X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

এই ছাত্র রাজনীতি চাই না

প্রভাষ আমিন
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:৫৬আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:৫৬

হঠাৎ করেই আলোচনায় ইডেন কলেজ। আলোচনার সূত্রপাত করেছে ছাত্রলীগ। আর ছাত্রলীগ যখন আলোচনার সূত্রপাত করে, তখন সেটা ভালো কিছু হওয়ার সুযোগ নেই; ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এটাকেই বাস্তবতা করে তুলেছে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর আমরা আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম গণতন্ত্র মুক্তি পাবে। স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হলেও পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গ এলে বলা যায়, গণতন্ত্রের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছে। এরশাদ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরকারি ছাত্র সংগঠন এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছাড়া সবাই নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারতো। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ‘উত্তরপাড়া’ ছিল ছাত্রদলের দখলে আর ‘দক্ষিণপাড়া’ ছাত্রলীগের। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীনদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। আগে যেখানে ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠন ঢুকতেই পারতো না, এখন সেখানে তাদেরই একক আধিপত্য। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রদল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ– এই ধারাবাহিকতাই চলে আসছে তিন দশক ধরে।

আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ১৩ বছর ধরেই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে রেখেছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ছাত্রলীগ আসলে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই একক আধিপত্য কায়েম করেছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা বিকল্প প্রশাসন চালু করেছে। হলগুলোতে ছাত্রলীগের একক নিয়ন্ত্রণ। কে সিট পাবে, কে কোন রুমে থাকবে– সব ঠিক করে ছাত্রলীগ। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি তো আছেই। এই একক নিয়ন্ত্রণ শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, ছাত্র রাজনীতিতেই এক গভীর অসুখ সৃষ্টি করেছে। যার সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে ইডেন কলেজে।

প্রতিপক্ষ নেই বলে ছাত্রলীগ এখন নিজেরাই সংঘর্ষে জড়ায়। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে ইডেন কলেজের যে অন্ধকার দিক সামনে আসছে, তা লজ্জিত করেছে গোটা জাতিকেই। প্রশ্নের মুখে পড়ছে ছাত্র রাজনীতিই।

আর ছাত্র রাজনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলার মূল দায় অবশ্যই ছাত্রলীগকে নিতে হবে। অথচ ছাত্রলীগের রয়েছে গৌরবজনক অতীত। ছাত্রলীগ বর্তমানে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হলেও শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আওয়ামী লীগেরও এক বছর আগে। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণ-আন্দোলনসহ বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল ও সাহসী।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের লড়াই শুরু করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই লড়াইয়ে তাঁর মূলশক্তি ছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু গত একযুগে ছাত্রলীগ তার গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ভুলিয়ে দিয়ে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও সরকারের দায়ে। ছাত্রলীগের একেকটি অপকর্মে শেখ হাসিনার অনেক অর্জন বিসর্জনে যায়। গত ১২ বছরে হেন কোনও অপরাধ নেই, যা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে আসেনি। গুগলে ছাত্রলীগ লিখে সার্চ দিলে খালি অপকর্মের ফিরিস্তিই আসে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিটি বাণিজ্য, খুন, ধর্ষণ, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, সাধারণ ছাত্রদের হয়রানি, এমনকি হত্যার অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে পুরোনো ঢাকায় বিশ্বজিৎ আর বুয়েটে আবরার হত্যার ঘটনা ম্লান করে দিয়েছে ছাত্রলীগের অতীতের অনেক অর্জনকে।

ছাত্র রাজনীতি নিয়েই যখন এত প্রশ্ন তখন ছাত্রলীগের একটি উদ্যোগ শঙ্কিত করেছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে আবরার ফাহাদকে হত্যার পর থেকে বুয়েটে নিষিদ্ধ হয়েছে ছাত্র রাজনীতি। দেশের আরও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও নিজেদের মতো করে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে রেখেছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির সুযোগ নেই। কিন্তু গত ৩ সেপ্টেম্বর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন উদ্বিগ্ন করেছে সবাইকে। এর মাধ্যমে ছাত্রলীগ আসলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তাদের দখলদারিত্ব কায়েম করতে চাইছে। ছাত্র রাজনীতি নেই বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশন জট নেই, মারামারি নেই, হল দখল নেই, চাঁদাবাজি নেই, র‌্যাগিং নেই। উচ্চ টিউশন ফি সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের তাই প্রথম পছন্দ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চালুর ব্যাপারে ছাত্রলীগের পাঁয়তারায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা এ উদ্যোগ ঠেকাতে ই-মেইল ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রবলভাবে ছাত্র রাজনীতির পক্ষের মানুষ। যা চেয়েছি, তার পুরোটা হয়তো পাইনি; তবু নিজের যৌবন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ব্যয় করেছি; এটা আমার সারা জীবনের গৌরব। অল্প সময় ছাত্র রাজনীতি থেকে যতটা জীবন শিখেছি, ক্লাসরুমে ততটা নয়।

বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক অর্জনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা। এখন যারা দেশ চালাচ্ছেন বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই ছাত্র রাজনীতি করে উঠে আসা। ছাত্র রাজনীতি একজন শিক্ষার্থীকে নেতৃত্বগুণ শেখায়, সংগঠন করার ব্যাপারে দক্ষ করে তোলে, নিজের দলের আদর্শে সাধারণ ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করার কৌশল শেখায়। রাজনীতি করলে একজন শিক্ষার্থী অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বৃহত্তর আঙ্গিকে জীবনকে দেখার, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার, যেকোনও সমস্যা সাহসের সাথে মোকাবিলার শিক্ষা পায়, যা ভবিষ্যৎ জীবনে যেকোনও পেশায় তাকে আরও বেশি দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক করে তোলে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ছাত্র রাজনীতির নামে এখন যা চলছে, তা নিয়ে আমরা আর গর্ব করি না। আগে ছাত্রনেতাদের মানুষ ভালোবাসতো, এখন ভয় পায়। আগে মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতি করতো, এখন মাস্তানরা করে। রাজনীতি এখন আর ত্যাগের নয়; ভোগের, আর্থিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার।

এই যে দেশজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ফলাফল কী হবে? কী যে হবে সেটা সবাই জানেন, এ কারণেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। গত ৩২ বছরে মাত্র একবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। তাতেই ছাত্রলীগ নিজেদের অবস্থান টের পেয়ে গেছে। নিরঙ্কুশ আধিপত্য থাকার পরেও ভিপি জিততে পারেনি। হতে পারে সে কারণেই, সরকার আর ডাকসু নির্বাচনের দিকে যায়নি। গায়ের জোরে দখল করার সুযোগ থাকলে কে আর নির্বাচন দিয়ে পরাজিত হওয়ার ঝুঁকি নেয়।

একটা বিষয় পরিষ্কার, দৃশ্যত সবকিছু নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আসলে কিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এই নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়েই ছাত্রদল ভিসির সাথে দেখা করতে চাইলেও ছাত্রলীগ তাদের পিটিয়ে বের করে দেয়। ছাত্রলীগ আসলে ভালোবেসে নয়, ভয় দেখিয়ে জয় করতে চাইছে। কিন্তু এটা কখনও সম্ভব নয়। মফস্বল থেকে আসা যে ছেলেটি হলের সিট বজায় রাখার জন্য ছাত্রলীগের মিছিলে যায়, সেও কিন্তু ছাত্রলীগকে ভালোবাসে না। আর এই সুযোগে ছাত্রদল আর শিবিরের  লোকজনও এখন ছাত্রলীগে ঢুকে নেতা হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।

একসময়কার ছাত্রশিবিরের কর্মী সাকিবুল ইসলাম রানা পরে ছাত্রদলও করেছেন। এখন তিনি রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক অডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘বহুত বড় চিটারি-বাটপারি কইরে আমি প্রেসিডেন্ট হইছি। সব চিটারের দলের সর্দার আমি।’ এসব ‘চিটার-বাটপারই’ এখন ছাত্রলীগকে, ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করছে, কলঙ্কিত করছে।

তাই প্রবলভাবে ছাত্র রাজনীতির পক্ষের মানুষ হয়েও আমি এখনকার বাস্তবতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি চাই না। ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, মারামারি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির বিষ যেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কলুষিত করতে না পারে।

এখন ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে, তাতে ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষেই প্রবল জনমত গড়ে উঠছে। অনেকে শুধু বুয়েট বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, ছাত্র রাজনীতিই নিষিদ্ধ করে দেওয়ার দাবি তোলেন। তবে সেটা মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো ব্যাপার হবে।

আমাদের প্রথম দায়িত্ব হলো, ছাত্র রাজনীতিকে ঠিক ধারায় ফেরানো। ছাত্র রাজনীতি যেন শিক্ষার্থীদের কল্যাণ, দেশের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে; তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সবার রাজনীতি করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা করতে না পারলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ। এভাবে চলতে থাকলে এখনকার এই চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজরাই একসময় নেতা হবে, এমপি হবে, মন্ত্রী হবে, দেশের নীতি নির্ধারণ করবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
মুখোমুখি ইরান-ইসরায়েল, পরীক্ষার মুখে মার্কিন সামরিক কৌশল
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
শহীদ মিনারে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
বিমানবন্দরে বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে যাওয়া বাসের চালক গ্রেফতার 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ