X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডোনাল্ড ট্রাম্পেরিকা!

আহসান কবির
০৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:৪৩আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৮:৪৫

 

আহসান কবির আমার এক বন্ধু অনেক বছর ধরে আমেরিকা থাকে। সে এখন নিশ্চিত, আমেরিকা যা ভাবে, তা বাংলাদেশ ভেবে রাখে অন্তত বিশ বছর আগে!
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের আগে সে বাংলাদেশে এসে অবাক হয়েছিল। তখন দল বেঁধে মিছিলসহ রিকশা-ভ্যানের মধ্যে হারমোনিয়াম আর তবলা বাজিয়ে, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’ গানটি গাইতে-গাইতে বেদের মেয়ে জোসনা দেখার একটা হিড়িক পড়েছিল। আমার বন্ধু আমাদের তালে পড়ে কিংবা হুজুগে আক্রান্ত হয়ে ছবিটা দেখেছিল। পরের সপ্তাহে সাপ্তাহিক বিচিত্রার একটি সংখ্যা সে আমাকে উপহার দিয়েছিল। বেদের মেয়ে জোসনা ছবিটি সুপার-ডুপার-বাম্পার হিট হওয়ায় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এটা নিয়ে মূল প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। যার শিরোনাম ছিল, রুচির দুর্ভিক্ষ!

অ্যামেরিকার নির্বাচনকে উপলক্ষ করে বহুদিন পরে বন্ধুর কথা মনে পড়লো। আমার সেই বন্ধু জানিয়েছে, বাংলাদেশের উদ্ভট হুজুগটা আমেরিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে। গত পাঁচবছরে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হওয়া দুই ব্যক্তির নাম অনন্ত জলিল (যদিও নিজ ব্যবসা ক্ষেত্রে ভদ্রলোকের দারুণ সুনাম রয়েছে) এবং হিরো আলম। আমেরিকায় এমন একজনের নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন!
পৃথিবীর অনেক দেশের মুসলমানদের কাছে আমেরিকার এই নির্বাচন ছিল ব্যাড বনাম ম্যাডের লড়াই। যে হিলারির জন্য এদেশের অনেক মানুষ প্রার্থনা পর্যন্ত করেছিল, সেই হিলারি ছিলেন অনেকের কাছে ব্যাড। কারণ উইকিলিকসের তথ্য অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৌলবাদী মুসলমানদের বিতর্কিত সংগঠন আইএসের অন্যতম জন্মদাতা বারাক ওবামা এবং হিলারি ক্লিনটন। যারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছিলেন আইএসকে। পৃথিবীব্যাপী মুসলমানদের অনেকেই আগে বিশ্বাস করত, আইএস ইহুদি ইসরাইল ও আমেরিকার তৈরি এবং তাদের ফান্ড ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। উইকিলিকসের তথ্য এই বিশ্বাসটাকে আরও উস্কে দেয়। আমেরিকান মুসলমানদের একটা অংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে এগিয়ে আসে! যদিও রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এই ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মুসলমানকে আমেরিকায় ঢুকতে দেওয়া হবে না! তিনি আরও ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমেরিকার সব মুসলমানের নামের তালিকা করতে হবে এবং মসজিদগুলো যেহেতু সন্ত্রাসের আখড়া, প্রয়োজনে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হবে!

 হিলারি যখন ব্যাড তখন ট্রাম্প অনেকের কাছেই ছিলেন ম্যাড! মার্কিন মুল্লুকের জনপ্রিয়তম একটা ফান ম্যাগাজিনের নাম ম্যাড। যেটার আদলে একসময়ে বাংলাদেশের একমাত্র রম্য ম্যাগাজিন উম্মাদ-এর উম্মাদ চরিত্রটাকে আঁকা হতো! সেই বদ্ধ উম্মাদ ডোনাল্ড ট্রাম্পই হচ্ছেন ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট!

তবে ট্রাম্পস যে সমস্যায় পড়তে পারতেন, তার একটি ছিল ফার্স্ট লেডি সমস্যা। তিনি বৈধভাবে তিনটে বিয়ে করেছিলেন। তৃতীয় স্ত্রী মেলোনি ট্রাম্পের সঙ্গে থাকবেন কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক ছিল। তবে মেলোনিই তার সঙ্গে থাকছেন বলে জানা গেছে। তিনিই ফার্স্ট লেডি হচ্ছেন। অবশ্য এগারোজন নারী ট্রাম্পের বিপক্ষে যৌনহয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন। এদেশের মানুষ এই একটি জায়গায় এরশাদের কথা মনে করতেই পারেন। এরশাদের সন্তান হওয়ার খবর জানার পর তার বান্ধবী জিনাত হোসাইন বলেছিলেন, এরশাদের যদি বাবা হওয়ার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে দেশটা কচিকাঁচার আসরে ভরে যেত! ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে অনেকে বলেছিলেন, তিনি যদি তার সব বান্ধবীকে শপথ অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেন, তাহলে একটা হোয়াইট হাউজে সবার আসন হবে না। কেউ-কেউ অবশ্য চুলোচুলির সম্ভাবনাও দেখেছিলেন। এরশাদ সম্পর্কে আরেকটি তথ্য এই যে, যখনই কোনও নারীকে জড়িয়ে এরশাদ বিষয়ক গসিপ ছড়িয়ে পড়তো, তখনই তিনি আলোচনায় আসতেন। তার ভোট বাড়তো! ট্রাম্পের ভাগ্যেও সম্ভবত তেমন কিছু জুটেছে! জানা গেছে নারীদের অনেকেই শেষমেষ ট্রাম্পের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাদের যুক্তি ছিল এই–মনিকা লিউনিস্কির সঙ্গে বিল ক্লিনটন যা করেছেন, তার চেয়ে ট্রাম্প অনেক ভালো। আর আমরা (ট্রাম্পের নারী সমর্থকরা) বিল ক্লিনটনের মতো বিশ্বাসঘাতক স্বামী খুঁজছি না, প্রেসিডেন্ট খুঁজছি!

 পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই মুসলমান নারীদের হিজাব পরা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়। নারী স্বাধীনতার অন্তরায় হিসেবে দেখা হয় এটাকে। কিন্তু সমগ্র আমেরিকা কি একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল? উত্তর হচ্ছে, না! নারীরা বিমান চালাবে, এটি আমেরিকার অনেক মানুষ এখনও মানতে পারে না। যে বিমানে নারী পাইলট থাকেন সেই বিমানে ভ্রমণ করতে চান না তারা! হিলারি কি আমেরিকার মানুষের লুকোনো এই মধ্যযুগীয় মানসিকতার শিকার হয়েছেন?

আমেরিকার অনেক নারী ভোটার ট্রাম্পের এই বিজয়ের পরে বলেছেন, নির্বাচনের ফল মানতে কষ্ট হচ্ছে। যেন একশো বছর পেছনে চলে গেল আমেরিকা! আস্তে আস্তে মধ্যযুগের দিকেও পা বাড়াবে! একসময়ে আমেরিকায় কাউবয়দের যে উম্মত্ততা ছিল, সেই রকম এক উম্মত্ত ঘোড়ার পিঠে চড়েই বিজয়ী হয়ে গেলেন উগ্র ও উম্মাদ ট্রাম্প। আমেরিকার এই নারীরা হয়তো জানেন না, এদেশের একজন বিখ্যাত কবির একটা কবিতার বইয়ের নাম আছে, ‘ডাক দিয়ে যায় মধ্যযুগ’। কবির নাম আসাদ চৌধুরী। এই কবির লেখা একটা বিখ্যাত লাইন হচ্ছে—‘তোমার যা বলার ছিল বলছে, তা কি বাংলাদেশ?’ জানি না আমেরিকার নারীরাও এখন এই প্রশ্ন তুলবেন কিনা, ‘তোমার যা বলার ছিল বলছে তা কি আমেরিকা?’

আমেরিকান পুরুষতন্ত্রের প্রচারণা কতটা খারাপ হতে পারে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তারা বলছেন, আমাদের সৌভাগ্য যে কোনও পুরুষকে (হোক সেটা বিল ক্লিনটন, যদিও তিনি রেকর্ড করতেন একইসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট জেন্টেলম্যান হওয়ার) আমেরিকার ফার্স্ট জেন্টেলম্যান হতে হয়নি! আর হিলারি যদি প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে অটোমেটিক তিনি আরও একটি রেকর্ড করে ফেলতেন। সেটি হচ্ছে একমাত্র তিনিই আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি হতেন, যিনি আরেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী!

অনেকেই ট্রাম্পকে উগ্র, উম্মাদ, যৌনকাতর ও স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান বলেছেন। তবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিকরা ট্রাম্পকেই সমর্থন করেছেন। তাদের যুক্তি নরেন্দ্র মোদি যতই উগ্র এবং সাম্প্রদায়িক কথা বলুন না কেন, ভারতের জন্য তাকেই বেশি প্রয়োজন! সুতরাং প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্পও উগ্রতা থেকে সরে আসবেন এবং অ্যামেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তুলবেন। যদি তেমনই হয়, তাহলে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। দেখা যাক হয়তো ক্ষমতাই ট্রাম্পকে উগ্রবাদ ও পাগলামি থেকে শান্তির পথে নিয়ে আসবে!

লেখাটা শুরু করেছিলাম আমার আমেরিকার বন্ধুর কথা স্মরণ করে। প্রিয় পাঠক, সিলেটের ছয়ফুর রহমানের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? লেখাপড়া তেমন না জানা খুবই অল্প আয়ের এই মানুষটি একবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তার বক্তৃতার ভাবভঙ্গি আর কথাবার্তা শুনে মানুষ হাসতো, এক ধরনের মজাও পেত। নির্বাচনের পর দেখা গেল ছয়ফুর জিতেছেন এবং মানুষ তাকে নিয়ে মজা করতে করতেই ভোট দিয়ে ফেলেছে। এরপর থেকে তার নাম হয়ে যায় ছক্কা ছয়ফুর!

 ট্রাম্পও ছক্কা মেরেছেন। প্রায় সব মিডিয়া তাকে উম্মাদ আর ক্লাউন বানাতে ব্যস্ত ছিল। কেউ বলেনি যে ট্রাম্পই নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে। বর্ণবাদী ও উগ্র আমেরিকানরা ভয় পাচ্ছিল যে ক্রমশ তাদের ক্ষমতা অশ্বেতাঙ্গ মানুষের হাতে চলে যায় কিনা। এই ভয় আর নারী প্রেসিডন্ট দেখার চেয়ে তারা একজন ক্লাউনকেই বেছে নিয়েছে। এখন বলা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের আমেরিকানরাও নাকি ট্রাম্পকে পছন্দ করা শুরু করেছে। এ কারণেই ইলেক্টোরাল ভোটের এতা পপুলার ভোটেও ট্রাম্প এগিয়ে ছিলেন। এত মিডিয়া আমেরিকার, আর তারা সাধারণ মানুষের পালস বুঝতে পারল না?

আমেরিকার এবারের নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে বাকি ৪৬ ভাগ মানুষ তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন, তা নিয়ে তেমন ভাবিত নয়। বেক্সিটের নামে ব্রিটিশরা যেভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আর বিদেশি খেদাও-এর মতো ভাবনা থেকে অ্যামেরিকানরা হয়তো ট্রাম্পকেই বেছে নিয়েছে। অভিনন্দন ট্রাম্প।

নারীদের বিজয় হচ্ছে এমন ভাবনার মতো এদেশের  কিছু মানুষ ভেবেছিল, হিলারি জিতলে বিএনপির সুবিধাই হবে। তারা আরও ভেবেছিল যেহেতু হিলারির প্রচারণায় খালেদা জিয়ারও ছবি ছিল, ড. মো. ইউনূস যেহেতু হিলারির খুব প্রিয়, সুতরাং তিনি প্রেসিডেন্ট হলে হয়তো ইউনূসের কথা শুনবেন। হয়তো একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এদেশে এবং খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসবেন। হয়তো তখন ইউনূস প্রেসিডেন্টও হয়ে যেতে পারেন! হিলারি জিতলে হয়তো বায়তুল মোকাররম থেকে মিরপুর গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা বসুন্ধরার গ্রামীণ ফোন অফিস পর্যন্ত লম্বা বিজয় মিছিল বের হতো!

মানুষের সব আশা পূর্ণ হয় না। হিলারির পরাজয়ের বেদনা চেপে কেউ কেউ এখন বলছেন, টাকা দিয়ে ট্রাম্প আসলে এফবিআইকে কিনে ফেলেছিলেন। এফবিআইয়ের কারসাজিতেই নাকি ট্রাম্প জিতে গেছেন।

আর তাই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে যাওয়ার পর অনেক পত্রিকা, অনলাইন ও টেলিভিশনের শিরোনাম হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পেরিকা!

 দেখা যাক, ট্রাম্পের হাতে এখন কেমন থাকে আমেরিকা!

লেখক: রম্যলেখক। 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ