X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্লিজ এই ভালোবাসাকে শাস্তি দেবেন না

হারুন উর রশীদ
১৫ মে ২০১৬, ১৭:০৬আপডেট : ১৬ মে ২০১৬, ১৩:০৮

হারুন উর রশীদ ফেসবুকে ভিডিওটি আমিও দেখেছি কয়েকদিন আগে। হাত ধরাধরি করে গোল হয়ে, হাতে হাত রেখে, পায়ে পায়ে ঘুরছে জনাদশেক শিক্ষার্থী। বয়স কত হবে! ১৬ বা ১৭!
তারা সবাই মিলে এক বৃত্ত তৈরি করেছে। ভালোবাসার বৃত্ত । আর এই ভালোবাসার বৃত্তের মাঝখানে দু’জন। তাদের সহপাঠী। তারা সবাই চাইছে এই দু’জন সহপাঠী তরুণ-তরুণী ভালোবাসুক। পৃথিবীকে জানিয়ে দিক তাদের ভালোবাসা-প্রেমের সুবাসিত খবর। তারা যেন চিৎকার করে বলে, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি।’
প্রায় আড়াই মিনিটের ভিডিওটি একবার দেখার পর আমি বারবার দেখেছি। আর শিহরতি হয়েছি। হয়েছি আবেগে আপ্লুত। ভেবেছি এরা এমনভাবে ভালোবাসতে শিখলো কিভাবে! এমন নির্মল আর পরিমিত ভালোবাসা বোধ ওরা কোথায় পেলো! ওরদের স্যালুট। ওরা সবাই মিলে ভালোবাসাকে জয় করেছে। ভালোবাসার বৃত্তের মাঝের দুই টিএনএজ শেষ পর্যন্ত হাত ধরেছে। ভালোবাসায় চোখের জল ফেলেছে। আনত হয়েছে ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়, আবেগে।
আমার কাছে ভিডিওটি দেখে এটাকে কোন তরুণ-তরুণীর ব্যক্তিগত ভালোবাসা বলে মনে হয়নি। আমরা কাছে মনে হয়েছে, এই নষ্ট সমাজে এক টুকরো আলো। যেখানে ইভটিজিং আর নানা অনাচার, সেখানে ভালোবেসে জয় করার এই এক বিস্ময়কর প্রয়াস। যা শুধু যারা ভালোবাসেন তারাই পারেন। ভালোবেসে জয় করার এই ভিডিওচিত্রটি আমাকে নতুন করে চোখ খুলে দেয়।
ফেসবুকে এই ভিডিওটি হাজার হাজার শেয়ার হয়েছে। আর মন্তব্য পড়েছে শত শত। আমি বেশকিছু মন্তব্য মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। সেখানে প্রায় সব বয়সের ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যগুলো পড়ে আমি আরও বেশি বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। কারণ এই ভালোবাসার বৃত্ত নিয়ে কারও কোনও নেতিবাচক মন্তব্য  দেখিনি। মন্তব্যে কেউ তাদের অতীত ভালোবাসার স্মৃতিতে ফিরে গেছেন। আবার কেউ বলেছেন,‘ আমরা পারিনি তোমরা পেরেছ, স্যালুট’। একজন তো বলেই ফেলেছেন, ‘আমার জীবনে দেখা সেরা মিষ্টি প্রেমের কাহিনি।’
আমরা বন্ধুরাও ফেসবুকের এই ভালোবাসার ভিডিওটি নিয়ে কথা বলেছি। সবার মধ্যেই ভালো লাগার অনুভূতি। তারপর নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সেই ভালোবাসার ভিডিওটি নিয়ে আর তেমন কোনও খোঁজ রাখিনি।
আরও পড়তে পারেন: থানার আশপাশেই ছিনতাই রাজ্য!

কিন্তু রবিবার বাংলা ট্রিবিউনের রিসার্চ বিভাগের প্রধান শেরিফ আল সায়ার এসে খবর দিলেন, সেই শিক্ষার্থীদের কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যে দু’জন ভালোবাসার বৃত্তের মাঝে ছিল,  তাদের কলেজ থেকে টিসি দেওয়া হয়েছে। আর যে ৯ জন তাদের ঘিরে ভালোবাসার বৃত্ত তৈরি করেছিল, তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছে।

এরপর খবরটি পড়তে গিয়ে দেখি তাতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা কমার্স কলেজ কর্তৃপক্ষ গত ১২ মে এক অফিস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ওই ঘটনায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ও ৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হলো। এছাড়া কলেজের সব শিক্ষার্থীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’

এই শাস্তির খবরটিও এখন সংবাদ মাধ্যম হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। আর তাতে নানা মন্তব্যে আছে  তীব্র প্রতিক্রিয়া। তারা কেউই কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না। যারা মন্তব্য করছেন, তাদের মধ্যে কলেজের শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরাও আছেন। একজন অভিভাবকের মন্তব্য, ‘কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, তোমরা কোনও অপরাধ করোনি। আইএম প্রাউড অব ইউ।’

আমি নিজেও কমার্স কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে হতবাক। ওরা কী এমন শৃঙ্খলা ভঙ্গের কাজ করল! বিনীতভাবে অনুভূতির প্রকাশ যদি শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়, তাহলে ইট-পাথর আর কাঠ হয়ে থাকতে হবে আমাদের তরুণদের। অথবা তরুণ-তরুণীরা বিপথগামী হতে বাধ্য হবে। ভালোবাসার মার্জিত প্রকাশের চেয়ে পৃথিবীতে আর সুন্দর কী হতে পারে? এর চেয়ে সুশৃঙ্খল আর কী হতে পারে?

ভিডিওটি আরেকবার দেখুন। দেখবেন কী সুশৃঙ্খল আর বিনত সেই ভালোলাগা-ভালোবাসার প্রকাশ। এই তরুণ-তরুণীদের নিয়েতো গর্ব করা উচিত কলেজ কর্তৃপক্ষের। ওরাতো উদাহরণ তৈরি করেছে।

এর আগে গতবছরের মার্চে বগুড়ার ওয়ান্ডারল্যান্ড এমিউজমেন্ট পার্কে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ১৪৪ জন তরুণ-তরুণীকে আটক করেন। তাদের জরিমানা করা হয়। কান ধরে উঠবসের শাস্তি দেওয়া হয়। তাদের ছবি তুলে সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া হয়। তাদের অপরাধ, তারা পার্কে গিয়েছিল, পাশাপাশি বসে গল্প করেছিল। আর একে নাম দেওয়া হয়েছে ‘অসামাজিক’ কার্যকলাপ। যেমন কমার্স কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গ’। বগুড়ার ঘটনার পরে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ কি আফগানিস্তান?’

মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি, বয়োঃসন্ধিকালের ভাষা আমাদের বুঝতে হবে। কমার্স কলেজের এই ঘটনার পর আমি দু’জন মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, কমার্স কলেজ কর্তৃপক্ষ যা করেছে তা হলো—মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা অবস্থান নিয়েছে সুস্থতা এবং স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে। তারা চালিত হয়েছে সংকীর্ণ চিন্তা থেকে। শিক্ষার যে আলোকিত দিক, তা তাদের সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়নি। তারা এখনও এক ধরনের ‘ট্যাবু’ নিয়েই আছেন।

আর আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি,  ‘কলেজ কর্তৃপক্ষ মোটেই আইন মেনে কাজ করেননি। তারাই উল্টো বেআইনি কাজ করেছেন এই ১১ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করে। ভালোবাসার সুস্থ প্রকাশ কোনও দেশে কোনওকালেই বেআইনি নয়, হতে পারে না।’

তাহলে শিক্ষার্থীরা কি ন্যুইসেন্স সৃষ্টি করেছে? ভিডিওটি দেখুন। মোটেই না। ১১ শিক্ষার্থীর সঙ্গে আরও অনেকে ছিল, যারা স্বাগত জানিয়েছে। ভালোবাসার জয়ে আনন্দিত হয়েছে। তারাও ভালোবাসার সুরে সুর মিলিয়েছে এক অদ্ভূত মায়াবী পরিবেশে।

প্রিয় পাঠক, আমি  কালের পুরাণের কোনও লাইলি-মজনু বা শিরী-ফরহাদের কথা বলছি না। আমি বলছি সুস্থতার কথা। আমি বলছি স্বাভাবিতার কথা। ফেসবুকে যে ভিডিওটি শেয়ার হয়েছে তা আমাদের এক নতুন কথা বলেছে। আমাদের দেখিয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসার ব্যাকরণ। অনেকেই লজ্জা পেয়েছে, যারা ভালোবাসার নামে ইভটিজিং করে বা উত্ত্যক্ত করে। 

আমরা বলি, অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে কমার্স কলেজের ১১ শিক্ষার্থী এক নতুন আলো দেখিয়েছে। ভালোবাসার বৃত্ত গড়েছে। মানবিক এক ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছে 'লাভ সার্কেল'। এই ভালোবাসার বৃত্ত যত বাড়বে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম ততই প্রকৃত ভালোবাসা শিখবে। ইভটিজিং নয়, অ্যাসিড ছুড়ে নয়, হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে জয় করতে হয়। 

প্লিজ এমন ভালোবাসাকে শাস্তি দেবেন না। ওদের ভালোবাসাকে বাঁচতে দিন।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ