X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার ধারাবাহিকতা প্রয়োজন

বিভুরঞ্জন সরকার
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:১৪আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:১৯

বিভুরঞ্জন সরকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট এবং বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর জঙ্গি নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযান অব্যহত আছে। গুলশান হামলার আগে মনে হচ্ছিল দেশে জঙ্গিদের অবাধ তৎপরতা প্রতিরোধের ক্ষমতা সম্ভবত আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নেই। জঙ্গিরা অপ্রতিরোধ্য, তাদের ধরা বা মারার ক্ষমতা কারও নেই। জঙ্গিরা একেক জনকে টার্গেট করবে, কুপিয়ে বা গুলি করে হত্যা করবে এবং মোটরসাইকেলে চেপে নিরাপদে পালিয়ে যাবে। মুক্তমনা লেখক, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান ধর্মযাজক, বৌদ্ধভিক্ষুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমনকি একজন সাধারণ দর্জিও জঙ্গিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষের মধ্যে বড় ধরনের আতংক তৈরি করেছিল। জঙ্গিদের ধরতে না পারার ব্যর্থতার সমালোচনা হচ্ছিল সব মহল থেকেই। ১ জুলাই গুলশানে ভয়াবহ ও রক্তাক্ত জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে। গুলশানে জঙ্গিরা বেশ কয়েকজন দেশি বিদেশি নিরীহ নারী পুরুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করলেও নিজেরা নিরাপদে পালাতে পারেনি। জঙ্গি হামলা মোকাবিলা করতে গিয়ে পুলিশের দুইজন কর্মকর্তা জীবন দিয়েছেন, আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। কিন্তু আক্রমণকারী জঙ্গিরাও সবাই নিহত হয়েছে। জঙ্গিরাও যে মারা যেতে পারে সেটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
এরপর বড় ঘটনা ঘটে পবিত্র  ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় শোলাকিয়ায়। শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। পুলিশের প্রতিরোধের মুখে পড়ে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। শোলাকিয়াতেও দুইজন পুলিশ এবং একজন গৃহবধূ নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে একজন জঙ্গি ঘটনা স্থলেই নিহত হয় এবং আরেকজন আহত অবস্থায় আটক হয়। অবশ্য পরে এই জঙ্গি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনা দেশে বিদেশে ব্যাপক আড়োলন তৈরি করে। বিশেষ করে গুলশানে বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ম্লান করে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের প্রবল উত্থান দেশটির উন্নয়ন সহযোগীদেরও আতংকিত করে তোলে। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। কিন্তু জঙ্গি মোকাবিলায় সরকার দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করার ফলে পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। জঙ্গি প্রতিরোধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি সবার কাছেই প্রশংসিত হয়েছে।
ঢাকার কল্যাণপুরে, নারায়ণগঞ্জে, মিরপুরে এবং সব শেষে আজিমপুর এলাকায় কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সফল অভিযানে বেশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি নিহত হওয়ায় এখন ধারণা করা হচ্ছে যে দেশে জঙ্গিদের কোমর ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। গুলশান হামলার পর বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া কমপক্ষে ৫৪ জনকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। টঙ্গি এলাকায় গ্রেফতার হওয়া দুই জঙ্গি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই যেসব তথ্য দিয়েছে তা আঁতকে ওঠার মতো। জঙ্গিনেতা রাহমানিকে মুক্ত করার জন্য কাশিমপুর কারাগারে আক্রমণ অথবা তাকে আদালতে উপস্থিত করার সময় ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা তারা জানিয়েছে। ১০ লাখ সদস্য সংগ্রহ করে দেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা কাজ করছে বলেও পুলিশকে জানিয়েছে। তাদের আরো কী কী পরিকল্পনা আছে, ১০ লাখ সদস্য সংগ্রহের টার্গেট থাকলেও এ পর্যন্ত তাদের সদস্য সংখ্যা কত দাঁড়িয়েছে সেসব এখনও অজানা। তাই জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গত কয়েক সপ্তাহে যে সফলতা অর্জিত হয়েছে তাতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কিছু নেই।

 এখনও বেশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি অধরাই রয়ে গেছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং নুরুল ইসলাম মারজানকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে। এই দুইজনকে ধরতে পারলে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক তছনছ হয়ে যাবে অথবা তারা মারাত্মভাবেই দুর্বল হয়ে পড়বে বলে অনেকেই মনে করেন। অবশ্য জঙ্গিদমনে চূড়ান্ত সাফল্য এ রকম পুলিশি অভিযানে সম্ভব কী না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে জঙ্গিদের সংখ্যা কত, তারা সমাজে কতোটুকু শেকড় গাড়তে সক্ষম হয়েছে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। পুলিশের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে কমপক্ষে ৪০ জন তরুণ এখনও নিখোঁজ আছে, যারা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কী পরিমাণ সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছে তাও আমাদের জানার বাইরে। তবে নারীদের মধ্যে জঙ্গিদের প্রভাব যে ক্রমেই বাড়ছে সেটা নানাভাবেই টের পাওয়া যায়। এরমধ্যেই বেশ কয়েকজন নারী জঙ্গিও গ্রেফতার হয়েছে। শীর্ষজঙ্গিরা কয়েকজন স্ত্রী পুত্র নিয়েই যে জঙ্গি তৎপরতায় শামিল হয়েছে সে তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। নারীরা কেবল তথ্য আদান প্রদানকারী হিসেবে নয়, অস্ত্র চালানোর শিক্ষাও নিয়েছে। আজিমপুরে নারী জঙ্গিরা পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ফলে কিছু জঙ্গি নিহত হওয়া কিংবা গ্রেফতার হওয়ার কারণেই এটা মনে করা যাবে না যে দেশ থেকে জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করা সম্ভব হয়েছে। জঙ্গিরা যেভাবে প্রতিরোধহীন এগিয়ে যাচ্ছিল সেখানে বড় ধরনের বাধা তারা পেয়েছে। কাজেই এখন তারা আবার কিছুটা বিরতি দিয়ে শক্তি সঞ্চয়ের পথে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

আশার কথা এটাই যে, দেশে মানুষের মধ্যে জঙ্গিবিরোধী একটি মনোভাব গড়ে উঠেছে। মানুষ জঙ্গিদের তৎপরতা পছন্দ করছে না। এমন কী যেসব পরিবারের ছেলে মেয়েরা জঙ্গি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, যারা এর মধ্যে নিহত হয়েছে তাদের প্রতি পরিবারের সমর্থন কিংবা সহানুভূতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আবার এটাও ঠিক যে জঙ্গিরা আমাদের সমাজেই বসবাস করছে। এখন পর্যন্ত এমন ঘটনা একটিও ঘটেনি যে কোনও প্রতিবেশি জঙ্গিদের ব্যাপারে পুলিশের কাছে তথ্য দিয়েছে। পুলিশ তার নিজস্ব সুত্র ধরেই অগ্রসর হচ্ছে ।  জঙ্গিবিরোধী নাগরিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আরো কার্যকর পদক্ষেপের কথা ভাবতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। শুধু রাজধানী ঢাকাতে সভা সমাবেশ মানব বন্ধন গোল টেবিল আলোচনা সেমিনার সীমাবন্ধ রাখলে চলবে না। দেখা যাচ্ছে একই ধরনের আলোচক এবং শ্রোতা প্রায় সব অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। জঙ্গিবাদের বিপদ সম্পর্কে একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে বক্তব্য পৌঁছানোর কোনও উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন কিছু কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে । তবে এগুলো খুব সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদে ফলদায়ক বলে মনে হয় না। মনে রাখতে হবে, মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনতে না পারলে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার কাজটি সহজ হবে না। যারা জঙ্গিবাদের পক্ষে তরুণসমাজকে কিংবা অন্যদের টানছে তারা কী কৌশল অবলম্বন করছে, কী কথা বলে মগজ ধোলাই করছে সেসব জানতে হবে এবং তারপর পাল্টা কৌশল ও বক্তব্য নিয়ে প্রচারে নামতে হবে।  

জঙ্গিবাদ এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কাজেই এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য বিশ্বজগতের দিকে চোখ কান খোলা রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের একটি বড় সমস্যা হলো আমরা সাধারণত কোনও কাজে ধারাবাহিকতার রক্ষা করতে পারি না। শুরু করি কিন্তু শেষ করি না। জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হলে এই মনোভাব বদলাতে হবে। এটা একদিনের কাজ নয়, একমুখি কাজ নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে যেমন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সদা তৎপর থাকতে হবে, তেমনি নাগরিক সচেতনতাও বাড়াতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কোনও সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। কিন্তু সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী অপশক্তি মাঠে আছে। নানা উছিলায়, নানা বেশে তারা গ্রামে গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।  যারা আমাদের দেশকে জঙ্গিবাদ মুক্ত রাখতে চান,  সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ুক সেটা যারা চান না তাদের এখন সক্রিয় হওয়ার সময়। হাত পা গুটিয়ে বসে থেকে আর যাই হোক প্রতিক্রিয়ার চরম ছোবল থেকে নিজেদেরও রক্ষা করা যাবে না।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ