১৯৯০ দশকের শুরুতে একটি টিভি বিজ্ঞাপন দর্শকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এতে দেখা যেত একজন মানুষ একটি চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা, তার চোখও বাঁধা। নেপথ্যে একটি কণ্ঠস্বর বর্ণনা করতো: ‘আমাদের হাত বাঁধা নেই, আমাদের চোখ খোলা... আমরা বলতে পারি।’
এটি ছিল ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করা জনপ্রিয় দৈনিক আজকের কাগজের বিজ্ঞাপন, যা কিনা বাংলাদেশে কোনও সংবাদপত্রের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের প্রথম উদাহরণও বটে। এ ধরনের একটি প্রচার-উদ্যোগ সত্যিই ব্যতিক্রমী ছিল। তবে, ‘ব্যতিক্রমী’ বা ‘অনন্য’ হওয়ার ক্ষেত্রে আজকের কাগজের জন্য এটা কেবল একটা শুরু ছিল।
নাঈমুল ইসলাম খানের সম্পাদনায় একঝাঁক তরুণ-উদ্যমী সংবাদকর্মী নিয়ে আজকের কাগজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আজকের দিনের অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক তাদের কর্মজীবনের শুরুতে এই সংবাদপত্রটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অনেকের সাংবাদিকতার শুরুটাও ছিল এখানেই। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত অনেক সাংবাদিকও অন্য সংবাদমাধ্যমে কাজ করার পাশাপাশি আজকের কাগজে নিয়মিত কলাম লিখতেন। সংবাদপত্রটির প্রকাশক ছিলেন সদ্যপ্রয়াত কাজী শাহেদ আহমেদ, যিনি পরবর্তীতে এর প্রধান সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
“অগ্রসর পাঠকের দৈনিক” এবং “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নির্ভীক কণ্ঠস্বর” স্লোগানে যাত্রা শুরু করা আজকের কাগজ শুরু থেকেই ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। আজকের কাগজের এই পাঠকপ্রিয়তার পেছনে ছিল মূলত প্রকাশিত আধেয়’র গুণগত মান। একইসঙ্গে পৃষ্ঠাসজ্জার ক্ষেত্রেও পত্রিকাটি নতুন একটি ধারা চালু করে। আজকের দিনে মূলধারার জাতীয় দৈনিকগুলোতে যে ধরনের পৃষ্ঠাসজ্জা দেখা যায়, তা আজকের কাগজের অবদান। এর সঙ্গে তুলনা করলে আজকের কাগজ-পূর্ব যুগের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর পৃষ্ঠাসজ্জাকে প্রায় বৈচিত্র্যহীন বললেও অত্যুক্তি হয় না।
বর্তমানে আমরা প্রায় প্রতিদিনই দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সঙ্গে নানা ধরনের ‘সাময়িকী’ বা ‘সাপ্লিমেন্ট’ পেয়ে থাকি। প্রচার সংখ্যার শীর্ষে থাকা সংবাদপত্রগুলোর প্রত্যেকেরই রয়েছে এক বা একাধিক জনপ্রিয় সাপ্লিমেন্ট যা সপ্তাহ-অন্তর প্রকাশিত হয় ও মূল পত্রিকার সঙ্গে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বিতরণ করা হয়। এসব সাময়িকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এগুলোতে পাঠকের লেখক হিসেবে অংশগ্রহণ। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক পাতা, ব্যবসা ও অর্থনীতি নিয়ে এক বা একাধিক পাতা বরাদ্দ থাকা, খেলার জন্য অন্তত একটি পাতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুটি পাতার বরাদ্দ, অন্তত দু’পাতা জোড়া সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় – এসব কিছুই এখন খুব “সাধারণ” একটি জাতীয় দৈনিকের জন্য। এ ধারাটিও আজকের কাগজ শুরু করেছিল। আর একটি সংবাদপত্রের প্রধান যে কাজ – সমাজের মানুষকে চারদিকের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে হালনাগাদ করতে থাকা, নানা অন্যায়-অনিয়ম তুলে ধরা– তা আজকের কাগজ সবসময়ই করে এসেছে বলিষ্ঠভাবে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ১৯৯৪ সালে তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেন, আজকের কাগজের দ্রুত পাঠকপ্রিয়তা অর্জনের নেপথ্যে ছিল সরকার ও প্রশাসনের বিরোধিতা, সংবাদ বিন্যাস, পৃষ্ঠা, কলাম ইত্যাদির মেকআপ, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা বিষয়ের বিস্তারিত কাভারেজ, সম্পাদকীয় বাকসংযম, বিভিন্ন শ্রেণির পাঠকের চিন্তাচেতনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা, সংবাদপত্র কলামকে একটি বিশিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া ইত্যাদি। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) আয়োজিত কাজী শাহেদ আহমেদ স্মরণসভায়ও তিনি বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। পাশাপাশি একজন প্রকাশক-সম্পাদক হিসেবে কাজী শাহেদ আহমেদ কতটা বলিষ্ঠ ও সাহসী ছিলেন তাও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। এর প্রতিধ্বনি লক্ষ করা যায় স্বনামধন্য সাংবাদিক আনিস আলমগীরের স্মৃতিচারণায়। “দেশের শেষ সাহসী সম্পাদকের বিদায়” শিরোনামে তাঁর লেখাটি গত ২৯ আগস্ট প্রকাশিত হয় বাংলা ট্রিবিউনে।
তাঁর সে লেখায় আনিস আলমগীর একাধিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন যা সত্য প্রকাশে আজকের কাগজের নিরলস প্রচেষ্টা আর তার পেছনে প্রকাশক-সম্পাদক হিসেবে কাজী শাহেদ আহমেদের সাহসী ও অনমনীয় অবস্থানকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে। আনিস আলমগীরের লেখার প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ২০০১ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় আজকের কাগজ তাঁকে ইরাকে পাঠায় যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এটাও ছিল একটা “প্রথম”। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এর আগে আর কোনও সংবাদপত্র এমন উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা নেই।
ইউল্যাবে কাজ করার সুবাদে আজকের কাগজের প্রতিষ্ঠাতা-প্রকাশক-সম্পাদক এবং একইসঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শাহেদ আহমেদের সঙ্গে দু’একবার আলাপ করার সৌভাগ্য হয়েছে। বেশ ক’বছর আগে আমাদের কিছু শিক্ষকের সঙ্গে এমন এক অনানুষ্ঠানিক ও আকস্মিক কথোপকথনে কাজী শাহেদ আহমেদ আজকের কাগজ সম্পর্কে বলছিলেন, তিনি এবং আজকের কাগজ সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা কখনও ভুলে যাননি এবং এটা কেবল সত্য প্রকাশ এবং তা করতে গিয়ে প্রয়োজনে সরকার বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একসময় গণমাধ্যমগুলোর আয়ের অন্যতম উৎস ছিল সিগারেটের বিজ্ঞাপন। কিন্তু আজকের কাগজ কখনও সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার করেনি।
আজকের কাগজের স্লোগান “অগ্রসর পাঠকের দৈনিক” কেবল একটি স্লোগানই ছিল না, আজকের কাগজ সংশ্লিষ্টরা চিন্তা-চেতনায়ও অগ্রসর ছিলেন বলেই মনে হয়। এর প্রকাশ ছিল কাগজটির আধেয় পরিকল্পনায়, পৃষ্ঠাসজ্জায়, সম্পাদকীয় নীতিমালায়, আধেয় পরিকল্পনায় ও পাঠক সম্পৃক্ততায়।
অনেকগুলো বিষয় আজকের কাগজের হাত ধরেই বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে প্রবেশ করেছিল।
দু’হাজার সাত সালের সেপ্টেম্বরে আজকের কাগজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে, তার আগেই কাগজটি এ দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়ার মতো অবদান রেখে যায়।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক; মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।