X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

দায় শুধুই ছাত্রলীগের!

গোলাম মোর্তোজা
২৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৪৮আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৭:০০

 

গোলাম মোর্তোজা  প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের হাতে বই তুলে দেওয়ার কথা বলছেন, দরিদ্র মানুষের তালিকা করতে বলছেন ছাত্রলীগকে। আর ছাত্রলীগ কি করছে? কেন করছে? এতটা নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম কেন হচ্ছে ছাত্রলীগ? এই দায় কি শুধু ছাত্রলীগেরই?

শুধু ছাত্রলীগকে দায়ী করে, দায় চাপিয়ে- আমরা কি পরিত্রাণ পাব? হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে দুই ছাত্রলীগ নেতার অস্ত্রবাজিকে কেন্দ্র করে কিছু কথা।
১. ঘটনা সবাই জানি। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। সংক্ষেপে তিনজনের পরিচয়-
ক. সাব্বির হোসেন সাঈদ: ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। সাঈদ খোকন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। তিনি নিজেকে মেয়র সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলেও পরিচয় দেন। চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ হিসেবে পরিচিত।
খ. আশিকুর রহমান আশিক: ওয়ারি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ৫ মাস আগে তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব দিয়েছেন মেয়র সাঈদ খোকন।
গ. বিপ্লব: চাকরি না করেও সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তা হিসেবে আলোচিত। কিন্তু তিনি মেয়র সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠজন। প্রতিবছর সিটি করপোরেশন কয়েকশকোটি টাকার কেনাকাটা করে। বিপ্লব যার দায়িত্বে।
২. সাব্বির এবং আশিককে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে। ছবি প্রমাণ করছে, তারা গুলি ছুড়ছে পিস্তল দিয়ে। বিপ্লবের হাতে ওয়াকিটকি। সাব্বির ও আশিকের হাতের পিস্তল বৈধ না অবৈধ? মেয়র সাঈদ খোকন, পুলিশ, ছাত্রলীগ নেতৃত্ব, সবার বক্তব্য প্রমাণ করছে এখনও তারা তা নিশ্চিত নন! কেউ তদন্ত করে দেখার কথা বলছেন, কেউ খতিয়ে দেখতে চাইছেন, কেউ বলছেন প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেবেন। কেউ বলছেন অস্ত্র বৈধ না অবৈধ তা দেখতে হবে।

অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার যে ক্রাইটেরিয়া, তাতে একজন ছাত্রনেতা কোনোভাবেই লাইসেন্স পেতে পারেন না। কোনও ছাত্রনেতাকে যদি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেই দেওয়ার প্রক্রিয়াটিও আইনসম্মত নয়। ছাত্রনেতা যে অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে পারে না, তা সবচেয়ে ভালো জানেন পুলিশ কর্তারা। মেয়র সাঈদ খোকন বা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের তা না জানা থাকার কোনও কারণ নেই।

তারপরও সবাই সম্মিলিতভাবে ‘দেখি, দেখতে হবে, দেখবো’ জাতীয় বিভ্রান্তিকর কথা বলছেন। কেন বলছেন? কারণ এই অস্ত্রধারীদের বাঁচাতে হবে। তাদের স্বার্থেই বাঁচাতে হবে।

বিপ্লব তো সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা নয়। তার হাতে সিটি করপোরেশনের ওয়াকিটকি কেন? তার বাহিনী কেন সিটি করপোরেশনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে? এই প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে ভালো জানেন মেয়র সাঈদ খোকন।

৩. এতক্ষণ যা লিখলাম, তাতে সরাসরি অভিযুক্ত মূলত ছাত্রলীগ। কারণ তাদের দুইজন নেতাকে ছবিতে অস্ত্র হাতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি ঘটনাতেই আমরা ছাত্রলীগকে দায়ী করছি। অভিযুক্ত করছি। ছাত্রলীগ নেতারাও আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত যে, তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলো বড় করে তুলে ধরছি। এখন আমি ছাত্রলীগ বা ছাত্রলীগের নেতাদের প্রতি অনেকটা সহানুভূতিশীল। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিন্তু সাব্বির, আশিকদের অস্ত্র হাতে হকার উচ্ছেদ করতে যেতে বলেনি। তাহলে তারা সেখানে কেন গেল?

এই কেন’র উত্তরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলছিলেন, ‘আমরা হকারদের নিয়ে কাজ করি। ঘটনার সময় আমাদের দলের কিছু লোকজন ঘটনাস্থলে ছিলেন। তাদের কাছ থেকে জেনেছি, হকারদের সঙ্গে উচ্ছেদ নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চলার সময় মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, হকারদের সঙ্গে এত কথা কিসের?

ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেদের খবর দাও।এই বক্তব্য যদি সত্যি হয়, মেয়র সাঈদ খোকন যদি এ কথা বলে থাকেন, দায় কার? শুধু ছাত্রলীগের?

হকার উচ্ছেদ ঠিক কি ঠিক না, সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। হকার উচ্ছেদ করে ফুটপাত দখলমুক্ত করবে সিটি করপোরেশন, ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ দিয়ে। সেখানে ছাত্রলীগ নেতারা আসবে কেন? মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, ‘তারা আত্মরক্ষার জন্যে এটা করেছেন।’কিসের আত্মরক্ষা? আত্মরক্ষার জন্যে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করা যায়? হকার উচ্ছেদে তো ছাত্রলীগের কোনও কাজ নেই। ছবিতে অস্ত্রধারী দুইজনকে দেখা গেছে, ছিল তো অস্ত্রধারী কমপক্ষে ২০ জন। যারা

অস্ত্র হাতে এসেছে, গুলি করেছে দায় কি শুধুই তাদের? যারা বা যিনি ডেকে আনলেন, দায় তার বা তাদের নয়? সেখানে তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন। তাদের সামনে অস্ত্রধারীরা তাণ্ডব চালাল? পুলিশের দায় নেই? ছাত্রলীগের ওপর দায় চাপিয়ে সবাই নিজেদের ‘পবিত্র’ভাবছেন? আমরাও সেই কাজে সহায়তা করছি!

এখানে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ছেলেরা তো নির্দেশ পালনকারী। কে বড় অপরাধী, নির্দেশ পালনকারী না নির্দেশদাতা? শুধু ছাত্রলীগের ওপর দায় চাপিয়ে আমরা নিজেরা দায়মুক্ত হতে চাইছি। যাদের শক্তিতে, যাদের প্রভাবে ছাত্রলীগের ছেলেরা অস্ত্র হাতে নিচ্ছে, আমরা তাদের নাম বলতে পারি না।

ছাত্রলীগের ছেলেদের যারা নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের কথা কিছুটা বলতে পারলেও, নির্দেশদাতাদের কারা নির্দেশ দিচ্ছেন তা বলতে পারি না।

৪. ছাত্রলীগকে দায়ী করছি, ছাত্রলীগ দায়ীও। অস্বীকার করার কোনও পথ নেই।দিক নির্দেশনাহীন ছাত্রলীগ নিজেরা নিজেদের ৫৯ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে গত ছয় সাত বছরে। ছাত্রলীগের পক্ষে আসলে কিছু বলার নেই।

একথাও সঙ্গে বলা দরকার যে, আমাদের যে রাষ্ট্র-সমাজ, ছাত্রলীগ তারই অংশ। বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্রলীগের থেকে পবিত্রতা আশা করা ঠিক নয়।

ভোটার ছাড়া নির্বাচন, প্রশ্ন ফাঁস করিয়ে পরীক্ষা পাসের সাফল্য, চিহ্নিত অসৎ দুর্নীতিবাজদের পদায়ন, একটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই রাষ্ট্রে ছাত্রলীগ এর চেয়ে আলাদা হবে কি করে?

সামাজিক অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ছাত্রলীগ। অসৎ রাজনৈতিক নেতা, দলবাজ শিক্ষক, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, সবাই ব্যবহার করছে ছাত্রলীগকে। তারা থেকে যাচ্ছে আড়ালে-আবডালে। দানবীয় রূপে সামনে আসছে ছাত্রলীগ।দলীয় মূল নেতৃত্ব চাইলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছাত্রলীগকে এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত করতে পারেন। না, শুধু ছাত্রলীগকে বিরত করা যাবে না। আরও কিছু কাজ করতে হবে। জনগণের ভোটের অধিকার বা নির্বাচনী ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।রাজনীতিবিদরা যদি নিশ্চিত থাকেন যে, জনগণের ভোট পেয়ে জিততে হবে, তাহলে এভাবে তারা ছাত্রলীগকে ব্যবহার করবেন না। সাঈদ খোকন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে, এমন কাজে নিজেকে জড়াতেন বলে মনে হয় না। যদিও একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েও আনিসুল হক নিজেকে এসব কর্মকাণ্ডে জড়াননি।

তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদের মতো অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছেন, অস্ত্রধারী ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেননি। করলে তিনি ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে পারতেন না, যেভাবে সাঈদ খোকন পারছেন না হকার উচ্ছেদ করতে। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল বা ধ্বংস করে দিয়ে ‘ছাত্রলীগ’বিষয়ক নসিহত কাজে আসবে না, আসছে না।

ছাত্রলীগকে নসিহত করার আগে মূল নেতৃত্বকে ঠিক হতে হবে। মূল নেতৃত্ব ঠিক না হলে আজ ছাত্রলীগকে যে ভূমিকায় দেখছি, কাল ছাত্রদলকেও একই ভূমিকাতেই দেখা যাবে। অতীত পর্যালোচনা করলেও সেই প্রমাণ পাওয়া যায়।‘ভালো হয়ে যাও’নসিহত না করে, নিজেরা ভালো হয়ে যান। জাতীয়ভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নিন, শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তাতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। সমাধানের পথের সন্ধান অন্তত পাওয়া যাবে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক





*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ