X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘রাজাকার’দের অর্থে কেটে যাবে রিজার্ভ সংকট

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২৭ নভেম্বর ২০২২, ১৯:০৬আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২২, ১৯:০৬
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলায় সাধারণ মানুষ পরিশ্রম করে যুগে যুগে বাংলাকে এক সমৃদ্ধশালী জনপদে পরিণত করেছে। কিন্তু ওই সমৃদ্ধি তারা ভোগ করতে পারেনি, কারণ ধারাবাহিকভাবে অর্থসম্পদ বাংলার বাইরে পাচার হয়েছে। বিশ্বের বুকে বাংলা তথা বাংলাদেশ একমাত্র দেশ, যার সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে সব যুগে। বিদেশি লুটেরা তার সম্পদ লুটেছে তার স্বদেশ গড়তে। কিন্তু বাংলা তথা বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তার বস্ত্রহরণ হয়েছে নিজের সন্তান দ্বারা, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। স্বাধীন বাংলাদেশে সব সরকারের শাসনামলে বিদেশি লুটেরার মতো তার নিজ সন্তানরা এ দেশের সম্পদ লুটেছে, পাচার করেছে অন্য দেশে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আগে সম্পদ পাচার করেছে বিদেশি শাসকরা। স্বাধীনতা লাভের পর পাচার করছে এ দেশের জলে-মাটিতে জন্ম নেওয়া বেড়ে ওঠা একদল রাজাকার।

বিদেশি শাসকরা বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে বারবার একে জয় করতে শাসন করতে চেয়েছে। বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এত বেশি ছিল যে ব্রিটিশদের কাছে আমেরিকা শাসন-শোষণ করার চেয়ে বাংলা শাসন ও শোষণ করা বেশি গুরুত্ব বহন করেছে। ব্রিটিশরা বাংলা জয় করার পর তাই বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তার অন্য উপনিবেশ আমেরিকা ত্যাগ করতে রাজি হয়েছে। তারা হিসাব কষে দেখেছে, তাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য বাংলার সম্পদ যথেষ্ট। তাই তারা আমেরিকা থেকে তাদের নজর সরিয়ে নিয়েছে। পূর্ণ মনোযোগ দেয় বাংলা শাসন ও শোষণে। বৈশ্বিক বাস্তবতায় যখন তাদের একটি উপনিবেশকে বেছে নিতে হয়, তখন তারা বাংলাকে বেছে নেয়। এ থেকে বোঝা যায় তৎকালীন আমেরিকার অর্থনীতির চেয়ে বাংলার অর্থনীতি সমৃদ্ধ বেশি ছিল।

ব্রিটিশদের মতোই যুগ যুগান্তরে পরাক্রমশালী বৈদেশিক শাসকরা এই সমৃদ্ধশালী জনপদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিল। উদ্দেশ্য ছিল সম্পদশালী বাংলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজকোষ পূর্ণ করা। অন্যভাবে নিজ দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা। আর্য থেকে হুন, দিল্লির সুলতানি শাসক থেকে মুঘল বাদশাহ নামদার, ব্রিটিশ বেনিয়া থেকে নব্য ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি সবাই বাংলা অধিকার করে এই সমৃদ্ধশালী জনপথের সমৃদ্ধ অর্থনীতিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছে। বাংলার সম্পদে যেমন মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তম পত্নী মমতাজ মহলের স্মৃতিতে তাজমহল নির্মাণ করেছেন, তেমনি ইংল্যান্ডের শহরগুলোয় ওই সম্পদেই নিয়নবাতি জ্বলেছে। পাকিস্তানিরাও পিছিয়ে নেই; তারাও এই দেশের সম্পদকে ব্যবহার করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে– লাহোর, মুলতান, করাচির রাজপথ ঝকঝকে তকতকে করে সাজাতে।

বাংলার ইতিহাসের পরতে পরতে এমন সমৃদ্ধির কথা লেখা আছে। সমুদ্রের অতলে অভিযান চালিয়ে দক্ষ অভিযাত্রীরাও মণিমুক্ত পাওয়া যাবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না। কিন্তু বাংলার ইতিহাস নিয়ে একটু ঘাঁটলে যে কারোর কাছেই উদ্ভাসিত হবে এক সমৃদ্ধশালী ও সম্ভাবনাময় জনপদের ইতিকথা, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

এ দেশের মাটি ছিল সোনার চেয়ে খাঁটি। একসময় টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত এ দেশের বাজারে। বেশি দিন আগের কথা নয়, মুঘল বাংলায়: সুবেদার শায়েস্তা খানের জামানায় (১৬৬৪-১৬৮৮)। যার স্মৃতি আজও বহন করে জীর্ণশীর্ণ মলিন দেহে পুরাতন ঢাকার বুড়িগঙ্গার কূলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মুঘলদের নির্মাণ কৌশলের অপূর্ব নিদর্শন লালবাগ কেল্লা। ওই লালবাগ কেল্লাকে কেন্দ্র করে একটি প্রচলিত ঐতিহাসিক গল্প আছে। ওই ঐতিহাসিক ঘটনায় বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বাক্ষরের চিহ্ন জ্বল জ্বল করছে। জানা যায়, সুবেদার শায়েস্তা খান লালবাগ কেল্লার পশ্চিম দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘোষণা করেন, চালের দাম আমার সময়ের মতো যার সময়ে এক টাকায় আট মণ পাওয়া যাবে তার জন্যই রইলো ওই দরজা পুনরায় খোলার অনুমতি। শায়েস্তা খানের ওই বন্ধ দরজা বেশি দিন বন্ধ থাকেনি। বাংলার নবাবি শাসনের পুরোধা মুর্শিদ কুলী খাঁর জামাতা সুজাউদদীন (১৭২৭-৩৯) ওই দরজা খোলার যোগ্যতা অর্জন করেন। অর্থাৎ তার সময়েও এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত।

হেরোডোটাসের নীল নদের দান যেমন মিসরকে প্লাবিত করে সমৃদ্ধিশালী জনপথে পরিণত করেছে, তেমনি এ দেশের নদ-নদী খাল বিল দেশের মাটিকে চাষাবাদের উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছে।

বাংলা যে কালেই যত সমৃদ্ধশালী হোক না কেন সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কখনও খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। সেই চর্যাপদের যুগ থেকেই বাংলার মানুষকে তাই মাছে-ভাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কারণ, বাংলার সম্পদ সবসময় পাচার হয়েছে অন্য দেশে, লন্ডন অথবা করাচির রাজকোষে।

আজ যে রিজার্ভ সংকটের কথা বলা হচ্ছে, তা এক নিমিষেই পূরণ করা সম্ভব। মালয়েশিয়া ও কানাডায় যারা অর্থপাচার করেছে তারা যদি ওই অর্থ ফেরত আনে তাহলে তার পরিমাণ আইএমএফ থেকে পাওয়া লোনের কয়েকগুণ হবে। সুইস ব্যাংকে রাখা অর্থ ফেরত এলে বাংলা হবে সিঙ্গাপুর।

কানাডার বেগমপাড়া বা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে বিনিয়োগে অর্থপাচারকারীদের নাম এই দেশের মানুষ জানতে চায়। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে এই দেশেই খেয়ে পরে এই মাটিতে বড় হয়ে আয় করে যারা সম্পদ পাচার করেছে তারা এ যুগের রাজাকার। সরকার যদি এ যুগের রাজাকারদের অর্থ ফেরত আনতে পারে তাহলে বিদেশি কোনও সাহায্য ছাড়াই রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। তাই সরকারের উচিত অর্থপাচারকারীদের একটি তালিকা তৈরি এবং গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাদের দেশদ্রোহী ঘোষণা করা। যেন যুগে যুগে দেশের মানুষ জানতে পারে কারা অর্থপাচার করেছিল। দেশের সংকটকালীন সময়েও ওই অর্থ ফেরত আনেনি কারা। বংশপরম্পরায় ইতিহাসে তাদের কলঙ্কিত নাম লেখা থাক। নতুন প্রজন্ম ওই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলেই বন্ধ হবে অর্থপাচার। তাই রিজার্ভ সংকটের এইকালে সরকারের কাছে দাবি থাকবে যারা অর্থপাচার করেছে তাদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে জাতির সামনে তুলে ধরা হোক। সবার সামনে খুলে দেওয়া হোক অর্থপাচারকারীদের মুখোশ।


লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ