X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ উপহার ছেলের লাশ

আহসান কবির
০৭ জুলাই ২০১৬, ১৩:২৪আপডেট : ০৭ জুলাই ২০১৬, ১৪:০৮

আহসান কবির আমার বাংলাদেশ কখনও এমন ছিল না।
কিন্তু এই মৃত্যু উপত্যকাই এখন আমার দেশ!
যে দেশে সতেরজন বিদেশি মেহমানকে ধর্মের নামে জবাই করে হত্যা করা হয় সেই দেশে আমি জন্মেছিলাম!
এই সতেরজনের কয়েকজন হয়তো ছিলেন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে সারা পৃথিবীতে পরিচিত করার পেছনে এদের অবদান ছিল।
কয়েকজন হয়তো ছিলেন রেল-যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশকে ভালোবেসেই তারা এসেছিলেন! হয়তো এই সতেরজনের কেউই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। কিন্তু বাঙালির ঐতিহ্য অনুযায়ী যেখানে সর্বোচ্চ সন্মান পাওয়ার কথা মেহমানদের, সেখানে তাদেরকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে!
ইতালির সিমেনো মন্তির সঙ্গে কি পুলিশের এডিসি রবিউলের দেখা হয়েছে মৃত্যুর পর? সিমেনো সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। অন্তঃসত্ত্বা এই মানুষটাকে জবাই করতে বুক কাঁপলো না জঙ্গিদের? খুব জানতে ইচ্ছে করছে কোনও জঙ্গির মনে তখন মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছিল কিনা। জানতে ইচ্ছে করে সিমেনোর সন্তানটা কি পরকালে জন্ম নেবে? রবিউল কি পরম মমতায় সেই সন্তানকে কোলে তুলে নেবেন? তখন কি রবিউলের অনাগত সন্তানের কথা মনে পড়বে, যে সন্তানকে তিনি দেখে যেতে পারেননি? নাকি রবিউলের ভাইয়ের কথাটাই আসল সত্য? খুব কষ্ট নিয়ে রবিউলের ভাই বলেছিলেন- ঈদে মায়ের জন্য ভাইয়ের লাশটা উপহার হিসেবে নিয়ে যাচ্ছি!
নিজের টাকা খরচ করে প্রতিবন্ধীদের জন্য একটা স্কুল খুলেছিলেন রবিউল। রোজার ভেতর অনেকের জন্য উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালের বিডিআর ট্র্যাজেডির পর লাশ নিতে আসা এক সেনা অফিসারের ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন- এসএসসি আর এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা ভাই আমার দেশটাকে ভালোবেসে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। দেশকে ভালোবাসার উপহার পেয়েছেন ভাই। ড্রেনের ভেতর থেকে তার লাশ আমাদের উদ্ধার করতে হয়েছে, পচা গলা বিভৎস সেই লাশটা দেখিয়ে আমাদের বলতে হয়েছে এটা আমার সেই দেশপ্রেমিক ভাই! হায়, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ। এই বিভৎস লাশের মেলা আমার দেশ। আমি এমন দেশে জন্মেছিলাম!
এমন দেশে জন্মেছিলেন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। ঢাকার স্যার জন উইলসন এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পড়া শেষ করে আমেরিকার আটলান্টার ইমোরি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। জঙ্গিরা ফারাজকে চলে যেতে বলেছিল। ফারাজ জঙ্গিদের সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি তার দুই বন্ধু অবিন্তা কবির এবং তারুশি জৈন (মানুষটা ভারতের নাগরিক ছিলেন) কে ছেড়ে একা একা যাবেন না। জঙ্গিরা ফারাজকেও গলা কেটে হত্যা করে। ফারাজ জানলো না সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে সে বন্ধুত্বের এক আইকনে পরিণত হয়েছে! হাজারো মানুষ ফেসবুকে তাকে নিয়ে যা লিখেছেন সেটি একশব্দে রুপান্তর করলে দাঁড়াবে - স্যালুট। মানবতার আরেক নাম এখন ফারাজ। দুঃখ শুধু এই যে জঙ্গিরা তার গলা কেটেছে তারাও ফারাজের সমবয়সী। তারাও জন্মেছিল এই দেশে!
এইদেশে জন্মেছিলেন ইশরাত আখন্দও! এমন হাসিখুশি আর পজেটিভ মানুষ খুব কমই দেখা যায়। বাংলাদেশ নিয়ে তার গর্বের জায়গাটা ছিল অন্যমাত্রার। হারিকেশ নামের এক শ্রীলংকান বাংলাদেশের মৌলবাদীদের নিয়ে কটাক্ষ করেছিল। ইশরাত ক্ষেপে গিয়ে বলেছিলেন- এটা আমাদের সমস্যা। ইউ আর নোবডি টু ক্লেইম! আমার দেশে বসে আমার দেশ নিয়ে ফাজলামির মানে কী? ভালো না লাগলে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাও। কম কী কামিয়েছ বাংলাদেশ থেকে? হারিকেশ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন 'সরি'!
ইশরাত, জঙ্গিদের তরবারির নিচে মাথা পেতে দেওয়ার সময়ে আপনার কি হারিকেশকে সরি বলতে ইচ্ছে করছিল? আপনার কি প্রিয় বাংলাদেশের কথা মনে পড়ছিল? মনে পড়ছিল কোনও রোদেলা দুপুরের বিষণ্ন ঘুঘুর গান? মনে পড়ছিল কোনও ঝুম বৃষ্টির দিনে রিকসাতে চড়ার স্মৃতি? মনে পড়ছিল শহীদ মিনার কিংবা একাত্তর? মনে পড়ছিল আপনার ফেলে আসা কর্মক্ষেত্র গ্রামীন ফোন কিংবা ওয়েস্টিন হোটেলের স্মৃতি? কোন স্মৃতিটা নিয়ে আপনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন ইশরাত? চলে যাবার আগে কি কফির পেয়ালায় শেষ চুমুকটা দিতে পেরেছিলেন? চিত্রকলা কিংবা ছবির গ্যালারিতে আপনার যে উচ্ছ্বাস থাকতো, চাপাতি কিংবা তরবারির নিচে সেটা কি বিষণ্ন ঘুঘুর শেষ কান্নাতে পরিণত হয়েছিল?
বহুবার বহু ব্যক্তিগত লেখায় আশংকা প্রকাশ করেছি শেষমেষ বাংলাদেশটা কি বধ্যভূমিতে পরিনত হবে? নাইজেরিয়া, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের দিকে হাঁটা শুরু করবে? সেই আশংকা কি সত্যে পরিণত হলো? আমরা কি কখনও এই জঙ্গি বিষয়ে পরিণত বোধ এবং বুদ্ধিতে পরিপূর্ণ হবো না? কিছু প্রশ্ন কি থেকেই যাবে?
এক. শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে আর খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে দোষ দেবেন, ব্লেইম গেইম চলতেই থাকবে কিন্তু এই জঙ্গি বিষয়ক সমস্যার প্রকৃত সমাধান হবে না এটাই কি বাংলাদেশের নিয়তি?
দুই. আগে বিতর্ক হতো জঙ্গি আছে কী নাই এই বিষয়ে। পরে বিতর্ক হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে বাংলাদেশে আইএস আছে কী নাই সেটা নিয়ে। জঙ্গিরা মরেও প্রমাণ করতে পারলো না তারা আসলে হরকাতুল জিহাদ, জামায়াতুল মুজাহেদীন, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম কিংবা আইএস কোন গ্রুপের সদস্য!
তিন. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অনেকেই ইরাক বা সিরিয়ায় গিয়েছিল। এদেশ থেকেও জনা বিশেক লোক সরাসরি ইরাক বা সিরিয়ায় গেছে আইএসের সাথে যোগ দিতে। তাদের সাথে কি আইএসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে? বাংলাদেশ সরকার কি এদের ব্যাপারে এখনও অন্ধকারে আছে?
চার. যত দিন যাচ্ছে আমরা কি ততোই সাম্প্রদায়িক হচ্ছি? বিদেশিদের কিংবা বিধর্মীদের আমরা কি ক্রমশ ঘৃণার চোখে দেখবো? শান্তির ধর্ম ইসলামকে কারা হিংসা বা বিদ্বেষের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে? ব্লগার কিংবা বিজ্ঞানমনষ্ক প্রগতিশীল লেখকদের যখন মারা শুরু হলো তখন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এইসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা কিংবা দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো এমন প্রচারণা চলেছে যে যারা নাস্তিক কিংবা ভিন্নমতের মানুষ তাদের খুন করলেও ক্ষতি নেই। ফেসবুকেই এমন প্রচারণা চালানো হয়েছে যে একজন ধার্মিক মানুষ বেঁচে থাকলেও সে নাস্তিক মুরতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে!
শেষমেষ বধ্যভূমির দিকেই যাত্রা শুরু করলো বাংলাদেশ?
পাঁচ. গোয়েন্দা সংস্থার লোকের কাজ কী? বিরোধী দলের পেছনে লেগে থাকা? কী কাজ এদের? এদেশে বিডিআর ট্র্যাজেডি হয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ঘুমিয়েই থাকে। এদেশে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে, আটাশ জন প্রাণ হারান, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কিছুই জানতে পারে না!
ছয়. জঙ্গিদের সাথে কোনও আলোচনা হয়নি নিরাপত্তা বাহিনীর। তাহলে বারো ঘণ্টা কেন অপেক্ষা করা হলো? জঙ্গিরা সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার পরই নাকি কমান্ডোরা সেখানে ঢুকেছিল। এক বা দুই জন জঙ্গিকে জীবিত ধরা যেত না? জঙ্গিরা হোটেলে ঢোকার আধা ঘণ্টার ভেতর সেখানে অপারেশন চালানো সম্ভব ছিল। আধা ঘণ্টা পরে অপারেশন চালানো হলে কি আরও কিছু বেশি লোককে বাঁচানো যেত? বিশজন মানুষকে গলা কেটে মারতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল? আমরা কি জঙ্গি দমনের নামে যথেষ্ট অবহেলা আর সময় নষ্ট করছি না? কখনও কি এইসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে?
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ প্রিয় পাঠক ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আসছে বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আনসার আল ইসলাম এর কাছ থেকে হুমকি পাওয়ার পর বনানী থানায় জিডি করেছিলাম। ওসি সালাহউদ্দিন ভাই ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে মাঝে মাঝেই খোঁজখবর নিতেন। ফান করে বলতেন কবির ভাই এই সুযোগে বিদেশে চলে যান। নরওয়ে কিংবা আমেরিকায় রাজার হালে থাকবেন! চলে যেয়ে আমাদেরকে টেনশনমুক্ত করেন!
সালাহউদ্দীন ভাই আমাদের টেনশনমুক্ত করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। জানি না সেখানে এখন তিনি রাজার হালে আছেন কিনা! সালাহউদ্দিন ভাই এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ!
আমাদের এই করুণ আর বিষণ্ন সময়ে আপনার জন্য রাখা চোখের জল নদী হয়ে গেছে। জানি না, রবিউলের অনাগত সন্তানের জন্য কোন বাংলাদেশ অপেক্ষা করে আছে।

লেখক: রম্যলেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ