীও আছে। এর অর্থ হলো, সমাজে পুরুষের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টায় নারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার থাকলেও তাকে সমানাধিকার দেওয়ার ভয় অবিরাম তাড়া করে এবং সেটা নারী পুরুষ যেকোনও দিক থেকেই হতে পারে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ৫০টিরও বেশি বছর কেটে গেলো। পতাকা উড়িয়ে, মাইক বাজিয়ে ঘটা করে ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বর উদযাপিত হয়। তবে আমাদের মন কেবল কুডাক গায়। যত উৎসবের ঘনঘটা, তত আঁধার নামে মনোজগতে।

মুসকান ইস্যুতে যে নারীকে আমি কয়দিন আগে তর্ক করতে দেখেছি যে পোশাক যার যার ইচ্ছে পরবে, যে পুরুষ লম্বা বক্তৃতা ঝেড়ে ফেললেন উদযাপনের স্বাধীনতা নিয়ে, তারাই এখন ব্যস্ত সানি লিওনি জামা পরে এলো কিনা তা নিয়ে। তারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে মেয়েটার ব্রাউন প্যান্ট বেরিয়ে এলো কিনা সেটা নিয়ে, ক্লিভেজ দেখা গেলো কিনা তা নিয়ে।

মানুষের, বিশেষ করে নারীর আনন্দ উদযাপন মতামত, জীবনযাপন, কাজ, শিল্পচর্চা, ভালোবাসা, যৌনতার স্বাধীনতা—সবটাই যেন এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অনুমোদন সাপেক্ষ।

আসলে আমরা এখন বাস করছি সংশয়ে। ন্যায়-অন্যায়ের সংশয়, শ্লীলতা-অশ্লীলতার সংশয়। যারা জাত গেলো গেলো করছে তারা জানেই না আসলে কী চায়। তবে বোঝা যায় যে সমস্যাটা প্রতিক্রিয়াশীলতার। মুক্তচিন্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা সব তাদের যারা সবকিছুতে ধর্মকে ঘিরে ভাবে। উগ্র মতাদর্শের জয় দেখতে চায় তারা। এই মূর্খতার দাম দিয়ে যাচ্ছি আমরা নিয়মিত।

উদারপন্থী বনাম রক্ষণশীল এই দ্বন্দ্বের নেপথ্যে রয়েছে আসলে ধর্মব্যবসায়ী বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার সংঘাত। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার দীক্ষায় এখনও বহুলাংশে দীক্ষিত বাংলাদেশের জনসাধারণের একটি অংশ। কিন্তু ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর যারা থাকেন তাদের আপসকামী রাজনীতির কারণে সুনজরে রয়েছে এই ক্লিভেজ দেখা গোষ্ঠী।

একে আমরা বলতে পারি মৌলবাদের কুনজর। এক জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের উদ্ভব হলে বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদী দর্শনের বিস্তার ঘটায় এমন একটা বিপজ্জনক অবস্থানে ধাবিত হচ্ছে সমাজ। দুই বস্তু - ধর্মীয় ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতার বিষদৃষ্টিতে পড়েছে এই সমাজ আজ। ধর্ম এবং রাষ্ট্র, ক্ষমতার দুই ভরকেন্দ্র। উভয়েই স্থিতাবস্থাকামী। এমন স্থিতাবস্থা যা কেবল নতজানু ভক্ত এবং বাধ্য নাগরিক উৎপন্ন করে।

সাম্প্রদায়িক রক্তে ভেজা আমাদের ভূমি। মনুষ্যত্বের চরম অপমান চলছে গোটা দেশে। ধর্ম এখন মারাত্মক এক হাতিয়ারে রূপান্তরিত। ধর্মের নামে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর ওপরে নিজ মতবাদ চাপাতে উদ্যত। জন্ম নিচ্ছে হিংসা, দ্বেষ, রণ, রক্ত। তারাই আজ উৎসবের রঙ নষ্ট করতে চায়। ধর্মীয় মৌলবাদ (সে যে ধর্মই হোক) প্রথম এবং শেষ আক্রমণ হানে সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, উদারতার বিরুদ্ধে, নারীর বিরুদ্ধে।

উন্নত সমাজে ধর্ম পালন নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের বহু ধর্মের দেশের অবস্থা আদৌ সন্তোষজনক নয়। বহুত্বের মাঝে মিলনের সুরটি আজ বড় করুণ ও বেসুরে বাজছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এ দেশে কখনও কোনও ধর্ম প্রবল হয়ে উঠে অন্য ধর্মের কণ্ঠরোধ করেনি। কিন্তু বর্তমানে ধর্ম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকে কলঙ্কিত করছে।

ধর্মীয় মৌলবাদ ধর্মাচারের ভিত্তিতে সমগ্র জাতিকে বিভক্ত করছে, বিচ্ছিন্ন করছে। তারা মানুষের স্বাভাবিক আনন্দ আর বেদনাকে আহত করছে, উৎসব আর উদযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বহুকাল আগ থেকে আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয়েছিল তাকে কবর দিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৭৫-এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাকিস্তানের পথে যাত্রা। সেটাই আজ বৃহত্তর মৌলবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিছু অশুভ বুদ্ধির মানুষ ধর্মীয় গোঁড়ামিকে কাজে লাগিয়ে মৌলবাদের হাত শক্ত করছে।

ধর্মান্ধদের সঙ্গে উদারমনা মানুষদের সংঘর্ষ যুগে যুগে চলেছে। প্রতি সম্প্রদায়ের মধ্যেই মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা স্বধর্মের গোঁড়ামিকে নিন্দা করেছেন ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা পোষণ করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী শিক্ষার্থীরা উৎসব আর আনন্দে মেতেছিল। আনন্দ একটি অতি প্রত্যাশিত বস্তু। আনন্দ মানে স্বাধীনতা, আনন্দ মানে মুক্তি। নির্মল আনন্দে নিয়মের বাঁধন থাকে না। সে ধর্মীয় অনুশাসনে ভয় করে না। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন আনন্দ হোক।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ