X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাশ্রয়ের হাহাকার এবং ‘লাখ টাকা’র আইসক্রিম

প্রভাষ আমিন
২১ জুলাই ২০২২, ১৮:৫৯আপডেট : ২১ জুলাই ২০২২, ১৮:৫৯

ফেসবুকের সব কথা আমি বিশ্বাস করি না। আসলে প্রথমে কোনও কথাই বিশ্বাস করি না। ফেসবুকে পাওয়া তথ্য সাংবাদিকতার মানদণ্ডে যাচাই করি, তারপর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন। ফেসবুকে নানান ইস্যু ফটোশপ করে এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় জানি, ফেসবুককে বিশ্বাস করার মতো বোকামি আর হয় না। তবু ফেসবুক থেকে পাওয়া একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শুরু করছি। ভারতের এক ধনকুবের গেছেন জার্মানিতে বেড়াতে। সেখানে এক দামি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে প্রচুর খাবার অর্ডার করেছেন। কিন্তু খেলেন তার সামান্যই। অধিকাংশই নষ্ট হলো। বিল দিতে গিয়ে দেখেন, তা সম্ভাব্য বিলের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি জানতে চাইলেন, বিল এত বেশি কেন? তাকে জানানো হলো, অতিরিক্ত খাবার অর্ডার দিয়ে নষ্ট করার জন্য তাকে জরিমানা করা হয়েছে এবং জরিমানার অঙ্ক খাবারের বিলের চেয়ে বেশি। তিনি রেগে গেলেন, আমার টাকা দিয়ে আমি বেশি খাবার অর্ডার করবো না কম করবো, সেটা আমার ব্যাপার। তাকে জানানো হলো, আপনার অর্থ থাকলেও প্রয়োজনের বেশি খাবার অর্ডার করে তা নষ্ট করার অধিকার আপনার নেই। ফেসবুক থেকে পাওয়া বলে সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে গল্পটি আমার ভালো লেগেছে। সব রেস্টুরেন্টে এমনটি হলে মন্দ হতো না।

আমাদের দেশেও অনেকে মনে করেন, আমার টাকা দিয়ে আমার যা ইচ্ছা তা-ই করার স্বাধীনতা আছে। আমাকে কেন মিতব্যয়ী হতে হবে। কিন্তু তারা বোঝেন না, সম্পদটা তার অর্জন করা হলেও সম্পদে তার অধিকার নেই। প্রকৃতি সবার জন্যই খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু তারপরও পৃথিবীর অনেক মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়। কারণ, সেই ভারতীয় ধনকুবেরের মতো অনেকেই টাকার গরমে খাবার নষ্ট করেন। সেই নষ্ট হওয়া খাবার প্রকৃতি যার জন্য বরাদ্দ করেছে, তাকে তখন না খেয়ে থাকতে হয়।

করোনাভাইরাস এসে অন্তত দুই বছরের জন্য বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থবির করে দিয়েছিল। সেই স্থবিরতা কাটিয়ে অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই করছিল, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যুদ্ধের অভিঘাত বিশ্বের সব দেশেই লেগেছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, ডলারের দাম বাড়ছে। যা বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রবল চাপ তৈরি করেছে। মুদ্রাস্ফীতিতে নাকাল মধ্যবিত্ত। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। দুই বছর পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।

এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার একটাই উপায়- সাশ্রয়। পরিবারে বিপদ এলে আমরা অনেক ব্যয় কাটছাঁট করি। দেশেরও তেমন বিপদ এলে অনেক কিছু কাটছাঁট করতে হয়। সরকারের এই সাশ্রয় ভাবনায় অনেকে বিপর্যয় দেখছেন। বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যায়নি, এটা যেমন সত্যি; আবার বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে না, এটাও সত্যি। শ্রীলঙ্কা হওয়ার শঙ্কা না থাকলেও শিক্ষা নিতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অভিঘাত থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করে এগিয়ে যেতে হলে মিতব্যয়িতার কোনও বিকল্প নেই।

গত বাজেট বক্তৃতায়ও অর্থমন্ত্রী চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী অনেক দিন ধরেই মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শুধু পরামর্শ দিয়েই বসে থাকেননি, সামগ্রিকভাবে ব্যয় কমাতে কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সাশ্রয়ের জন্য রুটিন করে লোডশেডিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। সরকারি অফিসে বিদ্যুৎ সাশ্রয়, বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা, সম্ভব হলে ভার্চুয়াল মিটিং করা, কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ছাড় বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, মিতব্যয়িতার ধারণাটা আমাদের সবসময়ের অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে ভালো। সরকারের যা যা উদ্যোগ, তা আসলে সবসময় বহাল রাখা উচিত। সামর্থ্য থাকলেই যেমন মানুষ প্রতিদিন পোলাও খায় না, তেমনি সামর্থ্য থাকলেই অপ্রয়োজনে এসি চালিয়ে, লাইট জ্বালিয়ে রাখার অধিকার আসলে আমার নেই।

‘সরকার কা মাল দরিয়া মে ঢাল’ বলে একটা ধারণা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। তাই সরকারি অফিসেই অপচয় হয় সবচেয়ে বেশি। সরকারকে ধন্যবাদ, তারা নিজের ঘর থেকেই সাশ্রয়ের চেষ্টাটা শুরু করেছেন। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’। সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনে বিদেশ সফর নিয়ে বিভিন্ন সময় অনেক হাস্যকর ঘটনা ঘটেছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের আমলারা পুকুর খনন শিখতেও বিদেশে যান, সাঁতার শিখতেও বিদেশে যান। এই অপচয় চিরতরে বন্ধ করতে হবে। শপিং মল রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটার একটা ভালো বিকল্প হতে পারে, সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন শুক্র ও শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত শপিং মল খোলা রেখে অন্যান্য দিনে বিকাল ৫টার মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া। তাতে ব্যবসায়ীরা অখুশি হবেন বলে মনে হয় না।

জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। রাতের কাজ কমিয়ে, দিনের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলার অভ্যাস করতে হবে। বাজেটে বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে নিছক নিরুৎসাহিত নয়, বিলাসপণ্যের তালিকা করে কর অনেক বাড়িয়ে দিতে হবে, প্রয়োজনে নিষিদ্ধ করতে হবে।

দেশজুড়ে যখন  হাহাকার, সাশ্রয়ের চেষ্টা, তখন ‘লাখ টাকার আইসক্রিম’ নিয়ে তোলপাড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে। খবরটি প্রথমে আমি দেখেছি ফেসবুকে। যথারীতি বিশ্বাস করিনি। ভেবেছি ফটোশপ বা ট্রল। পরে বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যমের সংবাদ দেখে একই সঙ্গে বিশ্বাস করেছি এবং অবাক হয়েছি। শিরোনামে একটু ভুল আছে, আইসক্রিমের দাম লাখ টাকা নয়, ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা। দাম শুনে বাটার কথা মনে পড়লো। ছেলেবেলা থেকেই দেখছি, বাটার জুতার দাম ৯৯ টাকায় গিয়ে আটকে যায়, সেটা শ’ হোক আর হাজার। রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেল তাদের ১৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেশের সবচেয়ে দামি আইসক্রিম বিক্রির উদ্যোগ নেয়। হোটেল কর্তৃপক্ষও চক্ষুলজ্জার কারণে আইসক্রিমের দাম লাখ টাকার নিচে রেখেছে। দাম শুনে একজন বললেন, এই আইসক্রিম কি স্বর্ণ দিয়ে বানাবে? তিনি অবিশ্বাস থেকে বললেও আসলেই এই আইসক্রিম কিন্তু স্বর্ণ দিয়েই বানানো। এই আইসক্রিমের আগে আমি জানতামই না স্বর্ণ খাওয়া যায়। এখন জানছি ‘এডিবল গোল্ড’ও  আছে। আর সেই খাওয়ার উপযোগী স্বর্ণ দিয়েই বানানো হচ্ছে প্রায় লাখ টাকার আইসক্রিম।

বিজ্ঞাপনটিকে চমক ভাবলেও আমি ভেবেছি, এই আইসক্রিমের ক্রেতা মিলবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ একদিনের মধ্যেই ঘোষণা করে, তারা ওভারবুকড। আর আইসক্রিমের অর্ডার তারা নিতে পারবে না। আমার আসলে অবাক হতেও লজ্জা লাগছে। এমনিতে বাংলাদেশে প্রবল বৈষম্য আছে। তবে সেই বৈষম্য যে এমন নির্লজ্জ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সেটা ভাবতেই লজ্জা লাগছে। সারাদেশে যখন একধরনের হাহাকার, তখন লাখ টাকার আইসক্রিমের ওভারবুকড হয়ে যাওয়াটা আমাদের জাতির জন্যই লজ্জার। বাংলাদেশের অনেক মানুষ আছে, একলাখ টাকা যাদের জীবন বদলে দিতে পারে। আর এই দেশেরই কিছু মানুষ আইসক্রিমের পেছনেই লাখ টাকা উড়িয়ে দিতে পারে! তবে আইসক্রিমের অফার বলে, এটা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে। প্রতিদিন সোনারগাঁও, শেরাটন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ওয়েস্টিনের লবিতে বা বারে বা ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, বনানী ক্লাবে এমন কত লাখ টাকা উড়ে যাচ্ছে; আমরা তা টেরই পাই না। শুরুতে যে গল্প বলেছি, সেটা আসলে আমাদের সবার জন্যই সত্যি হওয়া উচিত। সম্পদটা আপনার অর্জিত বলেই নির্লজ্জ অপচয়ের অধিকার আপনার নেই। বিল গেটস তো প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার জনকল্যাণে ব্যয় করেন। আসলে মিতব্যয়িতাকে আমাদের সবার প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ