X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিয়ানমার কি যুদ্ধের উসকানি দিচ্ছে?

আমীন আল রশীদ
০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:২৩আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:২৩

কয়েক দিন ধরেই বাংলাদেশ সীমান্তে ‘যুদ্ধের উসকানি’ দিচ্ছে মিয়ানমার। সবশেষ শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে গুলি ও মর্টার শেল ছোড়া হয়েছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে শূন্যরেখার কাছাকাছি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ১২০ মিটার ভেতরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর দুটি গোলা এসে পড়েছে। জনবসতিহীন পাহাড়ে এ দুটি গোলা বিস্ফোরিত হলেও কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

এর আগে গত ২৮ আগস্ট দুটি মর্টারের গোলা নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তর ঘুমধুমপাড়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসে পড়ে। তবে গোলা দুটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরদিন সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল সেটি নিষ্ক্রিয় করে। এর দুদিন পরই ৩০ আগস্ট মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওইদিন দুপুরে ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি সীমান্তের ৩-৪শ’ গজ ভেতরে মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টারকে বেশ কয়েকবার ঘুরতে দেখা গেছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসেও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমার। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা চলে আসার পর অন্তত তিনবার বাংলাদেশের আকাশ সীমানায় উড়ে গেছে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার। তখনও এর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

এবারও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মর্টার শেল ও গুলি নিক্ষেপ এবং মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সতর্ক করে এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশসহ (বিজিবি) আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সতর্ক রয়েছে এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান আর্মির সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে এবং সেখান থেকে মিয়ানমারের নাগরিকরা যাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সরকার কূটনৈতিক সম্প্রদায়কে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার পরিকল্পনা করছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের উসকানি বা ফাঁদে পা দিতে চাই না।’

২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে মিয়ানমারের দিক থেকে যুদ্ধের উসকানিতে সতর্ক থেকে তা এড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের একেবারে প্রতিবেশী, একটা পর্যায়ে এমন একটা ভাব দেখালো; আমাদের সঙ্গে যুদ্ধই বেঁধে যাবে, এরকম একটা। আমাদের সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশ সকলকে সতর্ক করলাম, কোনোমতেই কোনোরকম উসকানির কাছে তারা যেন বিভ্রান্ত না হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নির্দেশ না দেবো।’

প্রশ্ন হলো, মিয়ানমার কেন বাংলাদেশ সীমান্তে মর্টার শেল ও গুলি ছুড়ছে এবং আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে?

শোনা যাচ্ছে, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই চলছে। বিশেষ করে রেজু আমতলী সীমান্তের কাছাকাছি ওয়ালিডং পাহাড়ে গোলাগুলি বেশি হচ্ছে। এজন্য বাংলাদেশ সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যারা জুমচাষ করছেন, তারা গুলি এসে পড়ার ভয়ে জুমকাজেও যেতে পারছেন না।

তবে শুধু আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই একমাত্র কারণ নাকি এখানে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিরও হিসাব-নিকাশ রয়েছে, সেটিও ভেবে দেখা দরকার এবং এরকম উসকানিতে বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল কী হবে; শুধু মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

বাংলাদেশের সংবিধানে (অনুচ্ছেদ২৫) রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা- এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সব সময়ই বঙ্গবন্ধুর একটি দর্শন সবসময় উল্লেখ করা হয়, সেটি হলো ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেউ যখন গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসে এবং সেটি যখন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে, তখনও কি নীতি ও কৌশল একই থাকবে?

পাল্টা হিসেবে বাংলাদেশও মিয়ানমারের সীমান্তে মর্টার শেল ও গুলি হয়তো ছুড়বে না, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা তো ভিন্ন হতে হবে। বাংলাদেশের যারা বন্ধু তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। কেবল আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি উত্থাপন করা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো।

মিয়ানমার কেন এটি করছে সেটি কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

এই অঞ্চলে ভারত ও চীনের যে আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, সেখানে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও ভারত- উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। এই দুটি দেশই বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার এবং ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের উভয়ের কাছেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের সমুদ্র। যে কারণে চীনের সঙ্গে যখন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তখন ভারত গোস্বা করে। আবার ভারতের সঙ্গে যখন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তখন মন খারাপ হয় চীনের।

যেহেতু এই অঞ্চলে চীনের বড় বন্ধু হচ্ছে মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা দ্বিপক্ষীয় জটিলতা রয়ে গেছে; চীনের প্রশ্রয়ের কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার পৃথিবীর কাউকে পাত্তা না দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি যেহেতু সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে, ফলে এসব সমীকরণও বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের যুদ্ধের উসকানির নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে কিনা—সেটিও ভেবে দেখা দরকার।

৫-৮ সেপ্টেম্বর ভারত সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খুব সম্প্রতি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে হয়ে গেলো যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক এবং সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরেও যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলোর আলোকে এক বা একাধিক সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। তার ওপর আগামী বছরই বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা এবং ওই নির্বাচনটি কেমন হবে; সেই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভারত ও চীনের কোনও স্বার্থ রয়েছে কিনা, সেটিও মিয়ানমারের এই উকসানির পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে সমাধান প্রয়োজন। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট, কিন্তু জনগোষ্ঠী বিশাল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্র। নিজের দেশকে স্বাধীন করতে পৃথিবীতে আর কোনও জাতি এত রক্ত দেয়নি। মাতৃভাষার অধিকার আদায়েও প্রাণ দেওয়ার বিরল দৃষ্টান্ত এই দেশের মানুষের। সুতরাং, এই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকারের মেরুদণ্ড সোজা রাখা দরকার।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ