X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় বিএনপির রূপরেখা ও বাস্তবতা

আমীন আল রশীদ
২১ ডিসেম্বর ২০২২, ২১:৩৫আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ২১:৩৫

বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, পুরো শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রিক তথা প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিক। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা এবং তাঁর দায়িত্ব পালনে মেয়াদের কোনও সীমারেখা না থাকাকে যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে উল্লেখ করা হয়, তার সঙ্গে দ্বিমত করার লোক কম।

অবশ্য রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৫০(২) অনুচ্ছেদ বলছে, একটানা হোক বা না হোক, দুই মেয়াদের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি পদ থাকতে পারবেন না। কিন্তু নির্বাচিত হলে একজন ব্যক্তি আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেন। এখানে তাঁর কোনও মেয়াদের সীমাবদ্ধতা নেই।

সংসদীয় পদ্ধতি চালুর প্রাক্কালে সংবিধানে যে ১২তম সংশোধনী আনা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এতটাই নিরঙ্কুশ করা হয় যে পুরো রাষ্ট্র ও সরকার কাঠামোয় রাষ্ট্রপতিকে একটি আলঙ্কারিক পদে পরিণত করা হয়। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার বাইরে কোনও নীতিনির্ধারণে আদতে তাঁর করার কিছুই নেই। অথচ ওই সময়ে যদি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য রাখার একটি বিধান যুক্ত করা হতো, তাহলে পরবর্তীকালে দেশে যেসব রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তার অনেকগুলোই এড়ানো যেত বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, তখন রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে বটে, তখন রাষ্ট্রপতির আদৌ কিছু করার এখতিয়ার আছে কি না—সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।

এরকম বাস্তবতায় বিএনপি সম্প্রতি ‘রাষ্ট্র সংস্কার’ বা তাদের ভাষায় ‘মেরামতের’ জন্য যে ২৭ দফার রূপরেখা দিয়েছে, তার ৫ নম্বর পয়েন্টে বলেছে, ‘পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করিতে পারিবেন না।’ দেখা যাচ্ছে, বিএনপি সংবিধানের ৫০(২) অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্রপতির মতো প্রধানমন্ত্রীর পদেরও মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করে দিতে চায়। তবে রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ সম্পর্কে বিদ্যমান সংবিধানে বলা হয়েছে, পরপর হোক বা না হোক, কেউ দুই মেয়াদের বেশি এই পদে থাকতে পারবেন না। কিন্তু বিএনপি যে রূপরেখা দিয়েছে, সেখানে  বলছে পর পর দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবে না। তার মানে পর পর দুই মেয়াদ থাকার পরে একটি বিরতি দিয়ে আবার তিনি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এতে যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে এই বিধানটি বিএনপি সংবিধানে যুক্ত করতে চেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেটি পুরোপুরি সফল হওয়া কঠিন। বরং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে পর পর হোক বা না হোক, দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না—এমন বিধান করা উচিত।

তবে শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়াই নয়, বরং এই দুজনের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করাও জরুরি। কেননা, বিদ্যমান সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তাতে তিনি একইসঙ্গে সংসদ নেতা, দলীয় প্রধান, রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাও ভোগ করেন।

যেমন কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁর অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। এই বিধান পড়ে এটি মনে করার কোনও কারণ নেই যে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কেননা, নির্বাচনে জয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেটিই স্বীকৃত। রাষ্ট্রপতির পক্ষে এখানে অন্যথা করার সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি কে হবেন, কার্যত সেটিও রাষ্ট্রপতি ঠিক করেন না। কারণ, প্রধান বিচারপতি কে হবেন, সেটি নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার না হলেও এটি অনেক বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।

কোনও আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করা বা কারও সাজা মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার  যে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে, সেখানেও তিনি স্বাধীন নন। বরং প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই তিনি কাউকে ক্ষমা করেন।

জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী দিনে রাষ্ট্রপতি যে ভাষণ দেন, সেটিও মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হতে হয়। অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ তাঁকে যেরূপ কথা বলার অনুমতি দেবেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি কেবল ততটুকুই বলবেন। সাধারণ বিলের ব্যাপারে মতামত দিতে পারলেও অর্থবিলে রাষ্ট্রপতি কোনও মতামত বা পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করে সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন না। সংসদ যা পাস করবে রাষ্ট্রপতি তাতেই সই দিতে বাধ্য। আবার তিনি যদি কোনও বিলে সই নাও করেন, তাহলে ১৫ দিন পরে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদিত হয়ে যায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি সই করেছেন বলে গণ্য হবে।

বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গের (আইন, বিচার, নির্বাহী) মধ্যে আইন ও নির্বাহী বিভাগ অভিন্ন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে সংসদ নেতা এবং দলীয় প্রধান। আবার রাষ্ট্রপতিকে সব কাজ করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। এমনকি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে হলেও সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ প্রয়োজন। অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী আসলে রাষ্ট্রপতিও। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংসদকে যখন যে ধরনের আইন প্রণয়নের নির্দেশ দেবেন, সংসদ সেটি করতে বাধ্য। অর্থাৎ বিদ্যমান সংবিধান কেবল প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারই নয়, বরং এটি এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিকতারও রক্ষক।

সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা জরুরি এবং সেখানে রাষ্ট্রপতি পদের মতোই প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদও নির্ধারিত করে দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে ক্ষমতায় ভারসাম্য রাখার জন্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া দরকার। যেকোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাকে যদি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়, তাহলে সেখানে কোনও ভারসাম্য থাকে না। বরং কিছু বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা থাকা উচিত। অতএব, বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের যে রূপরেখা দিয়েছে, সত্যি সত্যিই সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলে সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন লাগবে। তাদের এই রূপরেখার এক নম্বরেই অবশ্য ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’গঠনের কথা বলা হয়েছে। যদিও সংবিধান সংশোধন করতে গেলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে।

বিএনপি ২৭টি দফা সংবলিত যে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছে, সেটি অনেক ভালো কথার সমাহার। তারা যেসব পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, জনগণ সেসব পরিবর্তন চায় এ কথা সত্য; কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন যে খুব কঠিন, সেটি আরও বেশি সত্য। তাছাড়া ভোটের আগে প্রতিটি দল তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় যাওয়ার পরে সেখান থেকে যে অনেক দূরে সরে যায় এবং অনেক প্রতিশ্রুতি তাদের ইশতেহারের সাদাকালো অক্ষরে অসহায় হয়ে পড়ে থাকে, এটিও নির্মম বাস্তবতা। ফলে বিএনপি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলো শুনতে ভালো। কিন্তু এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রথমে তাদের সরকার গঠন করতে হবে। সরকার গঠন করতে হলে তাদের নির্বাচনে জয়ী হতে হবে। তারা বিশ্বাস করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা জয়ী হবে। কিন্তু সেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলেও সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন সেই সংশোধনী আনবে? বিএনপি ও তাদের শরিকরা কি আওয়ামী লীগকে বাধ্য করতে পারবে? যদি না পারে এবং আওয়ামী লীগ যদি সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান ফিরিয়ে না আনে এবং যদি বিএনপি ক্ষমতায় না আসে, তাহলে তারা এই রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পারবে না।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে; কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে; কারা বিজয়ী হবে এবং কারা সরকার গঠন করবে—সেটি এখন আন্দাজ করা গেলেও নিশ্চিত নয়। তবে যারাই সরকার গঠন করুক না কেন, রাষ্ট্রে যে সংস্কার লাগবে; রাষ্ট্রের অনেক জায়গায় যে বড় বড় ক্ষত হয়েছে এবং সেখানে যে মেরামত লাগবে—সে বিষয়ে ভিন্নমতের সুযোগ কম। সুতরাং, বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না; না গেলে কী হবে; তারা সরকার গঠন করতে পারবে কি পারবে না—সেটি এখনও নিশ্চিত না হলেও দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা যে মনে করছে রাষ্ট্রের সংস্কার প্রয়োজন—এটিও কম কথা নয়। তবে তাদের উচিত হবে এই উপলব্ধি তথা আত্মসমালোচনা করা যে এখন তারা রাষ্ট্রের যেসব গর্ত ভরাটের কথা বলছে, সেই গর্তগুলো তৈরি হওয়ার পেছনে তাদের দায় কতখানি? কারণ, তারাও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। জনগণ তাদেরও দেখেছে। সুতরাং এখন ক্ষমতার বাইরে আছে বলে সুন্দর সুন্দর কথা বলছে, ক্ষমতায় গেলে চেহারা পাল্টে যাবে কি না—সেটিই প্রশ্ন।

এখন তারা তাদের রূপরেখায় বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু অতীত ইতিহাস বলছে, এরকম প্রতিটি কালা কানুনই যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তারা তাদের প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সুতরাং ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই আইন বাতিল করবে নাকি বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে—সেটি এখনই বলা মুশকিল। তবে তারা যে অন্তত এই আইনটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে; তারা যে তাদের ২৭ দফা রূপরেখায় দুর্নীতি দমনে ন্যায়পাল নিয়োগসহ নানারকম সংস্কারের কথা বলেছে, এটিরও রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে।

সর্বোপরি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল যে ইশতেহার ঘোষণা করবে, সেখানে বিএনপির এই রূপরেখার কোনও প্রভাব থাকবে কিনা—সেদিকে দেশবাসীর নজর থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা, রূপরেখা কিংবা ইশতেহার অথবা সমাবেশের মঞ্চে অনেক কথার ফুলঝুরি ফোটানো যায়। বাস্তবতা ততটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বরং রাজনৈতিক নেতাদের বিরাট অংশের কথা ও কাজের মধ্যেই কোনও মিল থাকে না।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
ভ্যাটেই মিলবে রাজস্ব, অথচ ভ্যাট বাড়াতে অনীহা
বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
গ্লোবাল স্কিলস ফোরামে বক্তারাবাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগের ফল দৃশ্যমান হচ্ছে
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
তীব্র গরমে পানি চাইতে চাইতেই ট্রাফিক পুলিশের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ