X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

এডিসি-কনস্টেবলের আত্মহত্যায় কোনও রহস্য নেই

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২৩ জুলাই ২০২২, ১৮:৫৪আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২২, ১৯:০৬

একজন পুলিশ অফিসার একদিনে তৈরি হয় না। তার জন্য শুধু ওই ব্যক্তিকে নয়, তার পরিবার ও রাষ্ট্রকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। সম্প্রতি আত্মহত্যাকারী পুলিশের একজন এডিসির মতো প্রায় প্রত্যেক পুলিশ অফিসারের ‘পুলিশ অফিসার’ হয়ে ওঠার গল্পের পেছনের গল্প খুঁজলে নিশ্চিত সিনেমা নাটককে হার মানাবে।

অগণিত নির্ঘুমরাত পড়ার টেবিলে বসে, খেয়ে না খেয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে লম্বা ট্রেনিং পেরিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার গল্প প্রায় সবার জানা। কিন্তু এর বাইরে থাকে আরও অনেক শারীরিক মানসিক লড়াই যা কখনও প্রকাশ্যে আসে না। ওই লড়াই একেক জনের একেক রকম। দুঃখ-কষ্ট ট্র্যাজেডিতে ভরা।

পুলিশের চাকরিতে নারীদের লড়াই পুরুষের চাইতে আরও কঠিন। ধর্মীয় ও সামাজিক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাদের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিতে হয়। মোল্লাতন্ত্রের একটিপক্ষ যেখানে এখনও নারীদের কর্মে নিযুক্ত হওয়ার ঘোর বিরোধী। নারীদের ঘরে বন্দী রাখতে নিয়মিত ‘ওয়াজ নসিয়ত’ করছে সেখানে পরিবারের আন্তরিক সমর্থন না থাকলে নারীদের পুলিশের মতো পেশাদারী বাহিনীতে কাজ করা যে বেশ কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দিনরাত যখন-তখন পেশার প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ায় সমাজের মানুষ সবসময় ভালোভাবে নেয় না। অনেক সময় পরিবারের সদস্যরাও নানা সন্দেহের জালে জড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেক নারী পুলিশ অফিসার তাই স্বামী সংসারের প্রকাশ্যে যুক্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ একা হয়ে পড়েন।

আত্মহত্যার গল্পের পেছনের গল্পে যতটা রঙ চড়ানো হোক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে, সম্প্রতি আত্মহত্যাকারী এডিসি এমনই একাকিত্বে ভুগছিলেন। স্বামী ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ভারতে চিকিৎসা গ্রহণ করতে গেলেও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আর দশজন সাধারণ স্ত্রীর মতো তারপক্ষে ভারতে গিয়ে স্বামী সেবা করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে অসুস্থতার সময়ে প্রিয়তম স্ত্রীকে কাছে না পেয়ে স্বামীর মনে হয়তো নানা সন্দেহের দানা বাঁধছিল। দায়িত্বের চাপ সন্দেহের অভিযোগ সবমিলে আত্মহত্যাকারী এডিসিকে মানসিক যন্ত্রণায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তার বারবার আত্মহত্যার চেষ্টার গল্পের পেছনের গল্প তাই যা থাকুক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

আত্মহত্যাকারী এডিসি আর আটদশ সাধারণ আটপৌরে নারীর মতো নন। তাই তার যন্ত্রণাগুলো সাধারণ নারীদের মতো সবার সাথে শেয়ার করা কঠিন ছিল। ভেতরে যন্ত্রণাগুলো পুষে রেখে তাকে নিয়মিত পেশাদারী দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।

পুলিশ অফিসার হলেও তিনি একজন নারী। তাই একটু ভালোবাসা, স্নেহ, কেয়ার তার প্রাপ্য। তার এমন মানসিক যন্ত্রণার সময়ের তাই তিনি একটি অবলম্বন খুঁজে বাঁচতে চেয়েছেন। আর ওই অবলম্বন খুঁজতে গিয়েই তিনি তার সবসময়ের সঙ্গী দেহরক্ষীকে হয়তো ভালোবেসে ফেলেছেন। ওই ভালোবাসা ভাইবোনের ভালোবাসা না অন্য কিছু তা নিয়ে রহস্য খোঁজার কিছু নেই। মুখ্য বিষয় হচ্ছে, আত্মহত্যাকারী এডিসি যে কতটা একা ছিলেন তা বোঝা যায় তাকে তার দেহরক্ষী একজন কনস্টেবলকে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন মানুষ ভেবে তার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে!

পেশাদার একজন মানুষের ভেতরে ভেতরে এমন ভেঙে পড়া কি তার সহকর্মীরা জানতেন না? জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকায় বাংলা ট্রিবিউনের ভাষ্য মতে, তারা জানতেন। এখন পত্রিকায় নাম গোপন করে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তা থেকে বোঝা যায় বিষয়টি। কিন্তু কেন তারা সহকর্মীর এমন ভেঙে পড়ার দিনগুলোয় বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ালেন না? কিন্তু তার সহকর্মীরা চাইলে ওই নির্ভরতার কিছু অংশ তাদের কাঁধে তুলে নিতে পারতেন। বিপদে সাহস জুগিয়ে তার যন্ত্রণা লাঘব করতে পারতেন।

আত্মহত্যাকারী এডিসি একজন বিসিএস উত্তীর্ণ পুলিশ অফিসার, যিনি নানা শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। পেশাগত নানা ট্রেনিংয়ের সময়ে তাকে শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মানসিক চাপ মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়ে তিনি নানা মানসিক চাপ সামলিয়ে পোক্ত হয়েছেন বলেই এডিসি পদে দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই তার আত্মহত্যা মেনে নেওয়া যায় না। একজন প্রশিক্ষিত মানুষ কতটা মানসিক যন্ত্রণায় থাকলে কেবল এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা কল্পনাতীত। তার ওই যন্ত্রণার তুলনায় একজন কনস্টেবল দেহরক্ষীর প্রতি নির্ভরতার ঘটনা তুচ্ছ। তাই তার সহকর্মীদের বা অন্য কারোর উচিত হবে না এই বিষয়টি নিয়ে আর রঙ চড়িয়ে অন্য নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। যারা নারীর কর্মে নিযুক্ত হওয়ার বিরোধী তাদের হাতে ‘ওয়াজে’র নতুন অস্ত্র তুলে দেওয়া। পুলিশ বিভাগের উচিত একটি গোপন তদন্ত করা এবং ওই তদন্তের মাধ্যমে আত্মহত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে ভবিষ্যতে যাতে ওই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় তার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

আত্মহত্যাকারী পুলিশ অফিসার একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার হওয়ার কারণে তিনি সমাজ ও পরিবার থেকে কিছুটা বিছিন্ন ছিলেন তা বলা যায়। কারণ আর আট-দশ জন সাধারণ মানুষের মতো হরহামেশা তার মনের কথা অন্যের সাথে ভাগ করে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পেশাগত মর্যাদা, সম্মান ও দায়িত্বের চাপ তাকে পরিবার, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবদের থেকে অনেকটা বিছিন্ন করেছে। কিন্তু সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা চাইলে সহজে তার পাশে দাঁড়াতে পারত। তারপর ওই কঠিন সময়ে তাকে মানসিক সমর্থন দিতে পারত। দেহরক্ষী কনস্টেবলের সঙ্গে তার ‘প্রেম’ না ‘ভাইবোনের সম্পর্ক’ ছিল তারচেয়ে এই বিষয়টি গণমাধ্যমের খোঁজা বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি যখন বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তখন তিনি এমনটি কেন করছেন ওই বিষয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিয়েছিলেন কি? তাকে কি পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে কোনও মনস্তত্ত্ববিদের পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল? না, বিভাগের সম্মানের ভয়ে বিষয়টি গোপন করা হয়েছে?

ভবিষ্যতে অন্যদের আত্মহত্যারোধে উপযুক্ত প্রশ্নগুলো এখন সামনে আনা দরকার। মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা না পাওয়ায় তিনি আবারও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার।

শারীরিক রোগের মতো মানসিক রোগও যে একটি ভয়াবহ রোগ তারও চিকিৎসা দরকার ওই বিষয়টি সবার বোঝা দরকার। হাতের আঙুলের ক্ষত হলে তার চিকিৎসা না করালে তার পচন ধরতে পারে। তেমনি মনের সামান্য যন্ত্রণা হলে তার নিরাময় না করলে একসময় আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই পুলিশের উচিত এডিসির আত্মহত্যার ঘটনা আমলে নিয়ে তাদের অন্য কর্মকর্তাদের নিয়মিত শারীরিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা করা। যেসব কর্মকর্তারা পারিবারিকসহ নানাধরনের সমস্যায় আছেন তাদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়া। মনে রাখা দরকার, একজন অফিসার তৈরি হতে পারিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের অনেক সম্পদ ব্যয় হয়। একজন পুলিশ অফিসার নিজেও রাষ্ট্রের সম্পদ। তাই একজন পুলিশ অফিসারের আত্মহত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয় করার মতো বিলাসিতা করা একটি পেশাদারী বাহিনীর মানায় না।

পুলিশের এডিসির মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আত্মহত্যার ঘটনা বিরল হলেও পুলিশে কনস্টেবলদের আত্মহত্যার ঘটনা প্রায় ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কনস্টেবলরা তাদের বেতন, চাকরির সুযোগ-সুবিধা এবং পোস্টিং নিয়ে সন্তুষ্ট না হবার কারণে মানসিক চাপ থেকে আত্মহত্যা করে। একজন পুলিশ কনস্টেবলের বেতন খুব বেশি নয়। তারা যে বেতন পায় তা দিয়ে স্বামী স্ত্রী ছেলে-মেয়ে মিলে একসঙ্গে বাসাভাড়া করে বাস করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই পুলিশের পোস্টিং নীতিমালায় পরিবর্তন আনা দরকার। কনস্টেবলদের নিজ এলাকার কাছাকাছি এলাকায় পোস্টিং দেওয়া দরকার যাতে তারা খুব সহজে ছুটির দিনগুলোয় বাড়ি যেতে পারে। পরিবারের কাছাকাছি থাকতে পারে। মাঝে মাঝে ফ্যামিলি ডের আয়োজন করা। পরিবারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকলে তাদের পক্ষে আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে। আনন্দের সঙ্গে কেউ কাজ করার সুযোগ পেলে তার কাছ থেকে দ্বিগুণ কাজ আদায় করা যায়। তাই কনস্টেবলদের সাপ্তাহিক ছুটির ব্যবস্থা করা এবং কথার ছলে হলেও নিয়মিত তাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ খবর রাখা দরকার।

পুলিশের মতো একটি পেশাদারী বাহিনী তার সদস্যদের নিয়মিত শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে আমরা এমটা আশা করি। অন্য যেকোনও চাকরির চেয়ে পুলিশের সবপর্যায়ের সদস্যদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ বেশি নিতে হয়। তাই তাদের শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক চাপ মোকবিলার কৌশল শিখতে হয়। কিন্তু ওই কৌশল কেবল চাকরির ক্ষেত্রে নয়, ব্যক্তি জীবনের সংকট মোকাবিলায়ও যাতে কাজে লাগে– মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের কোর্সগুলো ওভাবে সাজানো দরকার।

সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বলছে, পুলিশ বিভাগে অধিকসংখ্যাক পেশাদার সাইকোলজিস্ট নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। হোক এডিসি কিংবা কনস্টেবল, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। তাই আত্মহত্যারোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে পুলিশ বিভাগ তৎপর হবে বলে আমরা আশা করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ