X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের শাসনে বিএনপি!

বিভুরঞ্জন সরকার
০৭ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৩০আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৪২

বিভুরঞ্জন সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে মন্তব্য করে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছেন প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। গত ২ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় বিএনপির থিংকট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক এমাজউদ্দীন বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা একটি রাজনৈতিক দল। সরকার চাইলে যেকোনও মুহূর্তে ওই দলটিকে নিষিদ্ধ করতে পারে। দেশের বিরোধী দলের নেতা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ২০ দলের মধ্যে এ দলটিকে আর রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। দলটি এখন বোঝায় পরিণত  হয়েছে। এটি এখন আর সম্পদ না’।
এমাজউদ্দীন আহমদের এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে জামায়াত ইসলামীর। বিএনপির মধ্যেও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন ও বিস্ময়। ড. এমাজউদ্দীন আহমদ এক অর্থে বিএনপির কেউ নন। তিনি বিএনপির কোনও কমিটিতে নেই। দলের সদস্যপদ নিয়েছেন বলেও শোনা যায় না। আবার অন্য দিকে তিনি বিএনপির অনেক কিছু। শোনা য়ায়, বিএনপির নীতি নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। রাজনৈতিক সংকটকালে দলের নীতি-নির্ধারকরা তার মতামত বা পরামর্শ নিয়ে থাকেন। দলীয় প্রধান থালেদা জিয়া এবং দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি তারেক রহমানের তিনি আস্থাভাজন বলে শোনা যায়। কাজেই জামায়াত সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা অনেকের কাছেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
তবে জামায়াতকে ২০ দলীয় জোটে না রাখার সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়া নিয়েছেন বলে তিনি যে কথা বলেছেন সেটা সবাইকে অবাক করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় সিদ্ধান্ত। কিন্তু দলীয় নেতারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না, সেটা কী করে হয়?
জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বিএনপিতে টানাপোড়েন আছে। অনেকেই এখন আর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির একসঙ্গে চলাটা পছন্দ করছেন না। বিশেষ করে জঙ্গিবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়া বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়ার পর বিএনপির ওপর জামায়াত ছাড়ার চাপ বেড়েছে। ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা কয়েকটি দলের সঙ্গে নতুন ঐক্য করার আলোচনার প্রাথমিক পর্যায়েই জামায়াত ইস্যু সামনে এসেছে। জামায়াত থাকলে ইচ্ছা থাকলেও কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। এই অবস্থায় বিএনপির ‘বৃহৎ ঐক্য’ প্রচেষ্টার অন্যতম উদ্যোগী দুই বিএনপি দরদি বিশিষ্ট নাগরিক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন এবং ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী জামায়াতকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ খালেদা জিয়াকে দিয়েছেন। খালেদা জিয়া সম্ভবত এ ব্যাপারে তাদের কিছু আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনও কথা বলেননি। জামায়াত ছাড়া- না ছাড়া নিয়ে দলীয় ফোরামেও কোনও বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। তবে গণমাধ্যমে এমন খবর বের হয়েছে যে বিএনপি জামায়াতের ব্যাপারে একটি কৌশলী অবস্থান নেবে। ২০ দলীয় জোট এখনই বিলুপ্ত করা হবে না অথবা ভেঙে দেওয়া হবে না। আবার জোটের ব্যানারে আপাতত কোনও কর্মসূচিতেও যাবে না বিএনপি। জামায়াতের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেই অগ্রসর হচ্ছে বিএনপি। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে কোনওভাবেই হোস্টাইল করতে চায়না বিএনপি। বিশেষ করে ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে খালেদা জিয়া মনে করেন ভবিষ্যতে জামায়াতের সমর্থন– সহযোগিতা দরকার হবে। তাছাড়া তিনি হয়তো এটাও মনে করছেন যে জঙ্গি প্রসঙ্গ রাজনীতিতে খুব দীর্ঘস্থায়ী ইস্যু হবে না। সরকার তাদের নিজেদের স্বার্থেই যেভাবেই হোক জঙ্গি সমস্যার সমাধান করবে। এক্ষেত্রে বিএনপির খুব কিছু করণীয় নেই। কিন্তু এই সুযোগে যদি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলা যায় কিংবা কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি হয় সেটাকেই বিএনপি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। জামায়াতও থাকলো, সঙ্গে যদি আরও দু-চারটি নাম সর্বস্ব দলকে পাওয়া যায় সেটা হবে উপরি পাওয়া। বিএনপির এই কৌশলের খেলা কতটুকু সফল হবে সে প্রশ্ন অবশ্যই রয়েছে।

বিএনপি যখন পুরানো মিত্র জামায়াতকে নাখোশ বা ব্যাজার না করে নতুন মিত্র জোগাড়ের চেষ্টা করছে তখন এই চেষ্টার একজন অন্যতম কারিগর অধ্যাপক এমাজউদ্দীন জামায়াতকে বিএনপির জন্য সম্পদ নয়, বোঝা বলে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে বিএনপিকে যেমন কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছেন, তেমনি জামায়াতকেও ক্ষুব্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। ২০ দলে আর জামায়াতকে না রাখার সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়া নিয়েছেন ড. এমাজউদ্দীনের এই তথ্য সাধারণভাবে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি করলেও ২০ দলীয় জোটের মধ্যে এটা বিস্ফোরকের কাজ করেছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এক বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহবান জানানো হয়েছে। বিবৃতিটিতে রীতিমতো ধমকের সুরে বলা হয়েছে, ২০ দলীয় জোট এমাজউদ্দীন আহমদকে মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগ দেয়নি। জোটের পক্ষ থেকে কোনও কথা বলার অধিকার তার নেই। তিনি সম্পূর্ণ এখতিয়ারবহির্ভূত ও অযাচিত আচরণ করেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের অযাচিত ও এখতিয়ারবহির্ভূত বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য এমাজউদ্দীন আহমদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।

জামায়াতের ধমকে ঘাবড়ে গিয়ে এমাজউদ্দীন আহমদও তার বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। তার বক্তব্য নাকি গণমাধ্যমে বিকৃতভাবে বা খণ্ডিতভাবে এসেছে। বিএনপি নেত্রী জামায়াতকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন –এমন কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে দলমত – নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। এখানে জামায়াত বিষয় নয়।

দেখা যাচ্ছে, জাতীয় ঐক্য গড়ার আগেই অনৈক্যের ঝড়ো হাওয়া বিএনপির গায়ে দোলা দিতে শুরু করেছে। জামায়াত না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হবে না - এটা যাদের রাজনৈতিক অবস্থান তারা কি এখন বিএনপির দিকে এগিয়ে যাবেন? জামায়াতকে আপাতত ছাতার বাইরে রেখে বিএনপি অন্যদের ছাতার নিচে টানতে চাচ্ছে। এই কৌশল জেনে বুঝেও ড. কামাল হোসেন, আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, কিংবা আসম আব্দুর রব-কে বিএনপির ঐক্যের ডাকে সাড়া দেবেন? কাদের সিদ্দিকী অবশ্য বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে তিনি জান্নাতে যেতেও রাজি নন। আবার সিপিবি ও বাসদের সঙ্গে জঙ্গিবাদবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে কথা হলেও এই দুই দল স্পষ্ট করেই বিএনপির সঙ্গে ঐক্য না করার কথাই জানিয়েছে। সিপিবি-বাসদ আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যেমন এখন ঐক্যে যাচ্ছে না তেমনি বিএনপির সঙ্গেও তাদের ঐক্য করার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে শেষ পর্যন্ত বিএনপির ঐক্য চেষ্টার পরিণতি কী দাঁড়াবে? জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে বিএনপির যতোটা রাজনৈতিক বেনিফিট পাওয়ার আশা করেছিল তার কাছাকাছি মাত্রায় আশা পূরণও ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য বজায় রাখার একগুঁয়েমি বিএনপিকে প্রশ্নের মুখেই ফেলছে।

সরকার তথা আওয়ামী লীগ বিএনপির ঐক্যের ডাক কেবল নাকচ করেনি, বিএনপির সামনে একটা নতুন চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তিনি যদিও বলেছেন বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। তারপরও রাজনৈতিক মহলে এই জল্পনা- কল্পনা শুরু হয়েছে যে সুবিধাজনক মনে করলে সরকার নির্বাচন কিছুটা এগিয়েও আনতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার একটি পর্যায় শেষ হওয়ার পর এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে তিনি যদি দণ্ডপ্রাপ্ত হন তাহলে সরকার আগাম নির্বাচনের কথা ভাবতে পারে। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অর্থ পাচারের মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামালায় খালেদা জিয়ারও দণ্ড হতে পারে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দুজনই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। যদি তাই হয় তাহলে বিএনপি কী করবে? খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান যদি রাজনীতি থেকে সাময়িকভাবেও দূরে সরে যান তাহলে দলের মধ্যে মারাত্মক হতাশা দেখা দেবে। বিএনপি এখনই সাংগঠনিকভাবে খুবই এলোমেলো অবস্থায় আছে। খালেদা জিয়া চেষ্টা করেও দল গোছানোর কাজ শেষ করতে পারছেন না। উল্টো একের পর এক দমকা হাওয়া তার আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে।

বিএনপির মধ্যে চলছে চরম সিদ্ধান্তহীনতা। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারলে দলটির পক্ষে অনেক সংকটেরই সমাধান করা সহজ হতো। কিন্তু কেন যেন তা হচ্ছে না। দলের সিনিয়র নেতারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। খালেদা জিয়ার কাছ থেকে নির্দেশনা আশা করছেন। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই করছেন না, বলছেন না। কেউ কেউ মনে করেন বিএনপি এখন চলে গেছে কার্যত জামায়াতের শাসনে। ড. এমাজউদ্দীনের বক্তব্যের যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জামায়াত দেখিয়েছে তা থেকেই বোঝা যায় তাদের ডোন্টকেয়ার মনোভাব। জামায়াতের কাছে বিএনপির এই অসহায় আত্মসমর্পণ অনেকের কাছেই প্রত্যাশিত নয়। জামায়াতের কবল থেকে মুক্ত হতে না পারলে রাজনীতিতে বিএনপির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সংকুচিতই হতে থাকবে। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন যে জামায়াতকে সম্পদের পরিবর্তে বোঝা হিসেবে দেখেছেন সেটাই অনেকের কাছে সঠিক বলে মনে হবে। বিএনপির মধ্যে তাড়াতাড়ি এই বোধ প্রসারিত হলেই দলটির জন্য মঙ্গল।          

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

[email protected]

আরও খবর: বিএনপির নতুন কমিটি: প্রত্যাশার সঙ্গে হতাশা, লঙ্ঘন গঠনতন্ত্রের

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ