X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইগোর জয়, রাজনীতির পরাজয়

প্রভাষ আমিন
০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:৪২আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:৪২

বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের সমাপনী আয়োজনের ভেন্যু নিয়ে হঠাৎ রাজনীতিতে সংঘাত, উত্তেজনা, অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি, তখনও ভেন্যু নিয়ে অচলাবস্থা কাটেনি। বিএনপি নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড়। আবার সরকারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়া অন্য কোথাও সমাবেশ করতে দেবে না বলে পণ করেছে।

তবে গত মঙ্গলবার দুইপক্ষকেই নমনীয় মনে হচ্ছিল। বিএনপিও প্রয়োজনে নয়া পল্টন ছাড়া ঢাকার অন্য সুবিধাজনক স্থানে সমাবেশ করতে সম্মত হয়েছিল, তবে সেটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নয়। সরকারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়াও কোনও খোলা জায়গায় সমাবেশ করতে দিতে রাজি হয়েছিল, তবে সেটা রাজপথে নয়। কিন্তু দুইপক্ষ খুঁজেও একমত হওয়ার মতো কোনও ভেন্যু পায়নি। ফলে পরিস্থিতি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। তবে হঠাৎ করে পরিস্থিতি পাল্টে যায় বুধবার। বিকালে নয়া পল্টনে সংঘর্ষের পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশটি কোথায় হবে, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।

একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না, স্রেফ ভেন্যু নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দুইপক্ষই এমন অনড় অবস্থানে চলে গেলেন কেন? আমার বিবেচনায় এটা স্রেফ ইগো। চলুন, দুই ভেন্যুর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করি। নয়া পল্টন বিএনপির প্রিয় ভেন্যু। দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কটি তাদের চেনা। গত তিন মাসে নয়া পল্টনে ছোট বড় ১১টি সমাবেশ করেছে তারা। এসব সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। এটা ঠিক নয়া পল্টনে সমাবেশ করলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয়। কারণ, নয়া পল্টনের মূল সড়ক বন্ধ থাকলে যানজট ছড়িয়ে পড়ে শহরের অনেকটা অংশে। তবে নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশের ব্যাপারে এলাকার মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কোনও কর্মসূচি থাকলে তারা নয়া পল্টন এড়িয়ে চলে। তারচেয়ে বড় কথা, নয়া পল্টনকে বিএনপি নিরাপদ মনে করে। কারণ, নয়া পল্টনের রাস্তার আশপাশে অন্তত ২৫-৩০টি গলি আছে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলেই নেতাকর্মীরা নানান গলিপথে পালাতে পারেন। তবে নয়া পল্টনকে ইস্যু বানিয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা যখন ঘোষণা করলেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে তারা ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ লোকের সমাগম করবেন; তখন সরকার সেটিকে ইস্যু হিসেবে নিলো।

তাদের যুক্তি হলো, ১০ লাখ লোক তো আর নয়া পল্টনে জায়গা হবে না। তারা যেন আরও বড় কোনও জায়গায় সমাবেশ করে। সরকার প্রথমে টঙ্গীতে তুরাগে বিশ্ব ইজতেমা মাঠে বা পূর্বাচলে সমাবেশ করার ব্যাপারে পরামর্শ দেয়। কিন্তু বিএনপি ঢাকার ভেতরে সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় থাকায় সরকার কিছুটা পিছিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দেয়। কিন্তু বিএনপি সোহরাওয়ার্দীও চায়নি। তারা নয়া পল্টনেই সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় থাকে। কিন্তু পুলিশের অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করতে গেলে সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকে। যেটা সমাবেশের তিন দিন আগেই ঘটে গেছে। আর সংঘর্ষে প্রাণ গেছে একজনের, আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক, গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ৩০০ জনকে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, নয়া পল্টনে বিএনপি সমাবেশ করতে দিলে কী এমন সমস্যা হতো।  আগের তিন মাসের ১১টি সমাবেশের চেয়ে এবারের সমাবেশটি না হয় একটু বড় হতো। পুরো সমাবেশ সামাল দিতে না হয় পুলিশের একটু বেগ পেতে হতো। কিন্তু এখন তো চার দিন ধরে পুলিশকে নয়া পল্টন সামাল দিতে হচ্ছে। সরকারের ভয়, বিএনপি যদি সমাবেশের নামে হেফাজতের মতো টানা অবস্থানে চলে যায়, তখন পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কিন্তু হেফাজতের মতো উগ্রদের শাপলা চত্বর থেকে সরাতে যেখানে সরকারকে কোনও বেগ পেতে হয়নি, সেখানে বিএনপিকে এত ভয় কেন।

আগের ৯টি বিভাগীয় সমাবেশ তো তারা শান্তিপূর্ণভাবেই করেছে। বিএনপির মাঝারি সারির নেতারা অনেক হম্বিতম্বি করলেও নীতিনির্ধারকরা তো বারবার বলছেন, ১০ ডিসেম্বর সরকারকে বিপাকে ফেলার কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই। ১০ ডিসেম্বর তাদের আরেকটি সমাবেশ মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। তারচেয়ে বড় কথা, একটি সমাবেশেই বিএনপি সরকার পতন ঘটিয়ে ফেলবে, সরকার নিজেদের এত দুর্বল ভাবছে কেন? বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে এখন দেশজুড়ে যে উত্তেজনা, দেশে-বিদেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; সমাবেশটি নয়া পল্টনে করতে দিলে তেমন কিছুই হয়তো হতো না। বিএনপি হয়তো একদিন কাভারেজ পেতো। কিন্তু এখন তিন দিন ধরে পুলিশের নির্মমতার কথা বলতে থাকবে। মিডিয়ার অনেকটাই বিএনপি অধিকারে।

এবার আসি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ব্যাপারে। একসময় রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ হতো পুরোনো ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে। তারপর সেটা চলে আসে পল্টন ময়দানে। পাশাপাশি বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সাবেক রেসকোর্সের খোলা ময়দানেও বড় বড় সমাবেশ হতো।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণও করেছিল এই উদ্যানেই। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সমাবেশটিও বঙ্গবন্ধু করেছিলেন এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। তাই এই উদ্যানের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। আগামী ২৪ ডিসেম্বর এখানে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হবে। সেই কাউন্সিলকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এখানে নানা অনুষ্ঠান করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে গত কয়েক দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাধিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। বিএনপি বারবার বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে তারা নিরাপদ মনে করছে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে যেখানে বারবার যাচ্ছেন, সেই মাঠকে অনিরাপদ মনে করার যুক্তি কী? পুলিশ অনুমতি দেওয়া ছাড়াও সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ব্যাপারে যথেষ্ট ছাড় দিতেও তৈরি ছিল। বিএনপির সমাবেশের প্রস্তুতির জন্য ছাত্রলীগের সম্মেলন ৮ ডিসেম্বরের বদলে ৬ ডিসেম্বরেই শেষ করে ফেলেছে। বিএনপির আগের বিভাগীয় সমাবেশগুলোর সময় পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হলেও এবার প্রধানমন্ত্রী নিজে কোনও ধরনের পরিবহন ধর্মঘট বা পাল্টা কর্মসূচি না করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি সরকারের এই ছাড়ের সুবিধাটুকু গ্রহণ না করে নয়া পল্টনের ব্যাপারেই অনড় থাকে। ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তাছাড়া উদ্যানটি ঘেরাও করা খাঁচার মতো। এসব যুক্তিতে বিএনপি বারবার নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে আনছিল। কিন্তু সরকার নিজে যেহেতু অনুমতি দিয়েছে এবং আন্তরিকতার প্রমাণ রেখেছে; সেখানে নিরাপত্তার দায়টিও তাদের। আর সরকার কঠোর হলে যেকোনও জায়গাই নিরাপদ নয়, তার প্রমাণ তো বুধবারেই পুলিশ দিয়েছে। তাছাড়া বিএনপি আগেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে। ১০ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?

আমার বিবেচনায় বিএনপিকে নয়া পল্টনে সমাবেশ করতে দিলেও রাজনীতিতে কোনও ওলটপালট হয়ে যেত না। আবার বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলেও তাদের বিশাল কোনও ক্ষতি হতো না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুইপক্ষই গো ধরে রাজনীতিকে অপ্রয়োজনে উত্তপ্ত করে তুলছেন। এখানে ইগো ছাড়া কারও কোনও যুক্তি খুঁজে পাইনি। নিজেদের ইগোকে জেতাতে গিয়ে দুইপক্ষই রাজনীতিকে হারাতে বসেছেন। প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
বাজেট ২০২৪-২৫পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কাউন্সিলর-যুবলীগ নেতার সংঘর্ষে যুবক নিহত
টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কাউন্সিলর-যুবলীগ নেতার সংঘর্ষে যুবক নিহত
অনিবন্ধিত ও অবৈধ নিউজ পোর্টাল বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
অনিবন্ধিত ও অবৈধ নিউজ পোর্টাল বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ