X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচন কমিশনারদের নামই পাল্টায় কেবল, কমিশনের চরিত্র নয়

রুমিন ফারহানা
০৪ জুন ২০২২, ২১:১৬আপডেট : ০৪ জুন ২০২২, ২১:১৬

নবগঠিত নির্বাচন কমিশন থেকে সম্প্রতি আসা একটি বিস্ফোরক মন্তব্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেছেন, “ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ‘সন্ত্রাসী ও ডাকাতদের’ উপস্থিতিই বড় চ্যালেঞ্জ।”

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খানের দৃষ্টিতে, “ইভিএমে চ্যালেঞ্জ একটাই। আর কোনও চ্যালেঞ্জ আমি দেখি না। সেটা হচ্ছে– ‘ওই গোপন কক্ষে ডাকাত-সন্ত্রাসী একজনের দাঁড়িয়ে থাকা, যে বলতে পারে, ‘আপনার ভোট হয়ে গেছে, চলে যান।’ দিস ইজ দ্য চ্যালেঞ্জ।”

‘ডাকাত’ কারা তা এই নির্বাচন কমিশনার পরিষ্কার না করলেও গত কয়েক বছরের জাতীয় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত নির্বাচনের দিকে তাকালেই ‘ডাকাত’দের চেহারা স্পষ্ট হয়ে যায়।

কিছুদিন আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রচারণায় এমন এক ‘ডাকাত’-এর দেখা মিলেছে। তার নাম মুজিবুল হক। তিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান। কথা শুনে মনে হলো স্পষ্টভাষী মানুষ। যা বলেন সরাসরি বলেন, যা করার তা করতেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে সময় নষ্ট করেন না। চাম্বাল ইউনিয়নের বাংলাবাজার ১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচনি প্রচারণায় গিয়ে তিনি বলেন, “রিকশায় করে পারেন আর যেভাবে পারেন, কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে হবে। এর কারণ ‘ইভিএম’ পদ্ধতিতে ভোট হবে। ইভিএম না হলে সব আমিই মেরে দিতাম, কাউকে খুঁজতাম না। কথা বোঝেন নাই? ইভিএমে আইডি কার্ড না ঢুকালে কাজ হয় না। তা না হলে আমি রাতেই ভোট নিয়ে নিতাম। তাই আপনাদের কষ্ট করে সেটা (জাতীয় পরিচয়পত্র) নিয়ে কেন্দ্রে যেতে হবে। মেশিনে ফিঙ্গার দিতে হবে। আপনারা কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাবেন। আঙুলের ছাপ মেরে ভোট দেবেন। ছাপ দিতে না পারলে সেখানে আমি ছাপ দেওয়ার মানুষ রাখবো। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।”

ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুল হক আরও বলেন, ‘আমি তো প্লেয়ার। একবারেই ২০ হাজার নিয়ে ফেলি। সরকার ইভিএম পদ্ধতি রাখছে, কী করবো?’

জনপ্রতিনিধি তিনি, সুতরাং মানুষের কষ্ট লাঘবে কাজ করাটাই স্বাভাবিক। তাই হয়তো বলেছেন, ভোটারদের আঙুলের ছাপ দিতে কষ্ট হলে সেই ছাপ দেওয়ার জন্যও মানুষ রাখবেন। সেই মানুষ ঠিক কোন বাটনে চাপ দেবেন সেটাও নিশ্চয়ই তিনি বুঝিয়ে দেবেন। ইভিএমে ভোট হওয়ার কারণে হালকা সমস্যায় পড়ার কথাও খোলাসা করতে দ্বিধা করেননি। ইভিএম না থাকলে ভোট দেওয়ার জন্য কাউকে আর খুঁজতে হতো না তাকে। তিনি নিজেই ভোটটা মেরে দিতেন, রাতেই ভোট নিয়ে নিতেন প্রয়োজনমতো।

এমন স্বাবলম্বী প্রার্থীতে ভরা এখন দেশ। নির্বাচনি প্রচারে দেওয়া প্রকাশ্য এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মূলধারার সব গণমাধ্যমে উঠে আসার পরও এই ‘ডাকাত’-এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। সম্ভবত যাচ্ছেতাই বলে পার পাওয়াই আরও বেশি সাহসী করে তুলেছে ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুল হককে। এরপর তিনি বলেছেন, ‌‌‘ভোট সুষ্ঠু করি আমরা, অসুষ্ঠুও করি আমরা। আমরা বললে সুষ্ঠু, না বললে অসুষ্ঠু। যেদিকে চাই সেদিকে…।’

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ‘এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই মুজিবুল হক বক্তব্যটি দিয়েছেন। তবে কবে দিয়েছেন তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দুই-তিন দিনের মধ্যে দিয়েছেন। এ বিষয়েও ইসিকে জানানো হবে।’

নতুন কমিশনের ওপর যারা আস্থা-বিশ্বাস রাখতে চান, যারা মনে করেন এই কমিশন নিয়ে মন্তব্য করার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে কমিশনের ভূমিকা দেখা জরুরি; তাদের আমার সবসময়ই হয় অবাস্তব রকম আশাবাদী, না হয় সব জেনেশুনে চোখ বুজে থাকা মানুষ মনে হয়। অবশ্য গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনের যে প্যাটার্ন আমরা দেখেছি তাতে প্রথমটি নয়, বরং পরেরটি হওয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত।

এমন বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ‘সরকারি গুন্ডার’ ভয় দেখালেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরকারি দল মনোনীত আরও একজন চেয়ারম্যান প্রার্থী। যা-তা বলে, ভয়ভীতি দেখিয়ে যদি বহাল তবিয়তে থাকা যায় তাহলে আর যা-তা বলতে বাধা কোথায়।

নির্বাচনি সভার বক্তব্যে সেই চেয়ারম্যান প্রার্থী বলেন, ‘আমি সরকারি দলের লোক, আমার তো সরকারি গুন্ডা আছে। আছে না? লাইসেন্সধারী। এরা কি এনাদের (প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী) কাজ করবে, নাকি আমি নির্দেশ দিলে আমার কাজ করবে?’ সরকারি গুন্ডা এবং লাইসেন্সধারী বলতে তিনি ঠিক কাদের বুঝিয়েছেন সেটা কারও না বোঝার কথা নয়। ‘গুন্ডা বাহিনীর’ মধ্যে আছে পুলিশ প্রশাসনসহ প্রজাতন্ত্রের সেইসব কর্মকর্তা-কর্মচারী, যারা সরকারি দলের প্রার্থী জেতাতে যেকোনও কিছু করতে প্রস্তুত।

সরকারি দলের এই দুই প্রার্থীর বক্তব্য খুব নতুন কিছু আমাদের সামনে তুলে ধরেছে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখে আমরা যৌক্তিকভাবে অনুমান করতেই পারি– সরকারি দলের অসংখ্য প্রার্থী এমন কথা প্রায়ই বলেন যেগুলো আমাদের সামনে আসে না। তারপরও এই দুই জনের কথা যেভাবে আমাদের সামনে চলে এলো তাতে তাদের স্বরূপ যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তাতে সরকারি দলের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকারি দল অন্যান্য সময় যেরকম বলে– ‘এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, এবারও সেটা বললেও দলের মান বাঁচাতে তাদেরই প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি।

এ ধরনের বক্তব্য সরকারি দলের প্রার্থীদের কাছ থেকে নতুন কিছু নয়। অতীতেও স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচনগুলোতে এ ধরনের বক্তব্য সরকারি দলের প্রার্থী কেবল নয়, এমনকি দলের উচ্চপর্যায়ের পদধারী নেতাদেরও দিতে শুনেছি আমরা। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, এমনকি কমিশন কাউকে সতর্ক করেছে বলেও শোনা যায়নি। রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষ দল নির্বাচন বর্জন করায় এখন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ।

তারপরও যে ভাষায় নির্বাচনি প্রচারণা চলছে এবং চলেছে শুনলে তাজ্জব হতে হয়। এই যেমন হুদা কমিশনের অধীনে অল্প কিছুদিন আগে হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমরা দেখলাম প্রার্থীরা বলছে– ‘আমরা শুধু হুমাইপুরের জনগণের শক্তি নিয়ে ওইদিন আসবো না। শুধু একে-৪৭ নয়, প্রয়োজনে যা করা দরকার সবই করবো’ কিংবা ‘যারা নৌকায় ভোট দেবেন না তাদের চিহ্নিত করা হবে। সোজা কথা, আমার কবরস্থানে তাদের কবর দিতে দেওয়া হবে না। এমনকি তাদের মসজিদেও নামাজ পড়তে দেওয়া হবে না।’

কেউ বলেছেন, ‘সরকার কার?... ভোট জোর করে নিতে পারলে, নৌকা মার্কার সরকার পারবে। চেয়ার মার্কা, কলসি মার্কার পক্ষে তা মোটেও সম্ভব না। সরকারি গুন্ডারা কার? পুলিশ সরকারি গুন্ডা, তারা (পুলিশ) হচ্ছে নৌকা মার্কার লোক। ভোট নিলে নৌকা মার্কার লোকজন নিতে পারবে, পিটিয়ে পিটিয়ে।’

কী চমৎকার প্রচারণা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে মূলধারার গণমাধ্যমে এসেছে এই প্রতিটি খবর। কিন্তু তাদের কারও বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে তো বাদই দিলাম, এমনকি কমিশনের তরফে ন্যূনতম কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।

এক কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়, এরপর আসে নতুন কমিশন। গত কয়েক বছরে রকিব কমিশন, হুদা কমিশন পেরিয়ে এখন আছে আউয়াল কমিশন। কমিশনাররা বদলে যান, বদলে যায় তাদের মুখ; কেবল বদলায় না কমিশনের চরিত্র। আসলে নির্বাচন কমিশন তো দেশের বাইরের কোনও বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের আর সব প্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, নির্বাচন কমিশনের অবস্থা তা থেকে ভিন্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার কখনোই চায় না কোনও প্রতিষ্ঠান স্বাধীন সত্তা নিয়ে মাথা উঁচু করে টিকে থাকুক। তাই সরকারের আজ্ঞাবহ কমিশনের কমিশনারদের নামই পাল্টায় কেবল, চরিত্র নয়।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

 

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
‘মডার্ন মেট্রোপলিস’ থিমে ঈদ সংগ্রহ এনেছে ঢেউ
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
কাপাসিয়ায় গরু চোর সন্দেহে ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
বহুতল ভবনের সংজ্ঞাফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ