X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতির বিচার ও ১৬৮ মামলার পুনঃশুনানি

আমীন আল রশীদ
০২ মে ২০১৬, ১৪:৫১আপডেট : ০২ মে ২০১৬, ১৫:১৪

আমীন আল রশীদ সাত মাসের ব্যবধানে দেশের বিচারিক ইতিহাসে দুটি বিরল ঘটনা ঘটলো। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। আর সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা শামসুদ্দিন চৌধুরীর ১৬১টি এবং সাবেক প্রধান বিচারিপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের ৭টি মামলা পুনঃশুনানির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। যদিও শামসুদ্দিন চৌধুরীর দাবি, প্রধান বিচারপতি প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
‘অবসরের পর রায় লেখা সংবিধানপরিপন্থী’- দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্তিতে এমন মন্তব্য করেছিলেন প্রধান বিচারপতি। গত জানুয়ারিতে সিলেট সফরে গিয়েও তিনি বলেছিলেন, ‘অবসরের পর আর কোনও বিচারপতিকে রায় লিখতে দেওয়া হবে না’ ফলে ১৬৮টি মামলার পুনঃশুনানির সিদ্ধান্ত তার ওই বক্তব্যের প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে সর্বোচ্চ আদালত যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যদি আদালত মনে করেন, ন্যায়বিচারের জন্য পুনঃশুনানি করতে হবে, তাহলে অবশ্যই তারা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
এইসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই বিচারপতিদের অপসারণ সম্পর্কিত একটি আইনের খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করার বিধান ফিরিয়ে আনার দুই বছরের মধ্যে এরকম একটি আইন হচ্ছে।
২.
গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি বরাবর লেখা চিঠিতে শামসুদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর (বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী) পেনশন কার্যক্রম বিষয়ে প্রধান বিচারপতি কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বরং তাঁকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, পেন্ডিং সব মামলার রায় লেখার পরে পেনশন কার্যক্রম শুরু করা হবে। প্রধান বিচারপতির এই সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক ও বিদ্বেষপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন বিচারপতি চৌধুরী। তাঁর দাবি, ব্যক্তিগত বিরাগের বশবর্তী হয়ে প্রধান বিচারপতি তাঁকে বিচার কাজ থেকে বঞ্চিত করে অসদাচরণ করেছেন, যা অভিশংসনযোগ্য।

আরও পড়তে পারেন: আওয়ামী লীগের সামনে কি ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে?

এই আবেদনটি যিনি জানিয়েছিলেন, নবম সংসদে তাঁকে অপসারণের জন্যই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি তুলেছিলেন সংসদ সদস্যরা। সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ভবন ইস্যুতে তৎকালীন স্পিকার মো. আব্দুল হামিদ সংসদে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেন হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। এমনকি স্পিকারের ওই বক্তব্যকে তিনি ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল’ বলেও মন্তব্য করেন। এরপর শামসুদ্দিন চৌধুরীর কড়া সমালোচনা শুরু হয় সংসদে। সিনিয়র সংসদ সদস্যরা ওই বিচারপতির বিচারের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি তোলেন। কেউ কেউ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আলোকে সংসদের ওপর ন্যস্ত করারও দাবি তোলেন। এই ঘটনার দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয় এবং তার আলোকেই ‘বাংলাদেশ ‍সুপ্রিম কোর্ট বিচারক (তদন্ত) আইন’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার; গত ২৫ এপ্রিল যার খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

ওইদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “সংবিধানের দায়বদ্ধতা থেকে এ আইন করা হচ্ছে। মূলত বিচারপতিদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের বিষয়টি আইনে রাখা হয়েছে।” তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তার তদন্ত হবে এ আইনের মাধ্যমে। তদন্তে কোনও বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য প্রমাণিত হলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হবে। এরপর সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, সেটি যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে।আবার কোনও বিচারকের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করলে খসড়া আইনে দুই বছরের জেল ও ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে।সচিব বলেন, “বিচারপতিদের যেন কোনও অসম্মান না হয়- সেই সুরক্ষা আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে।”

৩.
বিলের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনও বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্য সম্পর্কিত অভিযোগ জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে লিখিতভাবে দাখিল করতে হবে। দাখিলকৃত অভিযোগে সংশ্লিষ্ট বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করতে হবে। অভিযোগের নিচে অভিযোগকারীকে হলফনামা দিতে হবে যে, জ্ঞান ও বিশ্বাস মতে অভিযোগ সত্য। অভিযোগকারীকে অভিযোগের উৎস সম্পর্কেও তথ্য দিতে হবে। কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর স্পিকার ওই অভিযোগের সত্যতা তদন্তে ১০ জন সংসদ সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি করে সেখানে অভিযোগ পাঠাবেন। এই কমিটি গোপনীয়তা রক্ষা করে ৭ দিনের মধ্যে অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত করবে। প্রাথমিকভাবে সত্যতা না পেলে স্পিকার তা ক্লোজ করে দেবেন। আর সত্যতা পেলে স্পিকারকে লিখিতভাবে প্রতিবেদন দিতে হবে।

প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর জাতীয় সংসদের গোপন বৈঠক হবে। বৈঠকে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করার প্রয়োজন মনে করলে, তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হবে। এই কমিটিতে কোনও সংসদ সদস্য থাকবেন না। সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের একজন সাবেক বিচারপতি এই কমিটির চেয়ারম্যান হবেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিশিষ্ট নাগরিক বা আইনজ্ঞ কমিটিতে থাকবেন। তবে কমিটিতে থাকার জন্য সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের বয়স ৬৭ গ্রহণযোগ্য হলেও, অন্যদের ৬৭ বছরের বেশি হতে হবে। তিন সদস্যের এই কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্তই কমিটির সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে।

আরও পড়তে পারেন: কক্সবাজারে মাঠে পড়ে আছে ৫ লাখ টন লবণ

কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণ গোপনীয়ভাবে তদন্ত করা হবে এবং এরপর চার্জ ফ্রেম করা হবে। ১০ দিনের মধ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অভিযুক্তকে সুযোগ দিতে হবে। তার বক্তব্য শোনার পরে কমিটি যদি মনে করে অভিযোগের ভিত্তি নেই, তবে স্পিকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। আর অভিযোগের ভিত্তি থাকলে সেটিই সংসদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে এবং প্রতিলিপি বিচারকের কাছে পাঠানো হবে। এভাবে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর বিষয়টি সংসদে উঠবে। সেখানে দুই তৃতীয়াংশ সদস্য সম্মতি দিলে সংসদের ওই সিদ্ধান্ত যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি তাতে সই করার পরেই অভিযুক্ত বিচারককে অপসারণ করা হবে।

দেখা যাচ্ছে, কোনও বিচারপতিকে অপসারণ করতে হলে তার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও দীর্ঘ। আগের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের চেয়েও। ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হলেও এখানে সংসদের একচ্ছত্র ক্ষমতা নেই। বরং সংসদ সদস্যরা প্রাথমিক তদন্ত করবেন। সেখানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেটি যাবে তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে। সেই কমিটি যদি অভিযোগের সত্যতা পায় তখন সেটি সংসদে উঠবে ভোটের জন্য। আবার দুই তৃতীয়াংশ সদস্য ভোট দিলেই কেবল সেটি অনুমোদিত হবে।

আরও পড়তে পারেন: বাফুফে নির্বাচন নিয়ে যা হলো এবার

সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সম্মতি দিলেই একটি বিল পাস হয়। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের জন্য কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটই যথেষ্ট নয়; বরং সেখানে সংসদের মোট সদস্যের ‍দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন লাগে। একইভাবে কোনও বিচারককে অপসারণ করতে চাইলেও সংবিধান সংশোধনের মতো দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি লাগবে। যদি কোনও সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যায় খুব বেশি পার্থক্য না থাকে, তখন একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের যথেষ্ট তথ্য -প্রমাণ থাকার পরও কেবল দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের অভাবে তাকে অপসারণ করা যাবে না। কারণ কোনও বিচারককে অপসারণ করতে হলে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্য থাকতে হবে। এসব বিবেচনায় নিয়েই সরকার বলছে, বিচারপতিদের কোনও রকম যেন অসম্মান না হয়- সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে এই আইনে।

৪.
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ব্যক্তিগত বিরোধের বিষয়টি যখন প্রকাশ্য হয়, তখন এই প্রশ্নটি উঠেছিল যে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানজনক আসনে থাকা এ দুজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিরোধ এরকম প্রকাশ্য হওয়া উচিত ছিল কি না। সেই ধারাবাহিকতায় যখন শামসুদ্দিন চৌধুরীর ১৬১টি মামলার পুনঃশুনানির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি, সেটিও সেই বিরোধের ফল কি না, নাকি অবসরের পরে রায় লেখা যাবে না বলে প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন, সেটি প্রতিষ্ঠারই অংশ-তা সাধারণ মানুষের জানবার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো,যদি এতগুলো মামলার আবার পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয়, তাহলে বিচারপ্রার্থী মানুষ হয়রানির শিকার হবে কি না? কেননা, একজন বিচারপ্রার্থী হয়তো তার পক্ষে রায় পেয়েছেন; এখন পুনঃশুনানির পর যদি রায় তার বিরুদ্ধে যায়, তাহলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা নষ্ট হবে কি না? এক্ষেত্রে কোনও আইনি জটিলতার সৃষ্টি হবে কি না-সেটিও একটি প্রশ্ন। তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারকরা নিশ্চয়ই অনেক ভালো বোঝেন এবং জনগণ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, তারা সব সময়ই সে দিকটি বিবেচনায় রাখেন বলে মানুষ বিশ্বাস করে। কেননা বিচার বিভাগকে বলা হয় সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। সুতরাং বিচারকরা সব ধরনের বিতর্ক আর সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকবেন এবং মানুষ আদালতে গিয়ে হয়রানি নয়, বরং দলমত নির্বিশেষে সবাই ন্যায়বিচার পাবে-এমন প্রত্যাশাই সবার।

লেখক: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ