X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

তনু ও সাগর-রুনি: পরকালের বিচারেই ভরসা!

আমীন আল রশীদ
২৩ মার্চ ২০২২, ২১:৪৮আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২২, ২২:৩২

আমীন আল রশীদ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ যেদিন ৮৬ বারের মতো পিছিয়ে আদালত নতুন তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তার মাস খানেকের মধ্যেই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম: মেয়ে হত্যার বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তনুর মা।

সাগর-রুনি হত্যা মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের রোমানও বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার পরিবারকে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানালেও গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে কোনও যোগাযোগ করছে না। তাই তারাও বিচারের আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। এভাবে হয়তো একসময় দেশের মানুষও সাগর-রুনি ও তনুর নাম ভুলে যাবে। অন্য কোনও ইস্যু নিয়ে তারা ব্যস্ত হবে। অবশ্য এখনই তনুর নাম আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু নিহত হন। এর চার বছর আগে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙ্গার বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। কিন্তু ১০ বছরেও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী।

ঘটনার পরে মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র‌্যাবের কাছে। তারাও এই ঘটনার কোনও কূলকিনারা করতে পারছে না। প্রশ্ন হলো- কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে যে পুলিশ-ডিবি-র‌্যাব সবাই ব্যর্থ হচ্ছে এই ঘটনার জট খুলতে?

সবশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ৮৬ বারের মতো পেছানো হয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। ঢাকার মেট্রোপ‌লিটন ম্যাজিস্ট্রেট আগামী ২৭ মার্চ প্রতিবেদন দাখিলের নতুন তারিখ ধার্য করেছেন। দেশের ইতিহাসে আর কোনও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে এ রকম ৮৬ বার সময় পেছানো হয়েছে—এমন নজির নেই। আমরা জানি, আগামী ২৭ মার্চও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে না। বরং ২০২৩ সালের মধ্যেই হয়তো গণমাধ্যমের শিরোনাম হবে: শততম মাইলফলক স্পর্শ করলো সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়।

স্মরণ করতে যেতে পারে পারে, জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকও ছেলে হত্যার বিচার চাননি। তার ধারণা ছিল, এই হত্যার ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না। যদিও ঘটনার প্রায় ছয় বছর পরে এই হত্যা মামলার বিচার হয়েছে। রায়ে সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত। এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, দীপন হত্যাকাণ্ডের প্রায় কাছাকাছি সময়ে আরও কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারও বিচারের অপেক্ষায় আছে। ফলে তিনি সব হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করেন। কিন্তু আমরা জানি, সব হত্যার বিচার হয়নি। সব ভুক্তভোগী পরিবার বিচার পেলেও ন্যায়বিচার পাবে—তাও চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় না।

ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা পরিবারকে যে কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটি যারা থানা ও আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘোরেন, ঘুরেছেন এবং ঘুরছেন, তারা জানেন। আমাদের পুরো বিচার প্রক্রিয়াটিই এমন যে এখানে কারও স্বজন খুন হলে, ধর্ষণের শিকার হলে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে উল্টো তাদেরই নানাবিধ হয়রানির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পুলিশ, আইনজীবীসহ নানা লোককে পয়সা দিতে দিতে অনেককে জমিজমা বিক্রি করতে হয়। ন্যায়বিচার পেতে পেতে কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে যান। জীবনের সোনালি সময়, যৌবনের উপার্জন সবই খোয়াতে হয়। তারপর অনেকে ন্যায়বিচার পান না অথবা বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। যে কারণে তনুর মায়েরা, রুনির ভাইয়েরা রাষ্ট্রীয় বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে স্রষ্টার ওপরে বিচারের ভার তুলে দেন।

যারা ঈমান এনেছেন, তারা পরকালের বিচারে বিশ্বাস করেন। কিন্তু পরকালে বিচার হবে—এই দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র যেমন কোনও নাগরিককে সুবিচার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্রের একেবারে প্রান্তিক কোনও নাগরিকের মনে যদি এই সংশয়ের উদ্রেক হয় যে তিনি ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না বা পাবেন না—তখন সেই ব্যর্থতার গ্লানি থেকে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং বিচারের সঙ্গে যুক্ত কেউই মুক্ত থাকতে পারেন না।

একজন মা যখন বলেন যে মেয়ে হত্যার বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন; যখন একটি লোমহর্ষক হত্যার তদন্ত ১০ বছরেও শেষ হয় না এবং প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তারিখের পর তারিখ পরিবর্তন করতে করতে সেটি সেঞ্চুরির কাছাকাছি চলে যায়; যখন একজন পিতা বলেন ছেলে হত্যার বিচার চান না—তখন বুঝতে হবে, ওই রাষ্ট্র তার সব নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছরে দাঁড়িয়েও যদি নাগরিকদের মনে হয় যে যার টাকা আর রাজনীতির জোর আছে, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার কেবল তারই; যদি প্রভাবশালী কারও নির্দেশে বা ইন্ধনে কেউ খুন হন, তাহলে তার বিচারের প্রক্রিয়াটি চুইংগামের মতো কেবল লম্বা হতেই থাকবে কিংবা আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী যদি বছরের পর বছর ‘চেষ্টা’ করেও একটি চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনগণের করের পয়সায় কাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে—সেই প্রশ্নও উঠবে।

সাগর-রুনি হত্যার সময় বাসায় ছিলেন তাদের ৫ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে মাহির সারোয়ার মেঘ। মেঘের বয়স এখন ১৫ বছর। সে জানে না আদৌ তার বাবা মায়ের প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়বে কিনা এবং ন্যায়বিচার পাবে কিনা? আবার শেষমেশ ন্যায়বিচার পেলে সেটি তাকে হয়তো এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি দেবে, কিন্তু পৃথিবীর কোনও আদালত, কোনও বিজ্ঞান, কোনও প্রযুক্তিই তার বাবা মাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সুতরাং এই যে শূন্যতাবোধ—তার কোনও ক্ষতিপূরণ হয় না। তনু হত্যার বিচার হলেও তনুকে তার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি কারও নেই।

ফলে ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে প্রকৃত খুনিদের বিচার হলেও যার সন্তান মরে যায়, যার বাবা-মা মরে যায়, তার হৃদয়ের গভীরে যে শূন্যতা, যে ক্ষত—সেটি সারিয়ে তোলা যায় না। কিন্তু তারপরও অপরাধের সঠিক বিচার হওয়া প্রয়োজন সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য। অপরাধীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য এবং কেউ যদি একই ধরনের অপরাধে উদ্বুদ্ধ হয় বা জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয় তখন যাতে ওই বিচারের উদাহরণ মনে রেখে সে অপরাধ থেকে দূরে থাকতে পারে—এই কারণেই বিচার হতে হয়।

অনেক সময় ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির’ দাবি ওঠে। অর্থাৎ এমন কঠোর বিচার হওয়া দরকার যাতে মানুষ ওই শাস্তির ভয়ে তটস্থ থাকে এবং অপরাধ করতে সাহস না পায়। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েও যে রাষ্ট্রকে পুরোপুরি অপরাধমুক্ত করা যায়, তাও নয়। কারণ, খুন ও ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। অনেক বড় অপরাধীকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু দেশ থেকে খুন ধর্ষণ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। কারণ, যারা অপরাধ করে তারা কোনও না কোনোভাবে ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যেই থাকে। সেটি হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা, কিংবা অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক ক্ষমতা। ফলে তাদের মনে এই সাহস থাকে যে কোনও না কোনোভাবে তিনি প্রশ্রয় পাবেন। জেলে গেলেও ছাড়া পেয়ে যাবেন। ক্ষমতা ও অর্থের আশীর্বাদ তাদের পার পেয়ে যাওয়ার পথগুলো প্রশস্ত করে দেয়।

সুতরাং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোয় যতক্ষণ না অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ হবে, ক্ষমতায় যাওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য যতক্ষণ না রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ হবে, যতক্ষণ না ক্ষমতাবানরা নিজেদের ক্ষমতার জিয়নকাঠি হিসেবে সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীদের ওপর নির্ভরতা শূন্যে নামিয়ে আনতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত কিছু লোক বিচার পাবে, কিন্তু রাষ্ট্রের বিরাট অংশকেই বিচারের ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলতে হবে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ