X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেরাটা পেতে হলে সেরাটাই দিতে হয়

সালেক উদ্দিন
১৬ মে ২০১৬, ১৮:১২আপডেট : ১৬ মে ২০১৬, ১৯:১৩

সালেক উদ্দিন অনেক দিন আগে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কষ্ট করে পড়ালেখা করা দুই ছাত্র চরম অর্থাভাবে পড়লে তারা ঠিক করলেন- বিখ্যাত পিয়ানোবাদক ইগন্যাসী প্যাডারিউস্কিকে নিয়ে একটি পিয়ানো বাজানোর আসর বসাবেন। এতে যে লাভ হবে তা দিয়ে পাওনা-দাওনা মিটিয়েও তাদের পড়াশোনার খরচ চলে যাবে। তারা পিয়ানোবাদক ইগন্যাসী প্যাডারিউস্কির কাছে গেলেন।  অনুষ্ঠানের জন্যে তাকে ২ হাজার ডলার দেওয়া হবে বলে চুক্তি করলেন।
কঠোর পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত তাদের অনুষ্ঠান হলো। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে অনেক চেষ্টায়ও ছেলে দুটি ১৬শ’ ডলারের বেশি উঠাতে পাড়লো না। এ অবস্থায় পিয়ানোবাদক ইগন্যাসি প্যাডারিউস্কিকে নগদ ১৬শ’ ডলার এবং বাকি ৪০০ ডলারের একটি গ্যারান্টি লেটার লিখে দিয়ে তারা বললেন- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাকি ৪০০ ডলার শোধ করে দেবেন। প্যাডারিউস্কি তাতে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি গ্যারান্টি লেটারটি ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। ১৬শ’ ডলার তাদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন- ‘এই অর্থ থেকে আগে তোমাদের খরচ মেটাও। তারপর যে অর্থ থাকবে তার থেকে ১০ শতাংশ হারে তোমাদের জন্য রেখে বাকি টাকা আমাকে দিও।’
ঘটনাটি এখানেই শেষ। তারপর অনেক বছর কেটে গেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধও শেষ হলো। প্যাডারিউস্কি তখন পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। সেদেশে তখন চরম দুর্ভিক্ষ। দেশের হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষের অন্ন সংস্থানে তিনি তখন পাগল প্রায়। দেশের মানুষদের জীবন বাঁচাতে তিনি আমেরিকার কাছে খাদ্য সাহায্য চাইলেন। হবাট হুডার তখন আমেরিকার খাদ্য সাহায্য বিভাগের প্রধান। তিনি প্যাডারিউস্কিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কয়েক হাজার টন খাদ্য পোল্যান্ডে পাঠিয়ে দিলেন।
খাদ্যাভাব প্রশমিত হলে হবাট হুডারকে ধন্যবাদ জানাতে ইগন্যাসি প্যাডারিউস্কি নিজেই প্যারিসে গেলেন।

আরও পড়তে পারেন: মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ক্ষেপিয়ে তোলা হয় গ্রামবাসীকে
সেখানে গিয়ে দেখলেন হবাট হুডার আর কেউ নন, সেই বহু বছর আগে প্যাডারিউস্কি পিয়ানো অনুষ্ঠান করে যে দুই ছাত্রকে সাহায্য করেছিলেন তাদেরই একজন এই হুডার।
প্যাডারিউস্কি বহু বছর আগে বিপদগ্রস্ত ছাত্র হুডার ও তার সহপাঠীকে যে সাহায্য করেছিলেন তার মধ্যে প্রতিদানের কোনও গন্ধ ছিল না। প্রতিদানের কোনও শর্তও ছিল না। সাহায্য করেছিলেন বিপদগ্রস্ত মানবসত্তাকে বাঁচানোর জন্যে। আর সেই সৎকর্মটিই বহু বছর পরে একটি মানবগুষ্টিকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছিল। অর্থাৎ প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়া কারো জন্যে সুন্দর কিছু করলে প্রকৃতির নিয়মেই এর সুন্দরতম প্রতিফলন তার কাছে ফিরে আসে।
ইতিহাসের এই অমর ঘটনাটি আবারো মনে পড়ে গেলো খুব সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আমাদের দেশের একটি জাতীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
ক’দিন আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ২৫০০ কোটি টাকা আত্নসাতের অভিযোগ এনে বক্তব্য রাখলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যাবাদী ও চোর বলে আখ্যায়িত করে বললেন- ‘খালেদা জিয়া এমন একজন মহিলা যিনি এতিমের টাকা চুরি করেছেন, যার ছেলে দুর্নীতির কারণে এফবিআই কর্তৃক পলাতক আসামি। তার মতো লোকের মুখে এ ধরনের কথা মানায় না।’ তবে তিনি এই টাকা কোথায় আছে তার প্রমাণ দেওয়ার কথা বললেন। টাকার হদিস পাওয়া গেলে তিনি সেই অর্থ এতিমদের দান করে দেওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করলেন।

আরও পড়তে পারেন: সাড়ে ৬ হাজার এটিএম বুথই অবৈধ!

এখানেই শেষ নয়, দশম জাতীয় সংসদের দশম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রসঙ্গটি টেনে বললেন- বিএনপি নেত্রীর দুই ছেলে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। তাদের মানিলন্ডারিং সিঙ্গাপুরের আদালতে প্রমাণিত। তারা অবৈধভাবে অর্থ বানিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। তাদের অর্থ আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিং আমেরিকার ফেডারেল কোর্টে প্রমাণিত হয়েছে। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে কালো টাকা সাদা করেছেন। তাদের পরিবার শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছে। বিএনপি নেত্রীর বড় ছেলেকে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে বিএনপি নেত্রীর ছেলের বন্ধুর নামে টাকা রাখা হয়েছে। এমনকি একটি হত্যা মামলায় কোটি কোটি টাকা ঘুষ বিনিময় হয়েছে। এতিমখানার জন্য টাকা নিয়ে সেই টাকা তারা আত্মসাৎ করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন- তারাই গ্রেনেড হামলা করে বোমা পুঁতে বিভিন্নভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এখন তার ছেলেকে হত্যার চেষ্টা করছেন। হত্যা-খুন করা তাদের পেশা।

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিজ ডিপার্টমেন্টে ২০১২ সালের ২৯ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজদের প্রোফাইল তুলে ধরা হয়। এই প্রোফাইলের মধ্যে বিএনপি নেত্রীর ছেলেদের নাম রয়েছে। আর বিশ্বসেরা অর্থ পাচারকারীদের যে নাম প্রকাশিত হয় সেখানেও তার ছেলেদের নাম আছে। দুর্নীতি করেছে বলেই ভাঙা সুটকেসে ছেড়া গেঞ্জি থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন তারা।

এরপর দুই পক্ষই চুপ। ভাবখানা এমন যে, যার যা বলার তা যেন বলা হয়ে গেছে, যার যেটা শোনার তাও যেন শোনা হয়ে গেছে। কারোরই কোনও প্রমাণের প্রয়োজন নেই। এটাই নিয়ম।

রাজনীতিতে এ ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি, গালাগালি নতুন নয়। এটা আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য জন্তু-জানোয়ারের নামসহ এহেন কোনও গালি নেই যা আমরা দেই না। তাইতো আমরা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকিকেও রাজাকার বলতে শুনি। আবার প্রতিউত্তরে বঙ্গবন্ধুকেও রাজাকারের কমান্ডার বলতে আমাদের বুক কাঁপে না। পরস্পরের প্রতি এই শ্রদ্ধাহীনতা থেকেই দেশে চলছে অসুস্থ রাজনীতি।

ক্ষমতা এমন একটা জিনিস যা ক্ষমতাবানরা মনে করে চিরস্থায়ী। এটা যে সবচেয়ে বেশি ক্ষণস্থায়ী তা ক্ষমতাধররা কখনোই ভাবেন না। তাইতো তাদের যা মনে হয় তাই বলে। যা করতে ইচ্ছে হয় তাই করে। আর বিরোধীরাও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যা বলা প্রয়োজন তাই বলে। সত্য অসত্যের ধার ধারে না।

কিন্তু প্রকৃতি বড় নির্মম। প্রকৃতি তার নিজস্ব গ্রামারে চলে। তার নিয়ম হলো যে যা দেয় প্রতিদানে তাই ফিরে পায়। তাইতো পোল্যান্ডের ইগন্যাসি প্যাডারিউস্কি বিপদগ্রস্ত মানবসত্তার কল্যাণে আমেরিকার হুডারকে সাহায্য করে যে সৎ কর্মটি করেছিলেন বহু বছর পরে সেটিই পোল্যান্ডের ক্ষুধার্ত মানবগুষ্টিকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছিল। এখানে দানটি বহুগুণ প্রতিদান হয়ে ফিরে এসেছে।

আরও পড়তে পারেন: ‘প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ায় শূলে চড়ানোর মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি’

আমাদের দেশেও তাই হয়। আমরা ক্ষমতাসীন পক্ষ বিরোধী পক্ষকে যে বাক্যমালা উপহার দেই, যে অত্যাচার-অনাচার নির্যাতন করি, কালের পরিবর্তে যখন বিরোধী পক্ষ ক্ষমতাসীন হয় তখনো সেই বাক্যমালা, সেই অত্যাচার-অনাচার নির্যাতনই বহুগুণ তীব্র হয়ে আবার ফিরে আসে সাবেক ক্ষমতাসীনদের ওপর। তাইতো সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বলতে শুনি- বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলের জয় ২৫০০ কোটি টাকা আত্নসাৎ করে বিদেশি ব্যাংকে রেখেছেন। জবাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে দেখি- খালেদা জিয়ার দুই ছেলে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন।

দিনে দিনে এটা এ দেশের সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। ফলে দানের প্রতিদানে যা আসছে তা সংঘাতময়। সংঘাত শুধু ধ্বংসই আনতে পারে কল্যাণ নয়।

এদেশের মানুষ রাজনীতিতে আর চুলাচুলি, কাদা ছোড়াছুড়ি দেখতে চায় না। তারা সংঘাতময় ধ্বংসের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান চায়। তারা আর গালাগালি করার গণতন্ত্র চায় না। তারা এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখতে চায় যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলাই রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয় বরং বিরোধী পক্ষের কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হয়। তারা কল্যাণের রাজনীতি চায়। তারা এটাও দেখতে চায়, স্বাধীনতা মানে বলার জন্যই যা খুশি তাই বলা নয় বরং স্বাধীনতা মানে নিজের যেমন বলার অধিকার থাকবে তেমনি অন্যের কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নীরবে অন্যের কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। প্রতিদানের অপেক্ষায় থাকতে হবে না। সেরা কর্মের সেরা প্রতিদান প্রকৃতির নিয়মেই দরজায় কড়া নাড়বে।

 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ