X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিন বেলা মাংস নয়, তিন বেলা পেট ভরে খাবার স্বপ্ন

ডা. জাহেদ উর রহমান
৩০ মে ২০২২, ২০:৩০আপডেট : ৩০ মে ২০২২, ২০:৩০
‘এখন রিকশাওয়ালাও মোটা চাল খায় না, মোটা চাল এখন গরুকে খাওয়ানো হয়। বাংলাদেশে এখন আর কুঁড়েঘর নেই, কুঁড়েঘর শুধু কবিতায় আছে। আজ সেই কুঁড়েঘর লাকড়ি, গরু রাখা হয়, কিন্তু মানুষ থাকে না।’ বক্তব্যটি একজন মন্ত্রীর, বলেছিলেন এই জানুয়ারি মাসেই। কথাগুলো তিনি বলছিলেন এমন সময়, যখন ঢাকায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে আর কম দামে ‘মোটা চাল’ বিক্রির ওএমএস-এর দোকানের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি আরও দীর্ঘ হয়ে উঠছে।

করোনার সময় মানুষের অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছে সেই হিসাব সরকার নিজে করেনি। দুই বছরের বেশি সময়ে করোনার অভিঘাতে নতুন করে কত মানুষ দরিদ্র হয়েছে কিংবা অন্য মানুষদের আর্থিক সংকটের স্বরূপটাই বা কী, এসব খতিয়ে দেখতে একটি জরিপও করেনি কোনও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে ডাটার কারসাজি করে সরকার, নিশ্চয়ই করতো এই ক্ষেত্রেও। কিন্তু একটা জরিপ পরিচালনা করতে না চাওয়া প্রমাণ করে সরকার মানুষকে ‘আইওয়াশ’ দেওয়ার দায়ও আর বোধ করে না।

অবশ্য আমরা করোনার সময়ের দারিদ্র্য নিয়ে তথ্য পেয়েছি। সানেম এবং ব্র্যাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের স্বতন্ত্র গবেষণা থেকে আমরা জানি, এই সময়ে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। আলোচিত প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে বিএনপি কিংবা অন্য কোনও সরকারবিরোধী মহলের যোগসাজশের কথা কোনোভাবেই জানা যায় না, কিন্তু তবু সরকার স্বীকার করেনি এই তথ্য।

তবে একটা দেশের মানুষরা কেমন আছে, তার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন, সেটার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাবেই। যতই উন্নয়নের প্রপাগান্ডা চালানো হোক না কেন, সেটায় যে বড় অসত্য তথ্য আছে সেটা আমরা বুঝি নানাভাবে। আবার রাষ্ট্রের উৎপাদন (জিডিপি) যতটুকু বাড়ে সেটা যে সুষমভাবে বণ্টিত হয় না, সেটার প্রমাণও আমরা দেখি চারদিকে।

এই দেশের অসাম্যের এক জাজ্বল্যমান প্রমাণ সাম্প্রতিককালের টিসিবির ট্রাকের লাইন। টিসিবির ট্রাক থেকে কয়েকটি পণ্যের একটি প্যাকেজ কিনতে পারলে মানুষ ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বাঁচাতে পারতো। এই ‘সামান্য কিছু’ টাকা বাঁচানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়েছিল মানুষ। পত্রিকার রিপোর্টে আমরা দেখেছি, সেই লাইনে ৭ বছরের শিশু, অন্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধী কিংবা অশীতিপর বৃদ্ধসহ ছিল সবাই। একদিন দাঁড়িয়ে পণ্য শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে পরদিন আবার সেই মানুষ ফিরে এসেছেন পণ্য নিতে, এমন ঘটনার নজির অনেক। ‘উন্নয়ন’ এর বয়ানের সামনে ভীষণ দৃষ্টিকটু ট্রাকগুলো এই মুহূর্তে আর রাস্তায় নেই। থাকলে সেই ট্রাকের লাইন এখন কোথায় যেত? এখনকার পরিস্থিতি কি আরও ভয়ংকর নয়?

করোনার সংকট থেকে যখন পৃথিবী বেরিয়ে আসছিল একটু একটু করে, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিটাকে নিয়ে গেলো ভীষণ খারাপ পর্যায়ে। এই যুদ্ধ বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় দেশই বৈশ্বিক খাদ্যশস্য, বিশেষ করে গম এবং ভুট্টা রফতানিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে।

সারা বিশ্বে রাতারাতি বেড়ে গেছে গমের দাম। বৈশ্বিক বাজারে বৃদ্ধির সেই পণ্য দেশে আমদানি হতে অন্তত দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে। তাই বর্ধিত মূল্যের প্রভাব দেশে পড়ার কথা ওই সময় পরে। কিন্তু কে না জানে, বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়ার মুহূর্তেই যেকোনও পণ্যের দাম বেড়ে যায় এই দেশে। আবার দেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি নিশ্চিতভাবেই হয় বৈশ্বিক বাজারে বৃদ্ধির চাইতে অনেক বেশি। সম্প্রতি সয়াবিন তেল নিয়ে অতীতের মতো একই কাণ্ড দেখেছি আমরা।

গমের এই মূল্যবৃদ্ধি নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য বড় সংকট তৈরি করেছে। ‘ভেতো বাঙালি’ এখন আর অতটা ভেতো নয়। বাংলাদেশে এখন বার্ষিক গমের চাহিদা এক কোটি টনের মতো, অর্থাৎ চালের এক-তৃতীয়াংশ। এটা শুধু এ কারণে হয়নি যে সামর্থ্যবানদের পিৎজা, পাস্তা, নুডলস আর বার্গারের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ গম, এটা বরং এই কারণে হয়েছে যে দেশের অভাবী মানুষের অতি গুরুত্বপূর্ণ খাবার তৈরিতে এখন গম জরুরি।

দেশের শ্রমজীবী মানুষ কাজের ফাঁকে কলা কিংবা চা দিয়ে বান খাচ্ছে বহুদিন হয়ে গেলো।

ওদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমাগত মূল্য হারানো আমদানিকৃত পণ্য এবং অন্য তৈরির উপকরণ সবকিছুর মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক প্রায় সবকিছুই আমদানি নির্ভর। মানুষ তার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কিনে কোনোরকমে টিকে থাকতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। এরমধ্যেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব পত্রিকায় মানুষের খেয়ে বেঁচে থাকার কষ্টের গল্প উঠে আসছে।

এমন পরিস্থিতিতেই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর একটি মন্তব্য নিয়ে তীব্র ক্ষোভ দেখা গেছে সামাজিক মাধ্যমে। একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন– ‘আগে মানুষেরা প্রতি সপ্তাহেও না, মাসে একবার মাংস খেতো। তাও ছোট্ট একটা টুকরা মাংস খেতো গ্রামগঞ্জে। আজকে অধিকাংশ পরিবার, সে হাঁসের হোক, মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, নিয়মিত মাংস খাচ্ছে। এই যে মাংস খাওয়ার সুযোগটা সেটা সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে... দেশের বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এখন মানুষ চাইলে তিন বেলাও মাংস খেতে পারে’।

ভীষণ সংকটে থাকা মানুষের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা দূরে থাকুক, এই দেশের আকাশে ‘উড়ন্ত’ মন্ত্রীরা চুপও থাকছেন না। তারা মানুষকে নিয়ে যাচ্ছেতাই উপহাস করে বেড়ান। সেই তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন একের পর এক মন্ত্রী।

উল্লিখিত মন্ত্রী গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁসের মাংসের কথা বলেছেন। এই দেশে বসবাসকারী মানুষ মাত্রই জানেন এসব মাংসের বাজার মূল্য কত। বেশ অনেক দিন হয়ে গেলো এগুলোর যে কোনোটির মাংস নিয়মিত খেতে হলে কাউকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত থেকে ধনী হতে হবে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও এসব মাংস নিয়মিত খাবার কথা ভাবে না। গত কয়েক বছরে একমাত্র ব্রয়লার (প্রচলিত কোথায় ‘ফার্মের’) মুরগির মাংস আর্থিকভাবে কম সামর্থ্যবানদের নাগালের মধ্যে ছিল। কালেভদ্রে সেটা খেতে পারতেন তারা।

বেশ কিছু দিন হলো ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে, সাথে বেড়েছে অত্যাবশ্যক সব ভোগ্যপণ্যের দাম। ভোজ্যতেলের দাম তো এই দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে আছে কয়েক মাস ধরেই। বেড়েছে আটা এবং আটা দিয়ে তৈরি করা খাবারের দাম। এবং বাড়ছে এই ভরা বোরো মৌসুমে ধানের দাম। আর মূল্যস্ফীতির কারণে দাম বাড়ছে প্রতিটি অত্যাবশ্যক পণ্যের। সর্বোপরি করোনার সময়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের বেশিরভাগ এখনও তার আগের উপার্জনে ফিরে যেতে পারেনি। যেসব মানুষ একসময় ব্রয়লার মুরগির মাংস কালেভদ্রে খেতে পারতেন, সেই পরিস্থিতিও এখন নেই আর।

এই দেশের মন্ত্রীদের চোখে পড়ার কথা নয়, কারণ তাদের চোখ এসব খবর খোঁজে না, কিন্তু আমাদের চোখে পড়ে মানুষ কীভাবে খাবার খাওয়া কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। যারা মাসে মাঝে মাঝে মাছ খেতেন সেই মাছের টুকরা ছোট/পাতলা হয়েছে, মাংসের টুকরো ছোট হয়েছে, মাছ-মাংস কমে আলুভর্তা আর ডিমের পরিমাণ বেড়েছে। আর রিকশাচালকসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ, যারা দিনের একটা সময়ে কলা আর চা দিয়ে বনরুটি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতেন, তাদের বনরুটির আকার ছোট হয়েছে, এমনকি তিনটির জায়গায় দু’টি কিংবা দু’টির জায়গায় একটি বনরুটি খাচ্ছেন অনেকেই।

কয়েক দিন আগেই শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে জীবন মিয়ার গল্প। মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে ফুটপাতের একটি হোটেলে বসে ভাত খাচ্ছিলেন জীবন মিয়া (৪০)। তার প্লেটে ভাত, আলুভর্তা আর একটি কাঁচামরিচ। ভাতের সঙ্গে আর কিছু নেবেন কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আর কী লমু কন? আগে দুই প্লেট ভাত, ডাল আর ভর্তার প্যাকেজ খাইতাম ৩০ টাকা দিয়া। ঈদের পর থাইকা ৪০ টাকা লয়। রিকশার জমার টাকাও ২০ টাকা বাড়াইছে। সবকিছু বাড়ছে, কিন্তু ইনকাম তো বাড়ে নাই। আগে ৩ বেলা খাইতাম এখন ২ বেলা খাই।’ স্ত্রী ও ৩ সন্তান নিয়ে থাকেন রাজধানীর কমলাপুরে বাস করা জীবন মিয়া পরিবারের অন্যান্য খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে খেতে কমিয়ে দিয়েছেন নিজের খাওয়াই।

জীবন মিয়ার গল্প সরকারের কোনও দায়িত্বশীলকে জিজ্ঞেস করলে তিনি সম্ভবত বলবেন, এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু আমরা যারা বাস্তবতা ভুলিয়ে দেওয়া ক্ষমতার ওই চেয়ারগুলোতে বসে নেই, তারা জানি আমাদের চারপাশে পড়ে আছে এসব জীবন মিয়া এবং তার চাইতেও অনেক বেশি খারাপ থাকা মানুষদের দিয়ে। তিন বেলা মাংস নয়, নিজে আর পরিবারের সদস্যরা তিন বেলা স্রেফ পেট পুরে খেতে পারলেই বর্তে যায় বর্তমান বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ, সেই স্বপ্নই এখন দেখে তারা।
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ