X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল কলঙ্ক!

রেজানুর রহমান
২৮ জুন ২০২২, ১৫:৩৫আপডেট : ২৮ জুন ২০২২, ১৬:২৪

একটা কথা বেশ প্রচলিত। স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা বেশ কঠিন। বেশ যুক্তিযুক্ত কথা। আমাদের গর্বের পদ্মা সেতুর কথাই ধরা যাক। কত ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের ফসল এই সেতুটি এ কথা সবারই জানা। অথচ সেতু উদ্বোধনের দিনই অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে সেতু দিয়ে পারাপারের প্রথম দিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। একজনের নাম আলমগীর হোসেন, অন্যজনের নাম ফজলু। দুজনই ঢাকার অদূরে দোহার এলাকার বাসিন্দা। আলমগীর মোটরসাইকেল মেরামতের কাজ করতেন। আর ফজলু বিদেশে থাকেন। এক মাস আগে তিনি দেশে এসেছিলেন। ছয় বন্ধু তিনটি মোটরসাইকেলে করে পদ্মা সেতু দেখতে এসেছিলেন। বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন তারা। কাজেই যা হওয়ার তাই হয়েছে। অনেকে হয়তো সেই কথাটিই বলবেন– জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সব সৃষ্টিকর্তার হাতে। দুই তরুণের মৃত্যু এভাবেই হবে সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই তা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। অনেকটা একসময়ের একজন মন্ত্রীর বচনের মতো– আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে... কিন্তু আমরা কি এসব ভেবেই দায়-দায়িত্ব শেষ করতে পারি?

এই যে দেশের একটি শ্রেষ্ঠ আনন্দের দিনে দুই তরুণের মৃত্যু হলো। এর দায় কার? সেতু কর্তৃপক্ষের নাকি ব্যক্তির? কেউ কেউ হয়তো সরকারের ওপরও দায় চাপাবেন। মহা এই আনন্দের দিনেই এক তরুণকে দেখলাম পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খুলে অন্যকে দেখাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার এই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। তাকে দেখে মনে হলো পদ্মা সেতুর ত্রুটি খোঁজার জন্যই সে সেখানে গিয়েছিল। তার কথাতেই বিষয়টি স্পষ্ট। পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খুলতে খুলতে সে ভিডিওতে বক্তব্য দিচ্ছে– এই যে দেখেন গর্বের পদ্মা সেতুর অবস্থা। এখনই নাট-বল্টু খুলে যাচ্ছে...।

প্রশ্ন হলো– ওই তরুণ পদ্মা সেতু দেখতে গিয়ে নাট বল্টু খুলছে কেন? এত বড় একটি স্থাপনায় কেউ একজন নাট-বল্টু খুলে অন্যকে দেখাচ্ছে। এই সময় সেতু কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন কোথায় ছিলেন? যদিও পরে এই তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায়, ওই তরুণ পদ্মা সেতুতে উঠে যখন নাট-বল্টু খুলছিল এবং ওই সময় কেউ একজন তার ভিডিও করছিল, তখন কোথায় ছিলেন সেতু কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন? তরুণটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এটা তো রোগী মরিবার পর ডাক্তার আসার মতো অবস্থা হয়ে গেলো না? এখানেও আসে স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নটি। জানা কথা, পৃথিবীর বিস্ময় পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন দেশের মানুষের ঢল নামবে। দেশের টাকায় এত বড় একটা অর্জন। কাজেই তা দেখার জন্য প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসবে মানুষ। কিন্তু তারা যাতে বিপদে না পড়ে সে দিকটি দেখাও তো কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কর্তৃপক্ষ হয়তো যুক্তি দেখাবেন। বলবেন, পদ্মা সেতু বাঙালির প্রচণ্ড আবেগের জায়গা। কাজেই মানুষের বেপরোয়া গতি থামাব কী করে? হ্যাঁ, এটাই বড় প্রশ্ন। আবেগ যখন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন কার কী করার আছে বা থাকে?

পদ্মা সেতুতে প্রথম দিনেই দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন অথবা প্রশ্ন তুলবেন– কাজটা কি ঠিক হলো! মাথায় ব্যথা হচ্ছে। ওষুধ খাওয়ালেই মাথার ব্যথা সেরে যাওয়ার কথা। অথচ ওষুধ না খাইয়ে মাথা কেটে ফেলা হলো। এটা কতটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত? এ নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু আমি মনে করি কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক এই সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। পদ্মা সেতুতে যাবার সৌভাগ্য এখনও হয়নি। টিভিতে সেতু উদ্বোধনের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো প্রত্যক্ষ করেছি। এক-একটি মুহূর্তকে জীবনের সেরা মুহূর্ত মনে হয়েছে। পদ্মা সেতুর রূপকার আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে বেশি আনন্দ পেয়েছি। এমন আনন্দের সময়ই পদ্মা সেতুতে দুর্ঘটনার খবর শুনবো, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সেতুতে টোল দিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালানোর যে প্রতিযোগিতা দেখেছি তাতে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। এই যে এত বেপরোয়া গতিতে সবাই মোটরসাইকেল, ট্রাক, গাড়ি চালাচ্ছেন মানুষ, দুর্ঘটনা ঘটবে না তো? আশঙ্কাই সত্যি হলো। বেপরোয়া গতিই মোটরসাইকেলের দুই আরোহীর প্রাণ কেড়ে নিলো। কাজেই আপাতত সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ হওয়া দরকার। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক বলে আমার মনে হচ্ছে।

যারা মোটরসাইকেল চালান তারা হয়তো এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হবেন অথবা হয়েছেন। এ কথা তো সত্য, অনেকেই ভেবেছেন পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবার নিজের বাড়ি থেকেই ঢাকায় গিয়ে অফিস করতে পারবেন। ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারবেন। এজন্য কেউ কেউ মোটরসাইকেল কিনেও ফেলেছেন। সেতু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত শুনে তারা হয়তো হতাশ হয়েছেন। কিন্তু তাদের উদ্দেশে একটি বিনীত প্রশ্ন। জীবন আগে না গতি আগে? একটি সড়ক দুর্ঘটনা একটি পরিবারের কান্না। এই স্লোগানটি ব্যাপক পরিচিত। অথচ আমরা এ ব্যাপারে মোটেই সচেতন নই। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও মরণ নেশায় বুদ হয়ে যাই। বিভিন্ন টেলিভিশনের খবরে, বিশেষ প্রতিবেদনে দেখলাম শুধু মোটরসাইকেল নয়, বাস ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহনও টোল দেওয়ার পরপরই এমন বেপরোয়া গতিতে নিজেদের বাহন চালিয়ে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করেন, তা সত্যি ভয়ংকর। মোটরসাইকেল চালক তো হাওয়ায় ভেসে ছুটতে চান। ঢাকার রাস্তায়ও এমন বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চলে। আইনের প্রতি কারও শ্রদ্ধাবোধ নাই। বরং আইন না মানার ব্যাপারেই সবার গভীর আগ্রহ। যদি দেখে রাস্তায় ট্রাফিক নাই তাহলে কি যে খুশি হয়। যেন আইন ভঙ্গ করাই জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ।

শুরুতেই যে কথাটি বলেছি আবার তা উল্লেখ করতে চাই। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা আরও কঠিন। এজন্য কঠোর আইনের প্রয়োগ দরকার। কে কী ভাবলো সে ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও সেতুর ওপর দিয়ে যান বাহন চলাচলের কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করা দরকার। সেতু ওপর দিয়ে যান চলাচলের ক্ষেত্রে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি কত হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি। যানবাহন থামিয়ে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলার উদ্যোগ থামানো দরকার। সিসি টিভির মাধ্যমে সেতুর টোটাল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের আধুনিক উদ্যোগ জরুরি। কোনও গাড়ি তার নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করলেই জরিমানার অর্থ দিতে বাধ্য হবেন, এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। সবচেয়ে যেটা জরুরি তা হলো দায়-দায়িত্ব রক্ষা। দেশের এই শ্রেষ্ঠ অর্জন রক্ষায় যেমন সরকারের অর্থাৎ সেতু কর্তৃপক্ষের দায়-দায়িত্ব আছে তেমনি দায়-দায়িত্ব আছে যারা প্রতিদিন সেতুটি দিয়ে পারাপার হবেন তাদেরও। এখানেই স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করার বিষয়টিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট সকলেই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাববেন এটাই বিনীত অনুরোধ। আপাতদৃষ্টিতে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল পারাপার বন্ধ থাকতেই পারে। কিন্তু এই বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে, দোষ তো মোটরসাইকেলের না। দোষ চালক ও আরোহীর। কাজেই তারাই ভাবুক জীবন আগে না গতি আগে।

সবার জন্য শুভ কামনা রইলো।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ