X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচন কমিশন ও একটি ‘প্রশ্নমুক্ত’ নির্বাচন

রুমীন ফারহানা
৩০ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৩৯আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০১৬, ২১:৪৪

রুমীন ফারহানা বাতাসে নির্বাচনের গন্ধ। আওয়ামী লীগের সদ্য সমাপ্ত ২০ তম জাতীয় সম্মেলনে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েই শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, ২০১৯ সালে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যে তিনি সবাইকে এখনই নির্বাচনী প্রচারেও নামতে বলেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন 'আমি কখনওই চাইব না আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠুক'। এ ছাড়াও 'দি হিন্দু' পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী আবারও এটি পরিষ্কার করেছেন যে আর কোনও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ নির্বাচন চায়না আওয়ামী লীগ ।
এখন পরবর্তী নির্বাচন দলীয় বা নির্দলীয় যে সরকারের অধীনেই হোক না কেন নির্বাচনকে প্রশ্নমুক্ত রাখতে এবং অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে অন্য আরও কিছু নিয়ামকের মধ্যে প্রথম শর্তই হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী না হয় অর্থাৎ সংবিধান ও আইনে তাকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে শক্ত হাতে তার প্রয়োগ করতে না পারে তাহলে দলীয় বা নির্দলীয় যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন প্রশ্নমুক্ত, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রধানতম শর্ত হচ্ছে নিয়মিত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি সরকারের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর।
নির্বাচন কমিশন কি ভাবে গঠিত হবে তার একটি দিকনির্দেশনা দেয়া আছে সংবিধানের ১১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনও আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করবেন। পরিতাপের বিষয় হলো এই যে স্বাধীনতার ৪৫ বছরে শতশত আইন তৈরি হলেও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত কোনও আইন তৈরি হয় নাই। সম্ভবত প্রত্যেকটি সরকারই যার যার পছন্দ অনুযায়ী কমিশনার নিয়োগের চিন্তা থেকেই এই আইন প্রণয়ন থেকে দূরে থেকেছে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০১৭ সালে যে কমিশনটি গঠিত হতে যাচ্ছে সব কিছু ঠিকঠাক মত চললে তার অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন। সুতরাং নিঃসন্দেহে এই কমিশন গঠন সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের আইনমন্ত্রী এর মধ্যেই ঘোষণা করেছেন আগের বারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমেই গঠিত হবে নির্বাচন কমিশন। তিনি আরও বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়ার জন্য সংসদে আইন করার কোনও পরিকল্পনা আপাতত সরকারের নেই। আগের বারের সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর সাংবিধানিক কিছু সংস্থার প্রধানদের সমন্বয়ে। যেহেতু সার্চ কমিটি ঠিক করবে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন কাদের নিয়ে গঠিত হবে তাই সার্চ কমিটি গঠনে শুধু সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটলে চলবে না। এটি হতে হবে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সকল দল এবং পক্ষগুলোর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে।

 দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যেমন নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এর মধ্যেই নির্বাচন কমিশন গঠনে বিরোধী দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সংবিধানে যুক্ত  করেছে। এদিক থেকে বাংলাদেশ এখনও বেশ খানিকটা পিছিয়ে। এখানে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন তৈরির কথা বলা হলেও আজ অবধি এ সংক্রান্ত কোনও আইন তৈরি হয়নি। বরং সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা মোতাবেক রাষ্ট্রপতিকে এই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শক্রমে। কমিশনারের যোগ্যতা, অযোগ্যতা সংক্রান্ত আইনের অভাবে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন তার পুরোটাই নির্ভর করছে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার উপর। এ কারণে অন্তত সার্চ কমিটির সুপারিশ করা নাম গুলোতে যদি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নাম উঠে না আসে তাহলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন বাস্তবিকই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১ টি নির্বাচন কমিশন পেয়েছি আমরা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে তাদের মধ্যে অধিকাংশই বিতর্কিত হয়েছে বা জনগণের আস্থা ও সম্মান অর্জন করতে পারেনি। ৯০ এর পরে যে চারটি কমিশন জনগনের আস্থা মোটামুটি অর্জন করতে পেরেছিল সেগুলো হলো ১৯৯১ সালে বিচারপতি আবদুর রউফকে প্রধান করে গঠিত নির্বাচন কমিশন, ১৯৯৬ সালে মো. আবু হেনার অধীন নির্বাচন কমিশন, ২০০১ সালে এম. এ সাঈদকে প্রধান করে গঠিত নির্বাচন কমিশন এবং সর্বশেষ সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিযুক্ত এ টি এম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন। এই কমিশনগুলোর বৈশিষ্ট হলো এরা সবাই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন আয়োজন করেছে এবং এম এ সাঈদ ছাড়া বাকিরা সবাই নিযুক্ত হয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দ্বারা। দলীয় সরকার অন্য দলের পরামর্শ গ্রহণে ততটা আগ্রহী না হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। তত্বাবধায়ক বা অন্ত:বর্তীকালিন সরকারের আমলে দলের সাথে আলোচনার সুবিধা হলো তখন সবাই ক্ষমতার বাইরে থাকে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কেউ ক্ষমতায় থাকে, কেউ ক্ষমতার বাইরে থাকে। সেক্ষেত্রে ক্ষমতাশীলদের উপর নির্ভর করে কোনো ধরনের আলোচনা হবে কিনা।

পরিশেষে বলি একটি সৎ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ছাড়া যেমন অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয় তেমনি সার্বিক শাসন ব্যবস্থার গুণগতমান বিবেচনা না করে নির্বাচনে হঠাৎ করে সুশাসন কায়েমও সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রবিচ্ছিন্ন কোনও সংস্থা নয়। রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে শুধু নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে কোন 'প্রশ্নমুক্ত' গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। এ বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের এখনই মনোযোগী হওয়া উচিত।

লেখক: আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ