X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ শামসুল হক ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ হলে কার লাভ?

আমীন আল রশীদ
৩১ অক্টোবর ২০২২, ২১:০৯আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২২, ২১:০৯

ঘটনা ২০১৭ সালের। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে ৪৯ বছর বয়সী একজন মার্কিন নারী, যিনি পেশায় একজন শিক্ষক, বিমানবন্দর পুলিশের জেরার মুখে বিরক্ত হয়ে তাদের লক্ষ করে দুটি খারাপ শব্দ উচ্চারণ করেন। অভিযোগ, তার মধ্যে একটি শব্দ ছিল ‘নাৎসি’। যদিও পরে ওই নারী দাবি করেন, তিনি পুলিশকে ‘নাৎসি’ বলেননি।

যাহোক, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং তাকে আইনি ঝামেলায় পড়তে হয়। এ বিষয়ে ম্যানফ্রেড হেনরিক নামে একজন আইনের অধ্যাপক জার্মানির গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, কাউকে ‘নাৎসি’ বলাটা এক ধরনের বর্বরতা (ডয়েচে ভেলে, ২৬ জানুয়ারি ২০১৮)।

প্রসঙ্গত, জার্মানিতে কাউকে ‘নাৎসি’ বলে গালি দেওয়া আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ না হলেও কাউকে অসম্মানিত করে কোনও কথা বলা বা গালি দেওয়া সে দেশের পেনাল কোড (বিধি ১৮৫) অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। বিশেষ করে কাউকে ‘নাৎসি’ বলে গালি দেওয়া জার্মানির সামাজিক রীতি ও সংস্কৃতিবিরোধী। এটিকে গর্হিত কাজ বলে গণ্য করা হয়। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ও তার বাহিনীর (নাৎসি) অপরাধ সারা বিশ্বেই একটি ঘৃণ্য কাজ হিসেবে গণ্য।

প্রসঙ্গটির অবতারণার কারণ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক (জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫-মৃত্যু ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন কিনা, সেই বিতর্কের আলোকে।

পাঠক হয়তো খেয়াল করেছেন, বিষয়টি নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় নানারকম কথাবার্তা হচ্ছে। সৈয়দ হককে নিয়ে এই বিতর্কটি যে এই প্রথম, তা নয়। এর আগেও এরকম কথাবার্তা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সৈয়দ হক কি আসলেই স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন? এই প্রশ্নটির সুরাহা করা আরও বেশি জরুরি, কারণ আমাদের দেশে ভিন্নমতের লোকদের ‘রাজাকার’ বা ‘রাজাকারের বাচ্চা’, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর লোক বলে ট্যাগ লাগানো বা গালি দেওয়ার প্রবণতা বেশ পুরনো। সেই ধারাবাহিকতায় সৈয়দ শামসুল হকের মতো মানুষের গায়েও যদি স্বাধীনতাবিরোধীর তকমা লাগানো হয়, সেটি উদ্বেগের। বিষয়টি আরও বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি করে যখন সমাজের বিশিষ্ট বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও লোকও এই স্রোতে গা ভাসান।

প্রশ্ন হলো, সৈয়দ শামসুল হক কোথায় কীভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন? তিনি মুখে কারও সঙ্গে বলেছেন? বললেই সেটা স্বাধীনতাবিরোধিতা হয়ে যায়? তার কোনও লেখা কি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে? যদি থাকে, সেই বই বা লেখার শিরোনাম কী? সৈয়দ হক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, এটা ঠিক। ১৯৭১ সালে তিনি লন্ডনে বিবিসিতে কর্মরত। ওখানে বসে তিনি কীভাবে স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেন?

একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, আইনজীবী ও লেখক এস. এম. আব্রাহাম লিংকন লিখেছেন, সৈয়দ শামসুল হক কবরে শায়িত কয়েক বছর। তিনি কবরবাসী হলেও স্বাধীনতাবিরোধীদের আক্রমণ থেকে এখনও মুক্তি পাননি। এর কারণ মূলত তার মুক্তিযুদ্ধ ও শ্রেণিভিত্তিক সাহিত্য সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধের হারিয়ে যাওয়া চেতনা ও মূল্যবোধের সমালোচনায় প্রণীত উপন্যাস স্মৃতিমেধ তাঁর অনন্য সৃষ্টি। যেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জিনাত মহল চরিত্রটি দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক নোংরা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আপসকামিতার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। (সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও শ্রেণি চেতনা, বণিকবার্তা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

আইনজীবী আব্রাহাম লিংকনের ভাষায়– সৈয়দ শামসুল হক পঁচাত্তর-পরবর্তী অমানিশায় আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা ছিলেন। তিনি সে সময়ের অপশাসনের বিরুদ্ধে শুধু লেখনীতে নয়, বরং অপশাসন ও অনাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামীদের সঙ্গে রৌদ্রতপ্ত রাজপথে তরুণ-যুবার মতো শামিল থেকেছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠন করে সারা দেশে কবিতা কর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সংগ্রামের মন্ত্রণা।

লেখক স্বকৃত নোমান সৈয়দ হককে নিয়ে অপপ্রচারের জবাব দিয়েছেন এভাবে: মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের কোন অগ্রজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কে রাজাকার ছিলেন, কে পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন, কে ভারতে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা অবশ্যই আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন। সৈয়দ শামসুল হকের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখককে আমরা প্রশ্নহীন ছেড়ে দেবো কেন? তাই প্রাশ্নিকদের নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন সেসব আত্মঘাতী বিভ্রান্তদের নিয়ে, যারা সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া ফেসবুকে অবলীলায় বলে দিচ্ছেন, সৈয়দ হক ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। (ঢাকা টাইমস, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

প্রয়াত শিল্পী মুর্তজা বশীর তাঁর আত্মজীবনীতে (আমার জীবন ও অন্যান্য, পৃষ্ঠা ২৭৯) লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের একটি কবিতার শিরোনাম ছিল, ‘পহেলা মার্চ ১৯৭১’। ওই বছরের ১২ মার্চ কবি-সাহিত্যিকরা বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ নামে একটি কমিটি গঠন করেন। ২২ মার্চ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এই লেখক সংগ্রাম শিবির স্বাধিকারে পক্ষে, পশ্চিম পাকিস্তানের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে বিপ্লবী কবিতা পাঠ ও গণনাট্য মঞ্চায়ন করে, সেখানে কবিতা পড়েন সৈয়দ শামসুল হক।

যদিও পরবর্তী সময়ে কিছু বাস্তবতার কারণে সৈয়দ হক লন্ডনে চলে যান। আবার স্বাধীনতার পরপরই সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে কবিতা টেপরেকর্ড করে পাঠান। সেই কবিতা বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান কবিদের সামনে বাজিয়ে শোনানো হয়।

সুতরাং যে কবি ’৭১-এর মার্চে ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর মতো পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায় পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা লিখলেন; যিনি যুদ্ধকালীন ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’-এর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন; যিনি মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পরপরই স্বদেশের জন্য কবিতা রেকর্ড করে পাঠালেন, তিনি কী করে পাকিস্তানের সমর্থক হতে পারেন? তিনি কীভাবে স্বাধীনতাবিরোধী হন?

বিবিসি বাংলার ৭০ বছর উপলক্ষে ২০১১ সালে প্রকাশিত স্মরণিকায় সৈয়দ হক যে স্মৃতিচারণ করেন, সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমার ধারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলবে, হয়তো বছর তিনেক লেগে যাবে। শরীর ভেঙে পড়েছিল বন্দি স্বদেশে। ভেবেছিলাম, শরীর খানিকটা ঠিক হলেই ভারতে ফিরে আসবো, সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো। লন্ডনে আসবার পরপরই বন্ধুরা আমাকে বিবিসিতে নিয়ে এলেন আর সেখানে পরদিন থেকেই খবর ও খবর-ভাষ্য প্রচারে লেগে গেলাম। প্রায় প্রতিদিনই বেতারে কণ্ঠ দিচ্ছি আর স্বজন প্রিয়জন আর সিলেট অঞ্চলের অজানা অনেক মানুষের কল্যাণে থাকা খাওয়া চলছিল। তাদের সেই অনুগ্রহ আর যত্নের কথা সারা জীবন আমি ভুলবো না।’

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে গর্বিত হবার মতো অর্জন যে মুক্তিযুদ্ধ, সেটি দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই নানাভাবে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র হয়েছে। এখনও থামেনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ; রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতের লোক মানেই তাকে ‘রাজাকার’ বা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ বলার মতো জঘন্য কাজ এখনও চলছে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলো, তখনও মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য বা মতভিন্নতা দৃশ্যমান।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছর পরে যেমন মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতির একটি দায় মোচন করা গেছে, সেই ধারাবাহিকতায় এখন সম্ভবত এরকম একটি আইন করারও সময় এসেছে যে, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কিংবা আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকে ‘রাজাকার’ বা ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ বলে গালি দেওয়া যাবে না; রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতের অনুসারী হলেই তাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বলা যাবে না।  উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পরামর্শ দিয়েছিলেন, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে যেন ‘রাজাকার’ বলা না হয়। নওগাঁ এবং জয়পুরহাট জেলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত তিন জনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত দল এবং প্রসিকিউটরদের পক্ষ থেকে আবেদন দেওয়া হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেল এই পরামর্শ দেন। তদন্ত দলের চিঠিতে অভিযুক্তদের নামের আগে ‘রাজাকার’ শব্দটি উল্লেখ থাকায় অভিযুক্তদের আইনজীবী এ নিয়ে আপত্তি তোলেন (বিবিসি, ৩০ এপ্রিল ২০১৭)।

সুতরাং সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কেউ যদি সৈয়দ শামসুল হক স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন বলে প্রচার করেন, সেটি শুধু দুঃখজনক ব্যাপারই নয়, বরং এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কারণ, এর মধ্য দিয়ে শুধু একজন ব্যক্তি বা লেখক সৈয়দ শামসুল হককেই অসম্মানিত করা হয় না, বরং এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। মনে রাখা দরকার, একটি গোষ্ঠী বরাবরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করায় তৎপর ছিল, আছে। এর পেছনে একটি সুদূরপ্রসারী রাজনীতিও রয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিষয়গুলো বিতর্কিত হলে যে রাজনীতির সুবিধা, সেই রাজনীতি সবসময়ই সক্রিয়।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ