X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার নির্বাচন

তসলিমা নাসরিন
১১ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৩৭আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৩৬

তসলিমা নাসরিন আমি ছিলাম বার্নি স্যান্ডার্সের সমর্থক। কিন্তু বার্নি বসে যাওয়ার পর আমি চেয়েছি হিলারি জিতুন। হিলারিকে ভালোবেসে হিলারি জিতুন চাইনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হোন তা কিছুতেই চাইনি বলেই হিলারি জিতুন চেয়েছি। আমার মতো অনেকেই হয়তো এভাবেই চেয়েছে। কিন্তু আমাদের অবাক করে জিতে গেছেন ট্রাম্প। অনেকটা ব্রেক্সিটের মতো। ভোটাররা  ঠিক বুঝতে পারেনি তারা  কী করতে যাছে, কাকে ভোট দিতে যাচ্ছে।  জনপ্রিয় তথ্যচিত্র নির্মাতা মাইকেল মুর বলেছেন,  যেহেতু হিলারি বেশি মানুষের ভোট পেয়েছেন, হিলারিই জিতেছেন। ট্রাম্পকে তৈরি করেছে মিডিয়া, তাই মিডিয়ার দখল নিতে হবে এবং হিলারিকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হবে। মাইকেল মুরের এই প্রচারণা জনপ্রিয়তা পাবে বলে আমার মনে হয় না।    আমেরিকার ভোটের যে নিয়ম, সেই নিয়ম অনুযায়ী  ট্রাম্প জিতেছেন। এই নিয়ম পছন্দ না হলে নিয়মটি বদলে ফেলাই ভালো। পৃথিবীতে ভোটের নানা রকম নিয়ম আছে।
ট্রাম্প জেতার সঙ্গে সঙ্গে  আমেরিকার শহরগুলোয় প্রতিবাদ মিছিল হচ্ছে। প্রতিবাদিরা বলছে, ‘ট্রাম্প আমার প্রেসিডেন্ট নয়, 'তারা, সোজা কথা, ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট মানতে রাজি নয়।   ট্রাম্পের মূর্তি পুড়িয়েছে  অনেকে। বার্নির প্রচুর সমর্থক ভোট   দেয়নি, ভেবেছিল হিলারিই জিতবে। ওদের জন্যও ট্রাম্পের জিতে যাওয়া অপ্রত্যাশিত। ডেমোক্রেট সমর্থকদের অনেকে হিলারিকে পছন্দ নয়, তারা গ্রীন পার্টির লোককে ভোট দিয়েছে, জেনেই ভোট দিয়েছে এ লোক জিতবে না। তারাও সম্ভবত হতভম্ব!
কু ক্লুক্স ক্ল্যানের এক সময়ের নেতা ডেভিড ডিউক উইকিলিক্সের জুলিয়ান আসাঞ্জকে ধন্যবাদ জানিয়েছে ট্রাম্পকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য। ডেভিড মনে করে ট্রাম্প তাদের লোক। কু ক্লুক্স ক্ল্যান আমেরিকার কুখ্যাত বর্ণবাদি সংগঠন-- যাদের কাজ ছিল কালোদের ঘৃণা করা, কালোদের নির্যাতন করা,কালোদের  বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা, কালোদের মেরে ফেলা। দলটি  এসব কুকীর্তির কারণে আমেরিকায় নিষিদ্ধ। এরা সাদা মানুষ ছাড়া আর কাউকে মানুষ বলে মনে করে না। সাদা ছাড়া ত্বকের অন্য কোনও রং  এরা গ্রহণ করে না। ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে  আমেরিকার সাদারাই বেশি । এই সাদাদের মধ্যে কলেজ ডিগ্রি না থাকা  সাদার সংখ্যাই বেশি। কালোদের ভোট হিলারি পেয়েছেন শতকরা ৮৮ ভাগ। ট্রাম্প পেয়েছেন ৮%। এই ৮% ভোট কালোরা ট্রাম্পকে কেন দিল  জানি না, ওবামা পেয়েছিলেন কালোদের ৯৩% ভোট। হিলারির ভাগে এই কালো ভোটের সবটাই যাবে, এরকমই হয়ত কথা ছিল। ট্রাম্প যে কালোদের ঘৃণা করেন, তা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন! তারপরও কালোরাই বা ভোটগুলো কী করে ট্রাম্পকে দিল!   নারী বিদ্বেষ? হিলারীকে পছন্দ নয়? নাকি ইমেইল স্ক্যান্ডাল পছন্দ হয়নি!   আসাঞ্জ শুনেছি ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিলে আমেরিকার ক্ষমা পেয়ে যাবেন এরকম আশ্বাস পেয়েছেন !

ট্রাম্প অনেকটাই হিটলারের মতো। বর্ণবাদিতা হিটলারকে ক্ষমতা দিয়েছিল, একই রকম ট্রাম্পকেও। হিটলারের মতো তিনিও চান  হাজার হাজার মানুষকে দেশ থেকে বের করে দিতে। জার্মানির সমস্যার জন্য হিটলার   ইহুদিদের দোষ দিতেন। আমেরিকার সমস্যার জন্য ট্রাম্প দোষ দেন ইমিগ্রেন্টদের। হিটলার ছিলেন ইহুদি বিদ্বেষী, ট্রাম্প মুসলিম বিদ্বেষী।  হিটলার চাইতেন  জার্মানিকে আবার সাদা বানাতে, ট্রাম্পও তাই চান।

মেয়েদের   ট্রাম্প কী চোখে দেখেন, তা অনেক মেয়েই জানে। মেয়েদের কুকুর, কুৎসিত—এসব ভাষায়   গালি দেন।  মেয়েদের দৈহিক সৌন্দর্যকেই তিনি মেয়েদের  একমাত্র গুণ বলে মনে করেন, বারবার তা বলেছেনও। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে,  যে মেয়েরা ভোট   দিয়েছে ট্রাম্পকে, তাদের কি জানা নেই ট্রাম্প একটা নারীস্বাধীনতা বিরোধী  লোক? কী করে    আমেরিকার শতকরা ৫৩ ভাগ নারী   ট্রাম্পের মতো একটা  নারীবিদ্বেষী লোককে ভোট দিয়েছে! কালো লোককে আমেরিকা প্রেসিডেন্ট হতে দিয়েছে, কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হতে দেয়নি।  আর কত যুগ যাবে নারীর প্রেসিডেন্ট হতে কে জানে! বোধ হয় নারীরাই ঠেকাবে নারীর প্রেসিডেন্ট হওয়া! এ ছাড়া আর কী বলবো! আমেরিকায় অজ্ঞ ,অশিক্ষিত আর অসচেতন  লোকের অভাব নেই জানি,  কিন্তু সংখ্যাটা যে এত বেশি জানা ছিল না। যে জনগণ  বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সমতা আর সমানাধিকারে বিশ্বাসী একজন  আফ্রিকান আমেরিকানকে নির্বাচনে জিতিয়ে   প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে, সেই জনগণই আট বছর পর এক বর্ণবাদী নারীবিদ্বেষীকে নির্বাচনে জিতিয়েছে।

নিজের মেয়ে ইভাঙ্কা সম্পর্কে ট্রাম্প বলেছেন, ‘ও যদি আমার মেয়ে না হতো, ওর সঙ্গে ডেটে যেতাম আমি।‘   হিলারিকে ‘ন্যাস্টি উওম্যান’ বলেছিলেন ট্রাম্প। শুনে সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন বলেছেন, ‘আমরা ন্যাস্টি নারীরা আমাদের ন্যাস্টি পায়ে  মার্চ করে  আমাদের ন্যাস্টি ভোট দিয়ে তোমাকে চিরকালের মতো আমাদের জীবন থেকে বিদেয় করবো’।  এলিজাবেথের মতো আরো নারীর  যদি এই আত্মসম্মানবোধটুকু থাকতো! মনে আছে বিলি বুশের সঙ্গে ট্রাম্পের কথোপকথন? নারীকে অমন ভয়ঙ্করভাবে অসম্মান করার পর নারীরা তাঁকে ভোটে জিতিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট বানাবে, এ হয়তো কেউ  কল্পনা করতেও পারেনি।    খাল কেটে কুমীর আনা বোধহয় একেই বলে।

ট্রাম্পের জিতে যাওয়ায় দেখছি দুনিয়ার মুসলিমবিদ্বেষীরা বেশ খুশি। ওরা খুশি কারণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাদের মতোই মুসলিম বিদ্বেষী। এবার ট্রাম্প তাঁর প্রখর ক্ষমতাবলে আমেরিকা  থেকে নানা ছুতোয় মুসলিমদের তাড়াবেন,  মুসলিমদের জীবন দুর্বিষহ করবেন, কোনো মুসলিমকে আর আমেরিকায় ঢুকতে দেবেন না। লোকটি অভিবাসি বিরোধী, মেক্সিকো আর যুক্ত্ররাষ্ট্রের মাঝখানে নাকি বিশাল দেওয়াল তুলে দেবেন। মানুষের মনে মানুষের প্রতি হিংসে বাড়িয়েছেন, ঘৃণা  ছড়িয়েছেন। অথবা মানুষের মনে যে ঘৃণাটা  সুপ্ত অবস্থায় ছিল, তাকে জাগিয়ে তুলেছেন। মানুষকে  অবজ্ঞা, অপমান, অপদস্থ করায় ট্রাম্প বেশ পারদর্শি। দেশের কথা ভাবার, দেশের মানুষকে সম্মান করার    রাজনীতিক তিনি নন, তিনি ছিলেন রিয়েলিটি টিভি শো’র লোক, ছিলেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। দীর্ঘ রাজনীতিক জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর নেই।  আমেরিকার অন্যান্য প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেটের মতো সভ্য, শিক্ষিত চরিত্রবান তিনি নন। তারপরও তাঁর জিতে যাওয়া   আমেরিকার এক ট্র্যাজেডি।

কেউ কেউ বলে  ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি সত্য কথা বলেন। বিল মাহর সেদিন এক এক করে বলে দিয়েছেন ডোনাল্ড কী কী  মিথ্যে বলেছেন। বলেছেন ডেভিড ডিউকের সম্পর্কে তিনি জানেন না, আসলে জানেন। বলেছেন পুটিন তার বেস্ট ফ্রেন্ড, যদিও পুটিনের সঙ্গে তাঁর দেখাই হয়নি কোনোদিন। বলেছেন, ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি, কিন্তু প্রমাণ আছে তিনি ওই যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন না।বলেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের  তিনি অর্থ সাহায্য করেছেন, না তিনি করেননি। ফুটবল লীগ নিয়েও মিথ্যে বলেছেন। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে টুইট করেছিলেন গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলে কিছু নেই, সবই নাকি চীন দেশের ষড়যন্ত্র।  পরে অস্বীকার করেছেন ওসব কথা নাকি বলেননি। টুইটারে অবশ্য প্রমাণ রয়ে গেছে যে বলেছেন। টরোন্টো সান পত্রিকার রিপোর্টার ডানিয়েল ডেইল রেকর্ড করেছেন  ২৫ দিনে ট্রাম্পের  ২১২ টা মিথ্যে বলা । তাঁকে সত্যাবাদি বলার অভ্যেসটা মানুষের ত্যাগ করা উচিত।

কু ক্লুক্স ক্ল্যানের নেতা ডেভিড ডিউক টুইট করেছেন, ‘ট্রাম্প এখন সুযোগ পেয়েছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব হওয়ার’। লিখেছেন, ‘আমরাই, আমাদের লোকেরাই ট্রাম্পকে জিতিয়েছি’। দেখাই যাচ্ছে, ট্রাম্পকে যারা জিতিয়েছে তারা   সাদা নয় এমন মানুষদের  ঘৃণা করে, তারা  নিশ্চিহ্ন করতে চায় ওই মানুষদের, তারা কালো বাদামি হলুদ মানুষদের দেখতে চায় না তাদের দেশে। তাদের দেশ সাদার দেশ, ওই দেশে শুধু সাদারাই থাকবে। এ তো আছেই, ,এখন দেখা যাক ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট  লোকটি কে।  ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স একজন নারী বিরোধী, বিজ্ঞান বিরোধী, সমকামী বিরোধী ক্রিশ্চান মৌলবাদী। ট্রাম্প নিজেই নির্বাচন করেছেন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট। কথায় আছে না, রতনে রতন চেনে?

ডেমোক্রেট পার্টির হেরে যাওয়ার পেছনে তাদের নিজেদের কিছু ভুল আছে নিশ্চই। সাদা মধ্যবিত্তদের বিশ্বাস অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।   ট্রাম্পের বড় বড় বুলি শুনে মুগ্ধ হয়েছে মানুষ। হয়তো ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামানো উচিত ছিল ট্রাম্পের মতোই কোনো রিয়েলিটি  টিভি শো’র হিরোকে অথবা কোনো নারী বিদ্বেষী ধন কুবেরকে, অথবা কোনো সাইকোপ্যাথকে।

আমেরিকায় ট্রাম্পের বিজয়  মানে গোটা বিশ্বের চরম ডানপন্থী বর্ণবাদি জাতীয়তাবাদি রক্ষণশীল দল্গুলোর    বিজয়, এ তাদেরও উত্থানের প্রেরণা। মনে হচ্ছে প্রগতির চাকা একশ বছর পেছনে ঘুরে গেছে।  

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ