X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘ক্ষমা তোমায় চাইতে হবে নামিয়ে মাথা হে বিধাতা’

জোবাইদা নাসরীন
২৬ মে ২০১৬, ১৪:৩৪আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:০২

জোবাইদা নাসরীন এক.
ফেসবুকে ঘুরছে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের ছবি। প্রথমদিন আমি সেই ছবি দেখে চমকে ওঠি। আরে এ যে আমাদের পরেশ চন্দ্র আচার্য স্যার- নোয়াখালী সরকারি বালিকা উচচ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফেসবুকে আমার চোখ আটকে থাকলেও মন চলে যায় দুই যুগ আগের আমার স্কুল জীবনে। পরেশ স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। ওইতো দেখা যাচ্ছে আরতিদি'র মুখ। হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন বায়োলজির শিক্ষক নুসরাত আপা। মুখে দুশ্চিন্তার রেখা নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন 'কী-রে কাল স্কুলে আসিসনি কেন?' স্কুল ছাড়ার এতো বছর পরও যখন কোনও স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা হয়, তারা অনেকেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। এই কান্নার মানে অনেক। শিক্ষার্থীকে অনেক বছর পর কাছে পাওয়ার আকুলতা-কান্না। কী এক দুর্ভেদ্য অধিকারবোধের মায়া। অভ্যস্ত চোখ শিক্ষার্থীটিকে না দেখতে পাওয়ার বেদনা। একজীবনের সম্পর্ক। আমি নিশ্চিত, শতভাগ নিশ্চিত, ফেসবুকে যখন শিক্ষক শ্যামলের কানে ধরার ছবি ঘুরছিল তখন শ্যামল কান্তির অসস্মানিত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ আমাদের অনেককেই নিয়ে গিয়েছে তার কিছুদিন বা দীর্ঘদিন আগে ফেলে আসা স্কুল জীবনে। অনেকেরই ওয়ালে পোস্টকৃত কবি কাজী কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষকের মর্যাদা' কবিতাটি আমাদের শৈশবকেই মনে করিয়ে দেয়। এ যেন শ্যামল স্যার নয়, তারা দেখতে পেয়েছেন তাদের কোনও না কোনও প্রিয় শিক্ষকের মুখ। সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন।
এই প্রতিবাদ অনেকগুলো মোটা দাগের বাহাসের বিরুদ্ধে। সাংসদ সেলিম ওসমান অতি ভয়ঙ্কর 'মাস্তান সংস্কৃতি'র প্রকাশ ঘটিয়েছেন ধর্মীয় সুড়সুড়িকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে। শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনও প্রমাণের ধার না ধেরে নিজের মতো 'শাস্তি' দিয়ে ফেলেছেন এই আইনপ্রণেতা। এই রাজনীতির আগুনে তুষ সরবরাহ করছে কতিপয় অতি উৎসাহী গণমাধ্যমকর্মীও। শ্যামল কান্তি স্যারের কান ধরে ওঠবসের পেছনের কারণ জানাতে গিয়ে বিবিসি বাংলার রিপোর্ট থেকে শুরু করে নানা পোর্টাল বার বার সামনে এনেছে ধর্মীয় অনুভূতির প্রসঙ্গ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে শিক্ষার্থীরা প্রথমে বলেছে- স্যার ধর্মীয় অবমাননা করেননি, তাদের অনেকেই এখন ক্যামরায় হাজির হচ্ছেন নানা ভঙ্গিমায়, নানা গল্পের ঝুড়ি নিয়ে। হুংকার ছুড়ছে হেফাজতও। মজার বিষয় হলো, সেই স্কুল ছাত্রটি এখন হেফাজতের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে ধর্মীয় উস্কানিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। নতুন প্রসাদ নিয়ে হেফাজতের সাম্প্রতিক মুখ বাড়ানো ওসমান পরিবারের বিশেষ 'অবদান'। ওসমান পরিবারের সঙ্গে 'সবসময় পাশে থাকা'র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রধানমন্ত্রী তাহলে সেই পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন হেফাজতনামার প্রতিও অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন? নারায়ণগঞ্জে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ওসমান পরিবারের ওপর প্রধানমন্ত্রীর নির্ভরতা আর অন্যদিকে দেশব্যাপী স্থিতিশীলতার শর্ত হিসেবে হেফাজতের প্রতি সরকারের ছাড় অব্যাহত থাকবে? প্রধানমন্ত্রী দেশে ছিলেন না। তবে তার কয়েকজন মন্ত্রী বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখেননি। ইতোমধ্যে চাকরি ফেরত পেয়েছেন সেই শিক্ষক। ঘটনা ঘটার দিনই তাকে বহিষ্কার করে স্কুল কমিটির চিঠি, পরবর্তীতে 'ধর্মীয় অনুভূতি'কে আঘাত দেওয়ার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা, কেন জানি নানা প্রশ্ন তৈরি করে, যার বেশিরভাগরই জবাব মেলে না। তবে একটি বিষয় এখন খুবই স্পষ্ট বাংলাদেশে বোধ হয় সবচেয়ে সস্তা পণ্য 'ধর্মীয় অনুভূতি', যেটাকে সবচেযে বেশি সহজভাবে, স্বল্প সময় কিন্তু ব্যাপক পরিসরে এবং ঝড়ের গতিতে ব্যবহার করা যায়।

আরও পড়তে পারেন: শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ছাত্রের বক্তব্য অসংলগ্ন

দুই.
মানবিক গুণাবলির খরার সময়ে, মানুষের প্রতি মানুষের সমর্থন যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাতোষী, সেখানে শিক্ষক হেনস্তা এই প্রথম-এমন ধারণা ইতিহাসবিরোধী। হতে পারে এই হেনস্তার চরিত্র এখন অনেক ফানুসে। ধীরে ধীরে এই পটভূমি তৈরি করা হয়েছে। 'শিক্ষকরা জাতির বিবেক' এই জাতীয় ধারণা শুধুমাত্র ক্লিশেই নয়, রোমান্টিকও। তবে 'শিক্ষকরা ক্লাস নেন না, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান, কনসালটেন্সি কাজে ব্যস্ত থাকেন, দলবাজি করেন'- এগুলো এখন অনেকটা বহুল চর্চিত প্রবচন। শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যখন খোদ প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের সঙ্গে সচিবদের কাজের তুলনা করে বলেন, কোন কোন শিক্ষক নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বাদে কোথায় কোথায় ক্লাস নেন সবই তিনি জানেন, তখন 'শিক্ষকতা' বিষয়ে একটি খেলো শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ডিসকোর্স তৈরি হয় এবং এটি 'শিক্ষক' বিষয়ে পাবলিক বয়ান তৈরিতে খুঁটি হিসেবে কাজ করে। হ্যাঁ, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগ এখন মুখস্ত বচনের মতো ফেরে, সেগুলো একেবারেই মনগড়া, মিথ্যে এমন দাবি করছি না, তবে তা তেমনি মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ক্ষেত্রে হয়তো সত্য। হাতেগোনা কয়েকটি বিষয়ের শিক্ষকরাই শুধু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ পান, কনসালটেন্সি বা অন্যান্য বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পান আরও স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক। শিক্ষক আন্দোলন দমাতে পেপার স্প্রে, লাঠিপেঠা, কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার হরহামেশাই ঘটছে। সব সরকারের সময়েই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দ্বারা শিক্ষক লাঞ্চনাও ‌এখন আর সেভাবে আলোচনার বিষয় থাকছে না। এটাও যেন এখন 'ক্ষমতার দম্ভের কাছে' পরাজয়ের নৈমিত্তিক স্মারক। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকের প্রতি একজন সাংসদের এই নির্যাতন আকস্মিক নয়, আবার বিচ্ছিন্ন হিসেবে পাঠ্যও নয়।

এটা ঠিক যে, শিক্ষকতা ৯-৫ টা অফিস করার মতো কোনও পেশা নয়, এটি চব্বিশ ঘণ্টার দায়িত্ব। যিনি শিক্ষক, তাকে পড়তে হয়, পড়াতে হয়, গবেষণা করতে হয়, প্রবন্ধ লিখতে হয়। তাই শিক্ষকতা শুধু রোজগারের পেশা নয়, এটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক কিছু। অন্তত আমি মনে করি পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে দুনিয়া এবং বিভিন্ন ধরনের মানবিক সম্পর্কের ধারণা আমি পেয়েছে সেটির পেছনে বড় একটি ভূমিকা আছে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, শ্যামল কান্তি স্যারের বিষয়েও শিক্ষক নেতারাও কয়েকদিন ঝিমিয়েছেন। অবস্থা বিশ্লেষণে মনে হয়েছে কতিপয় মন্ত্রীর ইতিবাচক নড়াচড়া দেখে তারা তাদের নড়াচড়া স্থির করেছেন, পাছে আবার দলীয় নেতা বা মন্ত্রীরা তাদের ভুল না বোঝে! অন্যদিকে, প্রশ্ন জাগে শিক্ষক পরিচয়ের পরিসীমা নির্ধারণে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক কাতারে দেখতে অনাগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা? বর্ণবাদী রাজনীতি হয়তো এখানেও তুমুলভাবে কার্যকর। ক্ষমতার সঙ্গে সাত পাঁচ মিলিয়ে অবশেষে এলো কর্মসূচি! বরাবরের মতোই শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকলো প্রতিবাদে, ক্ষোভে।

তিন.

নারায়নগঞ্জের রাজনীতিতে ওসমান পরিবারের ক্ষমতার দাপট সম্পর্কে অজ্ঞাত মানুষজন কমই আছেন। যদি আমরা সেলিম ওসমানের কথাই ঠিক ধরি, শ্যামল স্যার ধর্ম অবমাননা করেছেন, তাহলে সেটির জন্য প্রচলিত আইন রয়েছে। তাকে চড় মেরে, কানে ধরে ওঠবস করিয়ে যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে, তার কারণ হিসেবে ধর্মীয় অবমাননার যুক্তি কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনও ধর্ম কারও বিরুদ্ধে অপরাধের কোনও প্রকার প্রমাণ ছাড়া তাকে অমর্যাদা করার অধিকার দেয় না। তাই প্রশ্ন জাগে কার আদেশে মসজিদের মাইকে সবাইকে আসতে বলা হলো? একজন আইন প্রণেতারতো আইন সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানার কথা। অথচ আরেকজনের মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার পরও তিনি এখনও তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা পর্যন্ত চাননি।

আরও পড়তে পারেন: মন ভালো করা একটি খবর, আশঙ্কা নেইতো!

'মানবিক মর্যাদা' প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ মতাদর্শের আদি অঙ্গীকার। কোনও আইনপ্রণেতা যখন সাম্প্রদায়িক কিংবা ধর্মীয় উস্কানি ব্যবহার করে আইনবহির্ভূতভাবে শিক্ষকের অমর্যাদা করেন, তখন বাংলাদেশের জন্মকালীন অঙ্গীকারের প্রতি অনুগত যে কোনও নাগরিকের জন্য তার বিচার চাওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected].

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
চাঁদপুরে লঞ্চে আগুন, হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত ১০
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ঈদযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত: জরিপ
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার বিকল্প নেই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ