X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতির কর্কট রোগ

কাকলী প্রধান
২৭ জুলাই ২০১৬, ১৫:২৩আপডেট : ৩১ মে ২০১৭, ১৩:১৩

কাকলী প্রধান ছেলেবেলার কোনও এক ক্লাসের বইয়ে পাঠ্য ছিল- আমাদের দেশের মেয়েদের পোশাক এবং ছেলেদের পোশাক কী? আমরা পড়েছিলাম মেয়েদের পোশাক শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ। ছেলেদের পোশাক শার্ট বা ফতুয়া প্যান্ট এবং লুঙ্গি। যা দেখেছি তার সঙ্গে ষোল আনাই মিল। খুব সম্প্রতি একটি ছোট শিশুকে প্রশ্ন করা হয়- আচ্ছা বাবু বলতো আমাদের  দেশের মেয়েদের পোশাক কী? শিশুটি ঝটপট উত্তর দিল হিজাব। প্রশ্নকর্তা হচকচিয়ে গেল। দ্বিতীয় প্রশ্ন –আচ্ছা এবার বলো ছেলেদের পোশাক কী? এবারও ঝটপট উত্তর- শার্ট, প্যান্ট, টুপি!
বিষয়টি খুব সাধারণ। ও যা দেখছে তাই বলেছে। গত ছয় সাত বছর বাংলাদেশের পোশাকের আবহমানকালের যে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি তা আমূল বদলে গেল। কোনও প্রশ্ন ছাড়াই আমার দেশে খুব সহজেই যে কোন ধারা শুরু করে দেওয়া যায়। একদিকে আরব বিশ্বের ঢেউ। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের ঢেউ- এর মাঝে বাংলাদেশ দিশেহারা, বেসামাল। রাষ্ট্র স্বাধীন, তাই আমরা স্বাধীন অতএব আমরা যে যার ইচ্ছেমত এই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করতে পারি। জবাবদিহিতার কোনও স্থান এখানে সুপরিকল্পিত ভাবেই নির্মাণ করা হয়নি। যুগযুগ ধরে আমরা নানি, মা, খালা, ফুপুদের  শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। আমাদের চোখে কোনও সমস্যা তৈরি হয়নি। আমাদের বাবা-ভাইদের চোখেও সমস্যা তৈরি করেনি। আজকাল কোনও কোনও মায়ের ছেলেরা (যাদের বয়স ১২-১৩ পেরোয়নি), তারাও নাকি অবলীলায় মায়ের পোশাক যেন হিজাবিও কায়দায় হয় তা নির্ধারণ করে দেয়।
উচ্চবিত্তের  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন উৎসবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় মেয়েদের গাউন টাইপ বস্তু ব্যবহার করতে হবে ছেলেদের পার্টি স্যুট যার মধ্যে নিদেনপক্ষে চার থেকে ছয় হাজার। আমরা সুযোগ পেলেই মায়ের শাড়ি পড়ার সুযোগ হাতছাড়া করতাম না। রাজধানীর বর্তমান হাইপ্রোফাইল বয়েজ স্কুলগুলোতে দিব্যি জায়গা করে দেওয়া হলো টুপি। অতীতের নামকরা স্কুলগুলোতে এসব নিয়মের বালাই ছিল না। তখন শালীনতার অভাবও দেখা দেয়নি। গরমে শিশুরা মাথায় টুপি রাখতে না পারলে শিক্ষকের চুল টানা খেতে হয়। বেশ কিছু স্কুলে মাত্র ক্লাস ওয়ান-টুর শিশুদের বাধ্যতামূলক আরবি কবিতা আট থেকে দশ লাইন লিখতে হয়। আমাদের ছেলে-মেয়েরা আরবিতে কবিতাগল্প লিখবে কেন? এটাতো আরব দেশের ভাষা। একোন সংস্কৃতির হাওয়া বাংলাদেশে এসে লাগলো আমরা জানি। যথাযথ কর্তৃপক্ষও জানেন। কিন্তু ভোটের রাজনীতি এবং বৃহৎ চাওয়া-পাওয়ার কারণে ইচ্ছে করেই তারা চোখ বন্ধ রাখছেন। আর সেই সুযোগে দুষ্টু হাওয়া প্রবেশ করে এক সময় অদম্য সাহসে।

অপরাজনীতি চর্চা এবং সুকৌশলে সামাজিক অস্থিরতার ফলে সাধারণ মানুষ তার চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে বিস্তৃতির আড়ালে পাঠিয়ে দিচ্ছে। প্রসঙ্গটি উল্লেখ না করলেই নয়। আমাদের যখন ছেলেবেলা তখন প্রায় প্রতি ঘরে (যে ঘরে অভাব ছিল সেই ঘরেও) সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ ছিল। কেউ ভালো গান গায় তো কেউ নাচে। কেউ আবৃত্তিতে ভালো, কেউ নাটকে। সারাক্ষণ সবাই ব্যস্ত একটা ভালো কিছুর মধ্য দিয়ে  নিজেকে তৈরি করায়। সর্বোপরি ছিল ছাত্র রাজনীতি। ছাত্র রাজনীতি কেউ করেছে বা কেউ করেনি। কিন্তু রাজনীতি চর্চার যে ব্যাপ্তি তা যে প্রত্যক্ষভাবে করেনি তাকেও ভাবাতে সাহায্য করেছে। আমার বন্ধু ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল বা ছাত্র মৈত্রী করে। আলাদা আলাদা করে একটি মানদণ্ড তৈরি হয়ে যেত পরিবারগুলোতে। এখনকার কুলষিত রাজনীতির (বড়ভাই) কনসেপ্ট তখন ছিল না। নব্বইয়ের শেষ দিকে এবং শূন্যদশকের প্রথম দিকে তৈরি হলো টাকা বানানোর নতুন নতুন কৌশল। এই প্রজন্মের বাবা-মায়েরা হয়ে গেল টাকার কল। আমরা যারা ৭১ পরবর্তী প্রজন্ম তাদের বাবারা হয়তো অত্যন্ত স্বচ্ছল অবস্থায় থেকেও সন্তানদের জন্য ক্রিস্টাল জীবন নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু আমাদের প্রজন্মের পরের বাবারা হঠাৎ করেই সন্তানদের হাতে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন। ব্যস সন্তানরা হয়ে গেল বেসামাল। আরও আরও চাই। সেদিন কর্মযোগ সূত্রে আমার একজন মডেল অসহায়ভাবে বললেন- ‘কী করা যায় বলেনতো, আমার ছোট ভাইটা কিছুদিন পরপর মোবাইলের মডেল বদল করে। এই ল্যাপটপে হচ্ছে না তার  অন্য লেটেস্ট মডেল চাই। বাবাতো দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠছে’। কেউ সত্যি হাঁপিয়ে উঠছেন  আবার কেউ দিতে পারার ক্ষমতায় আনন্দে গর্বে উদ্বেলিত হচ্ছেন। হাঁপিয়ে উঠলেতো  প্রথমেই রশিতে টান দেওয়ার কথা। দুঃখের বিষয় কত বলবো? একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কন্যা গল্পে গল্পে বলেই ফেললেন- তার সন্তানকে তিনি বাংলা মিডিয়ামে পড়াতে পারেননি আত্ম গরিমায় মহিমান্বিত হয়ে। কারণ তাদের গাড়ি চালকের মেধাবী কন্যা ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে পড়ে। তাই তিনি তার সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ান। এখন তিনি অনুতপ্ত!

সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে নৃশংসতম  ঘটনা ‘গুলশান ট্র্যাজেডি’। যারা ঘটালেন তারা আমাদেরই সন্তান। যারা ভুল পথে চলে গিয়েছিল একদিন, আখেরাতে সবচেয়ে সম্মানিত স্থানে থাকবেন এই আশায়। নাকি আন্তর্জাতিক নিরন্তর কোনও চক্রান্তের শিকার ওরা, আমরা? গুলশান ট্র্যাজেডিতে জঙ্গি পরিচয়ের যারা নিহত হয়েছে, তাদের অভিভাবকরা লজ্জায় ঘৃণায় হিমঘর থেকে সন্তানের মরদেহ আনতে যাচ্ছেন না। লজ্জা কি কেবল তাদেরই প্রাপ্য? এই লজ্জা কি পুরো জাতির নয়? আমরা নিজের সংস্কৃতিকে হিমঘরে রেখে কোন সংস্কৃতির বাহক বা পণ্য হয়েছি। ভিন্ন সংস্কৃতির বাজার তৈরি করছি তো আমিই আমার মাটিতে। আমিইতো সংস্কৃতির সেই কর্কট রোগের বাহক। সবার আগে তো নিজেকে রোগমুক্ত করতে হবে। সবার মাঝে সেই উপলব্ধি জাগ্রত হওয়া জরুরি।

লেখক: সিনিয়র ফটোগ্রাফার, কালের কণ্ঠ

আরও খবর: কল্যাণপুরে নিহত সাব্বির আওয়ামী লীগ নেতার ‘নিখোঁজ’ সন্তান!

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ