X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না’

প্রভাষ আমিন
৩১ মার্চ ২০২২, ২০:০২আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২২, ২০:০২

প্রভাষ আমিন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পঞ্চম সপ্তাহ পেরিয়েছে। এরমধ্যে নানামুখী আলোচনা চলছে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। কবে বন্ধ হবে তাও কেউ জানে না। করোনার ধাক্কা সামলানোর আগেই বিশ্ব এমন একটি যুদ্ধের মুখে পড়বে, এটা আমার কল্পনায়ও ছিল না। উত্তেজনা অনেক আগে থেকেই ছিল, কিন্তু আমার ধারণা ছিল কোনও না কোনোভাবে একটা উপায় বেরুবে যুদ্ধ এড়ানোর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এড়ানো যায়নি, সেটি সভ্য পৃথিবীর জন্যই লজ্জার। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় কী ছিল, সেই বাস্তবতা এখন অপ্রাসঙ্গিক। বর্তমানে ইউক্রেন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। একটি স্বাধীন দেশে আরেক দেশের হামলার পক্ষে বলার কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অধিকারও রাশিয়ার আছে। ইউক্রেনের ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত মানে রাশিয়ার উঠানে পশ্চিমাদের উপস্থিতিকে আমন্ত্রণ জানানো। পুতিনের কাছ থেকে এতটা উদারতা যারা আশা করেছিলেন, তারা নিশ্চয়ই নিজেদের বোকামি এতদিনে টের পেয়েছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোর ভরসায় জেলেনস্কি উসকানি দিয়ে যুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এখন মাঠে নেমে দেখেন পাশে কেউ নেই। এখন আর ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। জেলেনস্কির অবস্থা দেখে আমার রফিক আজাদের একটি কবিতা মনে পড়ছে-

‘বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে!

….
বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে

ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।‘

জেলেনস্কি আসলে বুঝতে পারেননি কমেডির ভুবন আর যুদ্ধের ময়দান এক নয়। পুতিনকে প্রথম আক্রমণে বাধ্য করতে পেরেছেন, এটাই জেলেনস্কির সাফল্য।

কথায় কথায় আমরা বলি বটে, বিশ্ব এখন একটা গ্রাম। তথ্যের অবাধ প্রবাহে সবকিছু এখন সবার নখদর্পণে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। আপনি বিশ্বের কোনো যুদ্ধেরই সত্যিকার চিত্র কখনও পাবেন না। পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যম আপনার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করে দেবে। ইরাক যুদ্ধের সময় তাদের ‘এমবেডেড জার্নালিজম’ সাংবাদিকতাকেই কলঙ্কিত করেছে। আবার এখন তাদের চোখে পুতিনই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভিলেন। সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, লিবিয়া, আফগানিস্তান বা ইরাক পরিস্থিতির সময় যারা চুপ করে ছিলেন; তারাই এখন প্রবল যুদ্ধবিরোধী। ফলে যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান বা ন্যায্য অবস্থান পাওয়া কঠিনই নয় শুধু, প্রায় অসম্ভবও।

তবে যুক্তি যাই হোক, একটি স্বাধীন দেশে পুতিনের হামলার পক্ষে বলার সুযোগ নেই। আর পুতিন যেমনটা ভেবেছিলেন, হামলা করবেন আর কিয়েভ দখল করে চলে আসবেন; ব্যাপারটা তেমন সহজও নয়। ভুল জলে নামা বালকের মতো পুতিনও এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, যুদ্ধ কাকে বলে। আর এতদিন পুতিন পশ্চিমাদের জন্য একটা বড় হুমকি ছিল। কিন্তু ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার অনেক দুর্বলতা এখন সামনে চলে এসেছে। সেই বিবেচনায়ও এই যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য এক ধরনের পরাজয়ই। তবে আমি বৈশ্বিক ভারসাম্যের স্বার্থে রাশিয়ার শক্তিশালী অবস্থানের পক্ষে। ৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্য এনে দিয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যুক্তরাষ্ট্রকে দানব বানিয়ে দেয়। গোটা বিশ্বই যেন তাদের দাবা খেলার মাঠ। যখন যেখানে ইচ্ছা হামলা, দখলদারিত্ব মিলে যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্তৃত্বে চীন অনেকটা হুমকির মুখে ফেললেও সামরিক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল সর্বেসর্বা। এমনকি জাতিসংঘও যেন তাদের খেলার পুতুল। পুতিন যুগ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের সেই একচ্ছত্র আধিপত্যে বাগড়া দেওয়া শুরু করে রাশিয়া। তাতে কিছুটা হলেও ভারসাম্য ফিরে এসেছে বিশ্ব রাজনীতিতে। যুক্তরাষ্ট্র আগের মতো চাইলেই সবকিছু করতে পারে না। চীন-রাশিয়ার কথা তাকে মাথায় রাখতে হয়। সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র যে কোনোভাবে রশিয়াকে দুর্বল করতে, দুর্বল রাখতে বা অন্তত গণমাধ্যম ব্যবহার করে দুর্বলতার বাতাবরণ তৈরি করতে চায়। এবার ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রাশিয়াকে যুদ্ধে টেনে এনে সেটাই করতে চাইছে তারা। সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও মিত্রদের নিয়ে নানামুখী নিষেধাজ্ঞায় কাবু করতে চাইছে রাশিয়াকে।

তবে এই লেখা যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণের জন্য নয়। যুদ্ধ শুধু ধ্বংসই আনে, কিছুই সৃষ্টি করে না। দুই বছর আগে বিশ্বে করোনার হামলার পর আমার ধারণা ছিল, এই ধাক্কায় বুঝি বিশ্ব বদলে যাবে। সবার জীবন যখন হুমকির মুখে, সবাই তখন জীবনের জয়গানই গাইছিলেন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সবাই বেঁচে থাকলে কী কী ভালো কাজ করবেন, তার ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন। স্বাস্থ্যে কম বিনিয়োগ নিয়ে সবাই আফসোস করছিলেন। আমার ধারণা ছিল, করোনার পর বিশ্বনেতারা সামরিক বিনিয়োগ কমিয়ে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াবে। কিন্তু করোনার প্রকোপ একটু কমতে না কমতেই সবাই সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছেন। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, বিশ্বে আবার অস্ত্রের ঝনঝনানি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে সবাই আবার সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। যুদ্ধ বিশ্বের সব মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলে। তবে এই যুদ্ধও কারও কারও কপাল খুলে দিয়েছে। অল্প কিছু মানুষ অনেক সম্পদ জড়ো করছে। তবে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই কোনও না কোনোভাবে যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকরা অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দেশে ছেড়ে পালিয়েছে। পশ্চিমাদের নানামুখী নিষেধাজ্ঞা এবং যুদ্ধ বড় চাপ সৃষ্টি করেছে রাশিয়ার অর্থনীতিতে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই, এমন মানুষও যুদ্ধের শিকার হচ্ছেন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই যে বাংলাদেশে এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ে এত হাহাকার, তাতেও যুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব আছে। এমনকি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে যুদ্ধ যে ধাক্কা দিয়েছে, তার এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি।

করোনার ধাক্কা সামলাতে বিশ্ব অর্থনীতি যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন যুদ্ধের এই ধাক্কা তাকে আরও ভঙ্গুর করে তুলতে পারে। অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথটা এখন আরও বন্ধুর। দেশে-বিদেশে যেখানেই যারা নেতৃত্ব দেন; আমরা তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ নৈতিকতা, ন্যায্যতা, মানবতা, বিবেচনাবোধ, সহনশীলতা আশা করি। কোনও একটা যুদ্ধে জড়ানোর আগে তারা একবারও পৃথিবীর কোটি কোটি গরিব মানুষের কথা ভাবেন না। তারা কি বোঝেন না, যুদ্ধ মানে কোটি মানুষের সামনে থেকে খাবারের থালা কেড়ে নেওয়া। যুদ্ধবাজ নেতাদের জন্য হেলাল হাফিজের একটি এক লাইনের কবিতা দিয়ে শেষ করছি লেখাটি-

নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না।

 

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ