X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশটাই যদি এমন হতো

মোস্তফা হোসেইন
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৩:৪৯আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৬:৪২

 


মোস্তফা হোসেইন ৯১’র নির্বাচনের পরের কথা। লক্ষ্মীপুর জেলার ঘটনা শুনলাম। স্থানীয় বিএনপিকর্মীরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সব বাড়িছাড়া করে দিয়েছেন। কেমন বাড়িছাড়া! দুই যুবলীগকর্মীর বাবা মারা গেছেন। বাবার দাফন হবে। যুবলীগকর্মী দু’জন গেছেন লক্ষ্মীপুর। এলাকায় খবর পাঠালেন, তারা বাড়ি যেতে পারবেন কিনা। গ্রাম থেকে বিএনপিকর্মীরা জবাব দিলেন- এখন কবর একটা হচ্ছে, ওরা এলে আরও দুটোর ব্যবস্থা হবে।
তারপরের ঘটনা? তাহের চেয়ারম্যান তো জাতীয় সংবাদমাধ্যমেই জায়গা করে নিলেন। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়।
ছিয়ানব্বই নির্বাচন পরবর্তীকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল দর্শক হিসেবে। সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল কুমিল্লা-৫ নির্বাচনি এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুকে। মঞ্চে বসা প্রধান অতিথি হিসেবে জিয়াউর রহমান আমলের কৃষিমন্ত্রী, সিরডাপের প্রতিষ্ঠাতা আজীজ উল হক, বিশেষ অতিথি অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বী ও রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার আমলের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেম ( বিএনপি), জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ওয়াহিদুননবী ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা।
লক্ষ্মীপুর আর কুমিল্লার এই চিত্র দুটি উল্লেখ করার মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরকে হেয় করা উদ্দেশ্য নয়। আসলে গোটা বাংলাদেশই তো কমবেশি লক্ষ্মীপুরই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম হিসেবে গর্বসহ উচ্চারণ করা যেতে পারে বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার রাজনীতিবিদ এবং এখানকার নাগরিকদের সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থানকে, তাদের উন্নত মানসিকতাকে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যখন রাজনীতিবিদদের দাওয়াত করে, তখন সব মতাদর্শের রাজনীতিবিদদেরই সেখানে হাজির হতে দেখা যায়। কিন্তু একটি উদাহরণও কেউ দিতে পারবে না, বিভিন্ন মতাদর্শের লোকের এক মঞ্চে উপস্থিতির কারণে কোনও ঝগড়া কিংবা বাদানুবাদ হয়েছে।
বিষয়গুলো নাড়া দেয় অনেক সময়। কিন্তু গত কোরবানির ঈদের পরদিন বুড়িচংয়ে ঊষা নামের একটি সংগঠনের ঈদ পুনর্মিলনী ও কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সন্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে সেই অনুভূতিকে আরও চাঙ্গা করে দিয়েছে। মঞ্চে অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে ৩/৪জন ছিলাম আমরা। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে একাধিকবার প্রথম হওয়া সোনার বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজা সৌরভসহ বাকি ৪/৫জন ছিলেন রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ও স্থানীয় নেতারা। ওই নির্বাচনি এলাকায় দীর্ঘতম সময়ের জন্য নির্বাচিত দুই সংসদ সদস্য যথাক্রমে অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু এমপি ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মো. ইউনুসের উপস্থিতি ছিল নাড়া দেওয়ার কারণ। কেন্দ্রীয়ভাবে যখন এই দুই নেতার দল সাপে নেউলে সম্পর্ককে ধারণ করে, অথচ বুড়িচং-এর ওই মঞ্চে তাদের অবস্থান ছিল পাশাপাশি দুই চেয়ারে-আমার ডানে।
বক্তাদের বক্তৃতার ফাঁকে ফিসফিস করে তাদের কথাও চলছিল। কানে বাজছিল দু’জনই দু’জনকে টিপ্পনিও কাটছেন। উল্লেখ্য, টিপ্পনি ছিল আব্দুল মতিন খসরুর মুখে। অধ্যাপক মো. ইউনুস একাধিকবার বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করলেন শ্রদ্ধাসহ। কৃতজ্ঞতা জানালেন আন্তরিকভাবে। বক্তৃতা শেষ করে যখন আব্দুল মতিন খসরুর পাশে আসলেন, তিনি বললেন, বক্তৃতা শেষ করতে পারতেন জয় বাংলা বলে।
অধ্যাপক মো. ইউনুস কিন্তু বর্তমান এমপিকে বলতে পারেননি, তুমিও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলে শুরু করো। কারণ এমপি সাহেব তার বক্তৃতায় ইসলামের ব্যাখ্যা দিলেন, হাদিস কোরআনের কথাও উল্লেখ করলেন। একটুও বিষোদগার ছিল না রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে। তার ধাঁচে এটা আছে বলেও মনে হয় না। আর দু’জনই মঞ্চ থেকে একসঙ্গে গেলেন মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করতে।
প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এক মঞ্চে বসেন এটা একবারেই নতুন নয়। কিন্তু একজন মন্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বী দলের স্থানীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় আতিথ্য গ্রহণের উদাহরণ কি আছে? সেটাও দেখিয়েছেন আব্দুল মতিন খসরু, ওই এলাকায়। আব্দুল মতিন খসরু তখন পূর্ণ মন্ত্রী এবং সরকারে প্রভাবশালী নেতাও। প্রটোকল ভেঙে তিনি চাষের ক্ষেতে কৃষকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রওনা হয়েছেন নিজ বাড়ি থেকে চান্দলা যাবেন বলে। ঢুকলেন, স্থানীয় বিএনপি কার্যালয়ে। স্বাভাবিক কারণেই বিএনপি কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। বিএনপিকর্মীদের বললেন, এই যা তোরা আমার দলীয় নেতাকর্মীদের ডেকে নিয়ে আয়। এমন পরিস্থিতিতে কি প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে ফ্যাসাদ তৈরি সম্ভব?
তাত্ত্বিক কোনও আলোচনা নয়, কিছু উদাহরণই দিতে চাই। নেতার আচরণ কিভাবে কর্মীকে প্রভাবিত করে, তার একটি কথা বলি। বছর দুই আগে জামায়াতের চালে চালিত বিএনপি যখন আগুনসন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হয়, ওই সময়ের কথা। চান্দলায় দুটি পক্ষই মিছিল করবে। টান টান উত্তেজনা। কিন্তু স্থানীয় নেতাকর্মীরা তো একে অন্যের প্রতিবেশী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ডাকলেন বিএনপির লোকদের। বললেন, কোনও সংঘাত যেন না হয়। উভয় দলই সিদ্ধান্ত নিল একদল সকালে আরেক দল বিকালে মিছিল করবে। মিছিলও হলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জামাত আশ্রয়ী বিএনপির মিছিল থেকে বোমার বিস্ফোরণ ঘটলো। আর সেই মিছিলে দেখা গেলো অনেক মাদ্রাসা ছাত্রকে, যারা কেউই ওই এলাকার নয়। পরে চিহ্নিত হলো শিবিরের কর্মীরা।
উদাহরণগুলো উল্লেখ করছি এই কারণে, দুটি বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দল যখন পাশাপাশি চলে, তখন ওই এলাকা থাকে শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ক্ষুদ্র দুষ্টচক্র যখন জায়গা পায়, তখনই তৈরি হয় ক্ষত। সেই বিষয়টি বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়ার মানুষও বুঝতে পারে। তাই দেখা যায়, ওখানকার মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের অনুষ্ঠানে ডাকে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও কর্মসূচিতে জামায়াতের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক দলের নেতাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে ডাকা হয় না। সে কারণেই সহাবস্থানও সম্ভব হয় না। নেতাদের উদার মানসিকতা এবং স্থানীয় মানুষের শান্তি চাহিদার সম্মিলন ঘটে। কেন্দ্রীয়ভাবে দলগুলো কি সেভাবে চিন্তা করতে পারে? আমরা প্রত্যাশা করতে পারি সারাদেশেই যেন এমন হয়। সাম্প্রদায়িক মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাই রাজনীতি করুক। বাক-বিতণ্ডা হোক দেশ পরিচালনা নিয়ে, ব্যক্তি ও সমাজকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে নয়।


লেখক: সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক

আরও পড়তে পারেন: একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ