X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশি বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারা

প্রণব মজুমদার
০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:৫৮আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:৫৮
উন্নয়নের সাফল্যে পৌঁছাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিনিয়োগ বিকাশ এসবের মধ্যে অন্যতম। উদ্যোগগুলোর অর্জন হিসেবে সাফল্য লক্ষণীয়। দেশের ৮টি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে ৪৬৪টি চালুকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৪ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৩৭ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে ।

থেমে নেই দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ। অতিমারি করোনা ভাইরাসের মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয় বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুখবর দিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি বিনিয়োগের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৫০ কোটি ১০ লাখ ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে প্রকৃত এফডিআই বলা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ছিল ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। আধুনিক বিশ্বে যেকোনও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক বিনিয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান ১ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এফডিআই যদি ৫-৬ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তাহলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। সেই সুযোগও রয়েছে আমাদের সামনে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের সুযোগ অনেক। সাম্প্রতিককালে, বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি বিনিয়োগে একটি সহায়ক ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নীতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু পুরাতন ব্যবসার সংস্কার করেছে। দেশে বিনিয়োগ ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সহায়ক স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজমান। বেসরকারি বাণিজ্য খাতের প্রবল আগ্রহের কারণেই বাংলাদেশ বাজার অর্থনীতি প্রবর্তনে দ্রুত বিভিন্ন কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে। অর্থনৈতিক নীতির মূল ভিত্তি হলো সম্পদের উৎপাদন ও বণ্টনে প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির ওপর আস্থা এবং বেসরকারি খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দূর করা। সরকার ধাপে ধাপে শিল্প ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে নিজের সম্পৃক্ততা সরিয়ে বেসরকারি অংশগ্রহণ উৎসাহিত করছে। অর্থনৈতিক নীতিসমূহের ক্ষেত্রে সরকার দ্রুত সুনির্দিষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত বিনিয়োগ নীতি প্রণয়ন করেছে।

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহায়ক ও আকর্ষণীয় প্রস্তাবসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য, রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিভিত্তিক শিল্প, কাঁচা পাট, কাগজ, রেশম শিল্প, হিমায়িত খাদ্য (বিশেষত চিংড়ি), পর্যটন, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প, সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিংয়ের মতো রফতানিমুখী শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও ভারী ও তথ্যপ্রযুক্তির শিল্প প্রতিষ্ঠায়ও বিদেশি বিনিয়োগকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, যা দেশীয় আমদানি ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের কিছু বিদেশি বিনিয়োগ সুবিধা রয়েছে– ১০০ ভাগ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (ডিএফআই) অথবা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাতে (ইপিজেড) যৌথ বিনিয়োগ অথবা এই এলাকার বাইরের বিনিয়োগ, স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে পাবলিক কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের দ্বারা তালিকাভুক্ত বিনিয়োগ, অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ- যেমন– বিদ্যুৎ খাত, তেল, গ্যাস ও খনিজ অনুসন্ধান, টেলিযোগাযোগ, বন্দর, সড়ক ও জনপথ, সরাসরি/প্রত্যক্ষ ক্রয় অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ক্রয় করা (বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়াধীন কোনও প্রতিষ্ঠানের শেয়ার) এবং বেসরকারি ইপিজেড বিনিয়োগ। বেসরকারি উদ্যোগে রফতানিমুখী ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সেবা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) দায়িত্বপ্রাপ্ত। বেসরকারি খাতকে বেগবান করতে সরকারের বিনিয়োগ বোর্ড এবং বেসরকারিকরণ কমিশন একীভূত করে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিডা গঠিত হয়। সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা সহায়তা প্রদান করাই  এই কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য। সরকার প্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সচিবালয় এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিনিধিগণ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দেশে বিনিয়োগ বিকাশে যে সমস্যা নেই তা একবারেই বলা যায় না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শিল্প স্থাপনে আগের মতো ঢালাওভাবে অবকাঠামোগত সমস্যার কথা বলেন না। দেশের অবকাঠামোগত বেশ উন্নয়ন হয়েছে। তবে দেশের প্রতিটি এলাকায় যানজট প্রকট আকার ধারণ করেছে। উন্নয়নের পথে যা বড় বাঁধা।

বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের সংগঠন অ্যামচেমের (আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, ‘বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সরকার বাস্তবায়ন করছে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে। এসব প্রকল্প পিপিপির আওতায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমেও হতে পারতো। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত।’

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গত অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে। সে জন্য করোনা মহামারির মধ্যেও এফডিআই খানিকটা বেড়েছে বলে জানান তারা।

২০১৯ সালে ৩৯৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে এসেছিল ৪৫৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার; যা একক বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগ।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসেবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। এ তিন পদ্ধতির যেকোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ এলে তা এফডিআই হিসেবে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, খাদ্যে ১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে। এই এফডিআইয়ের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ মূল পুঁজি, ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ এবং ৬ শতাংশ এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ।

২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে দেশে মোট ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার এফডিআই এসেছে। এরমধ্যে মূল পুঁজি এসেছে ৯১২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মুনাফা ও ঋণ থেকে বিনিয়োগ হয়েছে বাকি ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ মাত্র এক-তৃতীয়াংশ।

এই সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, মিসরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশের ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।

অর্থনীতি গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের ধারণা, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে না।

তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার কারণে তা আরও কমে গেছে। সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। করোনায় বিশ্ব বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় পুঁজির চলাচল একেবারে স্থবির ছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে। এরমধ্যেও যে গত অর্থবছরে বাংলাদেশে এফডিআইয়ে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তাকে আমি ভালোই বলবো।’

বিনিয়োগ বিকাশে আলোচ্য তথ্য ও পরিসংখ্যান বলে দেয় উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশ হাঁটছে। বিনিয়োগের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে পরিবেশ অনুকূলে রাখতে হবে। আর এ জন্য সরকারি বেসরকারি খাতে নিয়োজিত সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ, একতাই হচ্ছে উন্নয়ন অর্থনীতির মূলশক্তি।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাহিত্যিক

[email protected]
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ