X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে’

প্রভাষ আমিন
২৬ মে ২০২২, ১৭:২১আপডেট : ২৬ মে ২০২২, ১৭:২১

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হয়তো নয়, তবে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আলোচিত সেতুর নাম পদ্মা সেতু। ১৯৯৭ সালে প্রাক-সমীক্ষা যাচাইয়ের মাধ্যমে যে স্বপ্নের বীজ বপন করা হয়েছিল, ঠিক ২৫ বছর পর আগামী ২৫ জুন সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। সেদিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুতে যান চলাচল উদ্বোধন করবেন। এই সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। সেই যুগ শুধু একটি সেতুর নয়; আত্মমর্যাদার, সক্ষমতার।

পদ্মা বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী। এই নদীর ওপর সেতু বানানো সহজ কাজ নয়। সব সমীক্ষা, যাচাই শেষে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি, আইডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তিও হয়। কিন্তু অর্থ ছাড়ের আগেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ আনলে দেশে-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। বাংলাদেশে কোনও প্রকল্পে দুর্নীতি হয় না, এমন দাবি কেউ করবে না। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো একটি আলোচিত প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের আগেই কীভাবে দুর্নীতি সম্ভব, তা নিয়ে সৃষ্টি হয় রহস্যময়তা। বিষয়টি আদালতেও গড়ায়। কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়, অভিযোগটি বানোয়াট। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি বিশ্বব্যাংক। তারা ঋণচুক্তি বাতিল করে। বিশ্বব্যাংকের পথ ধরে বাকি দাতারাও ঋণচুক্তি বাতিল করে। তখন সবাই ধরে নিয়েছিল পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না। দেশে-বিদেশে সরকারের সমালোচকরা তো বটেই, এমনকি সরকারের ভেতরের অনেকেও মনে করেছেন পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না। কিন্তু একজনের মনে ছিল অন্য কথা। তিনি শেখ হাসিনা। সবার সব সমালোচনা, সংশয়কে পেছনে ফেলে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেদের অর্থে বানানো হবে পদ্মা সেতু। তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনেকেই বাঁকা হাসি হেসেছিলেন। ভেবেছিলেন, এটা সম্ভব নয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন কাভার করে ঢাকা ফিরে আমি বাংলা ট্রিবিউনে লিখেছিলাম, ‘পদ্মা সেতু: শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমির প্রতীক’। আসলেই আমি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার সব সংশয় পাশে ঢেলে গোঁয়ারের মতো এগিয়ে না গেলে পদ্মা সেতু আমরা পেতাম না, পেলেও আরও কয়েক দশক সময় লাগতো। আমি মনে করি, এমন দেশপ্রেমিক গোঁয়ার দেশের জন্য আরও বেশি করে দরকার। শেখ হাসিনার এই একটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকেই অন্যমাত্রায় উন্নীত করেছে।

বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পও বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বে বাংলাদেশ চিহ্নিত হতে পারতো দুর্নীতিবাজ হিসেবে। কিন্তু নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানানোর সিদ্ধান্তে শেখ হাসিনা গোটা জাতির মাথা উঁচু করেছেন, আমাদের গর্বিত করেছেন। আমরাও পারি, এই বিশ্বাস সঞ্চারিত হয়েছে গোটা জাতির মধ্যে। বঙ্গবন্ধু ৭১ সালের ৭ মার্চ বলেছিলেন, ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’। শেখ হাসিনা সেটা কাজে প্রমাণ করলেন। বাংলাদেশকে দাবায়া রাখা গেলো না।

নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানানোর কাজটাও সহজ ছিল না। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তো ছিলই, ছিল অর্থনীতিবিদদের নানামুখী শঙ্কা, রাজনীতিবিদদের ঠাট্টা-মশকরা। নানা সময়ে নানা গুজবে চেষ্টা হয়েছে পদ্মা সেতুকে কলঙ্কিত করার। ‘পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে’ এমন গুজবে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ছেলেধরা আতঙ্কে পিটিয়ে মানুষ মারার ঘটনাও ঘটেছে। হলি আর্টিজান, কোভিড-১৯-এ বারবার পদ্মা সেতুর কাজ থমকে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দেশপ্রেমিক গোঁয়ার শেখ হাসিনাকে আটকে রাখা যায়নি। গাড়িতে পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সব কাজ শেষ করে যখন সেতুর টোল হার ঘোষণা করা হলো, আরেক দফা সমালোচনার ঝড় উঠলো। নিজেদের টাকায় নির্মাণ হলে টোল লাগবে কেন, লাগলেও এত টাকা লাগবে কেন, ইত্যাদি প্রশ্নে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উত্তাল। সবাই ফেরি ভাড়ার সঙ্গে টোল হারের তুলনা করছিলেন। টোল আরও কম হলে ভালো হতো, কিন্তু নিজেদের টাকায় বানানো সেতুর খরচ তো টোল থেকেই তুলতে হবে। কেউই কিন্তু ফেরির খরচের সঙ্গে সময় আর ভোগান্তির কথাটি উল্লেখ করেননি। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত করবে। এই ১৯টি জেলার মানুষকে আপনি জিজ্ঞাসা করে দেখুন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি ঘাটে যানজটে আটকে থাকার দুঃসহ অভিজ্ঞতার অর্থমূল্য কত। কত কাঁচামাল ট্রাকে পচেছে, তার অর্থমূল্য জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবেন সেই ব্যবসায়ীর কাছে। সময়েরও যে একটা অর্থমূল্য আছে, সেটা আমরা বিবেচনায়ই নেই না। ঘুরতে যাওয়া ছাড়া পদ্মা সেতুর সঙ্গে আমার সরাসরি কোনও সংযোগ নেই। কিন্তু পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনীতিতে যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে, তার সুফল তো আমিও পাবো।

পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনৈতিক জলও কম ঘোলা হয়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু থেকে ‘টুস’ করে ফেলে দিতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে এই নিষ্ঠুর রসিকতা আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু এই পদ্মা সেতু করতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে যে কত নিষ্ঠুর সমালোচনা সইতে হয়েছে তার খবর আমরা কজন জানি। সব বিষ হজম করে নীলকণ্ঠ হয়েছেন তিনি। এখন সুযোগ পেয়ে তার কিছুটা জবাব দিলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।

তারপরও আমি মনে করি, এই নিষ্ঠুর রসিকতাটা তিনি না করলে ভালো হতো। এত কিছু সয়েছেন, বেগম খালেদা জিয়ার ‘জোড়াতালি দিয়ে সেতু বানানোর’ অভিযোগটাও মেনে নিলেই পারতেন। দেশের মানুষ তো দেখছেন খালেদা জিয়ার ভাষায় ‘জোড়াতালি’ দিয়ে বানানো সেতুই বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক। আমার প্রস্তাব হলো, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেন পদ্মা সেতুর সব সমালোচককে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সাফল্যের চেয়ে বড় কোনও প্রতিশোধ নেই।

পদ্মা সেতুর নামকরণ নিয়েও পদ্মার পানি অনেক ঘোলা হয়েছে। সরকারের স্তাবকরা সেতুর নাম শেখ হাসিনা বা জয়বাংলা করার দাবি তুলেছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে সেতুর যে ফাইল গিয়েছিল, তাতেও প্রস্তাবিত নাম ছিল ‘শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু’। বাংলাদেশে যে স্টাইলে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করা হয়, তাতে পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সে ফাইলে স্বাক্ষর করেননি। তার মানে আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাওয়া সেতুর নাম ‘পদ্মা সেতু’ই। নাম যাই হোক, সেতুটি যতদিন থাকবে, ততদিন শেখ হাসিনাকে মানুষ স্মরণ করবে। পদ্মা সেতুর নামফলকে না থাকলেও শেখ হাসিনার নাম থাকবে মানুষের হৃদয়ে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ