X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাটের নিচে বা ঘুড়ি ওড়ানো

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৬ জুন ২০১৬, ১৩:৩৫আপডেট : ২৬ জুন ২০১৬, ১৬:৩৯

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আমাদের সাংবাদিকদের অনেকে ঘুড়ি ওড়ায়, কেউবা খাটের নিচে থাকে। এই বক্তব্যের একটি প্রেক্ষাপট আছে। নিশ্চয় অনেকের মনে আছে সেই বিখ্যাত মনির-রিমার কাহিনি। ১৯৮৯ সালের ৯ এপ্রিল স্ত্রী শারমিন রীমাকে হত্যা করেন মনির হোসেন। ঘটনার পরদিন তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৯০ সালের ২১ মে ঢাকার জেলা ও দায়রা আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
নিহত রীমা ছিলেন শহীদ সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদের মেয়ে। অন্যদিকে খ্যাতনামা ডাক্তার বাবা-মায়ের ব্যবসায়ী ছেলে ছিলেন মনির হোসেন। ১৯৮৯ সালে বিয়ের মাত্র তিন মাস পর ৯ এপ্রিল পুলিশ নরসিংদীর কাছাকাছি মিজিমিজি গ্রাম থেকে উদ্ধার করে রীমার লাশ। স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়ে খুন হন শারমিন রীমা।
এই ঘটনার পর কিছু কাগজে রমরমা কাহিনি ছাপা হয়েছিল, বিশেষ করে মনিরের সঙ্গে খুকু নামের আরেক মহিলার সম্পর্ক নিয়ে যত গল্প লিখেছিলেন কোনও কোনও রিপোর্টার, তখন থেকেই ‘খাটের নিচের সাংবাদিকতা’ বলে নতুন এক সাংবাদিকতার কথা জানতে পারে এদেশের মানুষ। দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতা করেছেন তারাও নতুন সাংবাদিকতা দেখেছেন এই ঘটনায়। এমনভাবে যৌনতার বর্ণনা ছিল সেসব রিপোর্টে, ধারণা করা হচ্ছিল, রিপোর্টার প্রতিদিন মনির-খুকু বা মনির-রীমার খাটের নিছে শুয়ে সব শুনেছেন।
আজ এতদিন পর আবার এ প্রসঙ্গ উঠেছে। তবে খাটের নিচে নয়, এবার কিছু অনলাইন আর পত্রিকার কাজ দেখে মনে হয়েছে তাদের রিপোর্টাররা আকাশে ওড়েন। উড়তে উড়তে তারা সব দেখেন এবং তাই তারাই সব জানেন। পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আখতারের স্ত্রী হত্যার তদন্ত যখন চলছে, তখন হঠাৎ করেই রমজান মাসের শনিবারটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেমন চটিচটি হয়ে উঠেছিল নতুন ঘরানার রসময়দের কল্যাণে। মিতুর পরকীয়ার কথা বলে, তার স্বামী বাবুল আখতারই হত্যার ছক কেটেছেন, এমন নিশ্চিত গল্প এক অসাধারণ দক্ষতায় প্রচার করেছেন তারা।

বাড়ির ছাদে উঠে কিংবা মাঠে ময়দানে গিয়ে মনের সুখে যারা ঘুড়ি ওড়ান তারাও এমনটা মনের মাধুরী মেশাতে পারেন না যতটা পেরেছেন এই সাংবাদিকরা। বহুদিন আগে শোনা kite flying journalism-এর প্রয়োগ দেখা গেলো এবার। কেমন এই সাংবাদিকতা? অক্সফোর্ড-এর A Dictionary of Journalism-এ বলা হয়েছে kite flying হলো A speculative story that is run, at least in part, to test the water or to draw out a reaction।

এই speculative story বা আন্দাজ করা গল্পের কিছুটা হলেও ভিত্তি থাকে। এখানে তা ছিল না। তাই একসময় অনলাইন থেকে সেই স্টোরি (নিউজ স্টোরি নয়) সরিয়েও নেওয়া হয়, এক সময় যখন জানা যায় বাবুল আখতার বাসায় ফিরেছেন। কিন্তু যত ঘণ্টা ছিলেন ততঘণ্টা যে যন্ত্রণা পেয়েছেন মিতুর স্বজনরা এবং বাবুল আখতার নিজে, তার দায় নেবে কে? উন্নত সমাজ, এমনকি পাশের দেশ ভারতে হলেও, মামলা হতো কোটি কোটি টাকার। বলতেই হবে বাংলাদেশের মানুষ আসলে অনেক সহনশীল।

সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যখন কথা ওঠে, তখন অনেক কিছুই বলি আমরা। বলতে চাই পুলিশ যেমন ভালো পুলিশ এবং খারাপ পুলিশ হন, চিকিৎসক যেমন ভালো ও খারাপ দুই প্রকারই হন, শিক্ষকদের মধ্যেও যদি প্রকারভেদ থাকতে পারে, তবে সাংবাদিকদের মধ্যেও ভালো ও খারাপ থাকবে না কেন? বাজার অর্থনীতি যেমন গ্রামীণ বাংলাদেশকে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বদলে দিয়েছে অনেকটাই, সেভাবে সংবাদমাধ্যমও—কি প্রিন্ট, কি ইলেকট্রনিক—এসেছে এক বিপুল পরিবর্তন। এমন বাস্তবতায় সম্পাদকরা হয়ে উঠছেন করপোরেট এডিটোরিয়াল ম্যানেজার। সাংবাদিকরা হলেন করপোরেট জার্নালিস্টিক এক্সিকিউটিভ। তাই বাজার ধরার, এগিয়ে থাকার দৌড়ে এত নীতি নৈতিকতার ধার ধারে কে?

এখন অনেক টেলিভিশন, বেতার, তার চেয়েও বেশি পত্রিকা এবং অনেক অনেক বেশি অনলাইন। সবার মাঝে এক প্রতিগোগিতা। কে কার আগে ব্রেকিং দেবে। এ এক নয়া ইঁদুর প্রতিযোগিতা। ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রবল নিন্দার ঝড় ওঠে। কিন্তু নিন্দা করলে কী হবে, সেই প্রতিযোগিতায় কোনও খামতি থাকে না। কিছু অনলাইন বেশি করছে, কিন্তু পত্রিকা বা টিভিও কম যাচ্ছে না। এই সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হলো সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো, অনলাইনের শেয়ার বাড়ানো বা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়ানো। ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকৰ্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্ৰতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেঙ্কারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্ৰচার করা, কেলেঙ্কারি না থাকলে নিজেরাই রচনা করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি  কোনওটাতেই এখন আমাদের জুড়ি নেই।

একটা খবর প্রকাশ হওয়ার আগে বেশ কয়েকটা স্তর পার হতে হয়। খবর প্রকাশের এসব স্তর থাকার পরও যখন খবরে অপেশাদারী আবেগ, অনৈতিকতা, কল্প জগতের গল্প দেখতে পাওয়া যায়, তখন গণমাধ্যম সম্পর্কে মানুষ শুধু একটাই উপসংহার টানে—সাংবাদিকরা দায়িত্বহীন। ভাবতে বাধ্য হয় গণমাধ্যম কর্মীদের কি পরিবার, পরিজন বলে আসলে কিছু আছে? থাকলে এমনটা করে কিভাবে?  

স্টোরি নয়, নিউজ স্টোরি তাই সংবাদ কোনও কল্প জগতের গল্প নয়। তাই লেখার আগেই যাচাই করতে হয় যা প্রচার বা প্রকাশ করতে হচ্ছে তা কতটুকু সত্য, এবং সেই সত্যতা কতটুকু প্রমাণিত।

পরকীয়ার গল্পে যত মনোযোগী বা উৎসাহী ছিলেন রিপোর্টার, ততটা কি ছিলেন বাবুল আক্তারের ১৫ ঘণ্টার নিরুদ্দেশের ব্যাপারে? ছিলেন না, কারণ সেটা করতে গেলে ঘুড়ি ওড়ানো যায় না।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন

আরও পড়তে পারেন: ‘গণমাধ্যমে অনেক কিছু প্রচার হয়, সবকিছু সত্য নয়, আবার মিথ্যাও নয়’

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ