X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আপনার সুবিচারের জন্য প্রার্থনা’

ড. জহির আহমেদ
০৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৪৫আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৫২

ড. জহির আহমেদ গত কয়েকদিন আগে একটা সংবাদে চোখ আটকা পড়লো – ‘ময়মনসিংহে একজন পথচারী সহ কলেজ শিক্ষক পুলিশের লাঠিচার্জে নিহত’। কলেজটিকে জাতীয়করণ করার স্বপক্ষে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া কলেজের শিক্ষক, অভিভাবক, ও শিক্ষার্থীরা গত কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট ও ভিজুয়াল মিডিয়া জানান দিচ্ছে যে, কলেজের অভ্যন্তরে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ থেকে প্রাণ বাঁচাতে শিক্ষকরা কলেজে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা পাননি। অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় সাংসদের কাছের মানুষরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ইতিমধ্যে দুটো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। 
আর একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বেশ কয়েক মাস আগে নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে একজন সাংসদের অযাচিত বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগটি হলো- মাননীয় সাংসদ ওই শিক্ষককে ইসলামধর্ম অবমাননার তথাকথিত অপরাধের কারণে কান ধরে ওঠ-বস নামক এক অমানবিক শাস্তি দিয়েছেন, যা কিনা ঘটেছে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগনের সামনেই। সোশ্যাল মিডিয়া সহ সারা দেশে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয় ছিল। যেহেতু ঘটনাটি একজন মাননীয় সংসদ সদস্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ছিল, সেহেতু দেশ জুড়ে তার করণীয় ও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এই বেদনাদায়ক ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? পরস্পর সম্পর্কিত তিনটি প্রাসঙ্গিক দিক বিবেচনা করে বিষয়টির আলোচনা শুরু করা যাক।   
প্রথমেই আইনগত দিকটি তাৎপর্যপূর্ণ। যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হলো-  শিক্ষক সহ নাগরিকের তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা 'ভঙ্গের' অভিযোগে একজন সাংসদের ওই ধরনের শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি? আমার জানা মতে পৃথিবীর কোনও দেশেই একজন সাংসদের দায়িত্ব ও ভূমিকা লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ নেই- সেটি মার্কিন কংগ্রেসই হোক কিংবা ব্রিটিনের হাউস অব কমন্সই হোক। বাংলাদেশের সংবিধানেও একজন সাংসদের আইন-প্রণয়নে ভূমিকা ছাড়া অন্য দায়িত্ব ও কর্তব্যের লিখিত কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। অনেকটা রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্যেই একজন সাংসদ পার্লামেন্টে ভূমিকা ছাড়াও নিজ সংসদীয় এলাকায় যেকোনও কাজ নিজ তদারকীতে অংশ নিয়ে থাকেন। এটি একটি রিচুয়াল হয়ে গেছে যে স্থানীয় সাংসদ স্কুল কমিটি, উন্নয়ন বাস্তবায়ন কমিটি, এবং স্থানীয় নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন (উল্লেখ্য, মহামান্য হাইকোর্ট ইতিমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংসদদের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে রুল দিয়েছেন)। একজন শিক্ষকের ‘অন্যায়ের’ বিচার তিনি করতে পারেন কি? জনরোষ থেকে অপরাধীকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য কান ধরে ওঠ-বস নামক শাস্তি দিয়ে একজন সাংসদ ‘ত্রানকর্তা’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন কিনা বা হবেন কিনা? একজন আইন প্রণয়নকারীর আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের এই মৌলিক প্রশ্নগুলো আজ জাতির সামনে।

দ্বিতীয় অপর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো নৈতিক অধিকারের বিষয়টি। একজন শিক্ষক সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে স্থানীয় সমাজ/সম্প্রদায়ের অভিভাবক। যদি প্রধান শিক্ষক অপরাধ-ই করে থাকেন, তবে প্রথাসিদ্ধ নিয়মে তার 'বিচার' হতে পারত। আবার ফুলবাড়ীয়া কলেজ দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যুক্তি তুলে ধরে যদি শিক্ষকরা জাতীয়করণ হওয়ার জন্য নিয়ম মেনে আন্দোলন বা মানববন্ধন করেন তাতে দোষ কোথায়? হতে পারে রাজনৈতিক বিবেচনাতে কলেজটিকে মাননীয় সাংসদ জাতীয়করণ করবেন না; কিন্তু রুটি রুজির জন্য কলেজ শিক্ষকদের আন্দোলন করার অধিকারতো শাসনতন্ত্র স্বীকৃত। একজন শিক্ষককে জনসম্মুখে হেয় করার যে নজির স্থাপিত হলো কিংবা পুলিশ দিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে যেই ভাবে রক্তাক্ত করা হলো তা আমাদেরকে হতবিহবল করে তোলে। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিদ্যাপিঠের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আর একজন স্কুল সহকর্মীর অপমানে যেমন কুঁকড়ে যাই, তেমনি ফুলবাড়ি কলেজের শিক্ষক ও অপর পথচারীর তাৎক্ষণিক মৃত্যু দেখে নিথর হয়ে যাই।

শেষত, প্রতিনিধির বিবেচনাতেও বিষয়টি সংবেদনশীল। সংসদীয় এলাকার অভিভাবক হিসেবে 'একজন সাংসদ এর  দায় এড়াবেন কি করে? মাননীয় সাংসদ একটি দলের সদস্য হিসেবে সংসদে আসেন। যতটুকু জেনেছি, সরকারি দলের মুখপাত্র বলেছেন- ‘দল সাংসদের এই ধরনের কর্মকাণ্ডরে দায়িত্ব নেবে না’। একজন মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের দায়-দায়িত্ব, কর্তব্যেরও লিখিত রূপ নেই। শুধু বলা আছে, তিনি আইনগত দিক থেকে শুরু করে নিজের বিবেচনায় এলাকার জনগণের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুসারে তার দায়িত্ব পালন করবেন। এটি ওয়েস্টমিনিস্টার স্টাইল গণতান্ত্রিক দেশেও লক্ষ্য করা যায়। তবে একজন সাংসদের কর্মপরিধির লিখিত রূপ না থাকলেও নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে সম্মান দেওয়ার কথা রয়েছে। মার্কিন কংগ্রেস ‘কোনও সদস্যই অন্যের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আর একজন বা গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখবেন না; কারণ তিনি ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি’। সংসদীয় এলাকার সাংসদদের সম্পর্কে আম জনতার অনেক সমর্থকের ধারণা আমরা জানি। অনেক সাংসদদের সাথে কথোপকথন এর মাধ্যমে তাদের হিতৈষীমূলক কর্মকাণ্ডের বয়ান শুনেছি, পর্যবেক্ষণও করেছি। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের একজন সাংসদ তার সংসদীয় এলাকায় ঢাকা থেকে নিরন্তর যাওয়া-আসা করেন, এলাকার দেখ ভাল করেন, যা আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করে। হেন কোনও কাজ নেই যে তিনি তার এলাকার মানুষের জন্য করেন না। রাত দুটো-তিনটে বাজেও তার হেঁশেল উন্মুক্ত থাকে। একজন অসামর্থ্য বাবার মেয়ের বিয়েতে অর্থ সাহায্য থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের উপকারে আসে এমন অনেক কাজই সাংসদরা নিরলসভাবে করে থাকেন। একজন সাংসদের অফসিয়াল কর্ম পরিধি পর্যায়ে না পড়লেও এটি চিরায়ত জনসেবার একটি তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক। কিন্তু হতবাক হই যখন দেখি একজন সাংসদ তার পরাক্রম ক্ষমতা প্রয়োগ করে একজন নাগরিককে কান ধরে ওঠ-বস করার শাস্তি দেবার অভিযোগ শুনি কিংবা 'বিশেষ বিবেচনাতে' একটি কলেজকে জাতীয়করণ থেকে বঞ্চিত করতে বেপরোয়া হতে দেখি; অথচ ফুলবাড়ি অঞ্চলের নাগরিকরা ওই কলেজ জাতীয়করণের পক্ষে। একটি সংসদীয় এলাকার সকল জনগণকে 'প্রতিনিধিত্ব' করার বিষয়টি তাই একেবারে সামনে চলে আসে।

গত বছর ইংল্যান্ড এর অক্সফোর্ড শাইয়ারে অনুষ্ঠিত রক্সটন ওয়ার্কশপে ৫৫ টি দেশের সংসদ ও সাংসদ বিষয়ক সদস্য, স্পিকার, গবেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সম্মিলনে দেখি যে, অনেকেই একজন সাংসদের অপরিমেয় ক্ষমতা চর্চা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কয়েকজন স্কলার তাদের গবেষণা প্রবন্ধে একজন সংসদ সদস্য যুগপৎ ভাবে পার্লামেন্টে ও তার সংসদীয় এলাকার জনগণের কোনও কোনও মৌলিক বিষয়ের প্রতি নজর দেবেন, তার এখতিয়ার কতটুকু হতে পারে, কোনটি তার ভূমিকা ও দায়িত্ব এবং কোনটি তার কর্ম পরিধির মধ্যে আবার কোনটি না--- এরকম কতক প্রশ্ন তুলেছেন। বলা বাহুল্য, এইসব তথ্য ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইল অনুসারী গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকেই  উঠে এসেছে (হাউস অব কমন্স ও হাউস অব লর্ড সহ)। তবে আশান্বিত হই নারায়ণগঞ্জ ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে অপরাপর মাননীয় সংসদ সদস্যরা ওই ঘটনাকে নিজেদের পরিচিতির অপব্যবহার বলে উল্লেখ করত, জবাবদিহিতাকে মসৃণ করতে কিংবা সংসদে ওই সাংসদের নিকট অধিবেশনে উপস্থিতিকে ‘লজ্জাজনক’ বলে তিরস্কার করতে।

কোনটা ‘লজ্জাজনক’ আর কোনটা ‘লজ্জাজনক নয়’ এই বিতর্ক আমাদেরকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যায় না। নিজের জীবন বাঁচাতে শারীরিক লাঞ্চনা ও অপমান সহ্য করেও নারায়ণগঞ্জের প্রধান শিক্ষক বাঁচতে চান। পেশী শক্তির বিপরীতে নিজ পরিবার পরিজনকে বাঁচাতে শারীরিক অর্থে দ্বারস্থ হন রাষ্ট্র যন্ত্রের কাছে। তাই শ্যামল কান্তি ভক্ত-র মতো শিক্ষকরা ‘লজ্জাহীন’ হন ক্ষমতাবানদরে পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে। একটি বৈরি ডিসকোর্সের সম্মুখীন আমরা হই। এই এক তির্যক বৈপরীত্য ঠাঁসা 'পেশাগত বৈরিতা'। এই  বৈপরীত্য অপমানজনক কিন্তু ক্ষমতাহীন শিক্ষকের বেঁচে থাকার একমাত্র পথ। বলা যেতে পারে গলার কাঁটা-- যে কাঁটা সে গিলতে চায় নিজ স্বজনের জন্য, কোনও মতে বেঁচে থাকার জন্য। তার তো হারাবার আর কিছু বাকি নেই; কারণ তিনি তো 'কান ধরে ওঠ বস করে' নিজের অশরীরী মৃত্যু ঘোষণা করেছেন বহু আগেই। আর ফুলবাড়ীর কলেজ শিক্ষক আত্মাহুতি দিয়ে নিজের শরীরী মৃত্যুর জানান দিয়েছেন একেবারে পাবলিক পরিসরে। ভিজুয়াল অ্যাভিডেন্স সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তিনি লাঠি চার্জে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে রয়েছেন প্রিয় কর্মস্থল প্রাঙ্গনে আর আকুতি জানিয়েও হাসপাতালে সময়মত চিকিৎসা পেতে বাধা পেয়েছেন। হাসপাতালে এই শিক্ষক প্রাণে বাঁচতে চেয়েছেন কিন্তু পরাজিত হয়েছেন। যৌক্তিক দাবি নিয়ে জীবিকাকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিলেন, সেখানেও পরাজিত হয়েছেন। পুলিশের লাঠিচার্জে তার নাকি মৃত্যু ঘটেনি; ফরমায়েশি বয়ান বলছে, তিনি 'হৃদরোগে' মারা গেছেন।  ইহলোক বীভৎসভাবে সাঙ্গ হওয়ার পর শেষকৃত্য হয়ে ওঠে আরও মর্মস্পর্শী। শিক্ষকের জানাজাতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। প্রাণপ্রিয় শিক্ষকের জানাজাতে অংশ নিতে না পারা কয়েকজন শিক্ষার্থীর অঝোরে কান্না আর আবেগের নির্বাক চিত্র সবাক হয়ে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগের নিউজ ফিডে। অপমানিত আর  অপঘাতে নিহত সহকর্মীরা, আপনাদের জন্য আমরা 'সুবিচার প্রার্থনা করছি', যতটুকু না আপনাদের জন্য তার চেয়েও অধিক আমাদের অনাগত প্রজন্মের জন্য-- যাদেরকে আলোকিত করার দায়িত্ব নিয়েছেন আপনাদেরই মতো নিগৃহীত হতভাগ্য শিক্ষকেরা।             

লেখক: অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটিতে), নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ