X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নারীর প্রতিবাদের নিজস্ব ভাষা

সাদিয়া নাসরিন
০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:২১আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:২২

সাদিয়া নাসরিন ‘জেন্টললেডিস অ্যান্ড ম্যান’—নতুন ভাষা এভাবেই তৈরি হয়। যুগ যুগ ধরে শুনে এসেছি, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’। নারী তো কেবল ‘লেডি’ আর পুরুষ ‘জেন্টলম্যান’! আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ভাষায় ‘ম্যান’ বা ‘মানুষ’ এক মহান শব্দ, যা পুরুষকেই বোঝায়। পুরুষ পবিত্র, ভদ্র, শুদ্ধ, মহিমান্বিত। নারীর সমার্থক শব্দে কোথাও ‘মানুষ’ নেই, বরং বলা হয় ‘মেয়েমানুষ’ অর্থাৎ, গৌন প্রজাতি, দ্বিতীয় লিঙ্গ। দক্ষিণ এশীয় জেন্ডার বিশেষজ্ঞ কমলা ভাসিন শব্দ নিয়ে খেলেন, উলটপালট করে ভাষার রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করেন এবং পুরুষতান্ত্রিক ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনিই প্রথম ‘লেডি’র সঙ্গে ‘জেন্টল’ শব্দের রসায়ন আবিষ্কার করেন। এই সম্বোধন চালু করেন।
সম্প্রতি বন্ধু-স্বজনরা খুব বলছেন, কেন আমি লেখার সময় আমার নারীসত্তা থেকে বের হতে পারি না বা আমাদের লেখায় এত রাগ কেন? কেন আমরা পুরুষের প্রতি আর একটু সদয় হয়ে লিখতে পারি না? সমালোচকদের প্রায় প্রত্যেকেই নারীবাদী লেখকদের আরও ‘নৈর্ব্যক্তিক’, আরও ‘নিরপেক্ষ’, আরও একটু ‘শালীন’ ভাষায় লেখার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের আমি কী করে বোঝাই, আমি নারী এ কথা যেমন ধ্রুব সত্য, তেমনই সত্য আমার নারীসত্তা। আমার মাতৃত্ব, আমার বঞ্চনা, আমার আপসের দহনই তো আমার রাগ ও প্রতিবাদের উৎস। এই পৃথিবীকে আমি দেখতে পাই, শুধু নারীর চোখ দিয়ে, আমার নারীশরীর ও মন দিয়েই সব ঝড়-ঝাপ্টা-আঘাতকে উপলদ্ধি করি। এসবই তো আমাদের অনুভূতির উৎস, যা দিয়ে আমরা লিখি। আমরা তো আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে লিখতে পারব না।
আসলে নারী কী লিখবে, কতটুকু লিখবে, নারীর প্রতিবাদের ভাষা কী হবে, তা নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা মাপা প্রত্যাশা আছে,  যুগ যুগ ধরেই ছিল। নারী কোন ভাষায় তার বঞ্চনার কথা বলবে, কোন শব্দে নিজের অধিকারের কথা উচ্চারণ করবে, তাও পুরুষই শিখিয়ে দিতে চায়। ইউনেস্কোর রিপোর্ট মিশেল ম্যাটেলারের মন্তব্যে পাওয়া যায়, ‘যে নারী উপন্যাস লেখেন, তাকে বিদ্রোহের প্রতীক না হয়ে ওঠার জন্য  শাশ্বত নারীত্বের প্রতি বশ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। এতদিন নারীরা লিখে এসেছেন  পুরুষের সেই চাহিদার সঙ্গে আপস করেই। তাই খনা পুরুষতন্ত্রের ভাষায় বলেছেন, ‘পুড়বে আগুন, উড়বে ছাই/ তবেই কন্যার গান গাই’। কুসুমকুমারীরাও সাহিত্যে পুরুষকেই দেখেছেন বারবার, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’

কিন্তু সবাই তো সেই চাহিদামতো বলেন না, লেখেন না। সবাই পুরুষ চাহিদার প্রতি বশ্যতার প্রমাণ দেন না। সেই প্রমাণ দিতে না পারলে নারীবাদীরা পড়ে যায় পুরুষের আক্রমণের মুখে এবং সেই আক্রমণ নারীবাদ থেকে ব্যক্তি নারী পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে যায়। তাই খনার জিভ কেটে নেওয়া হয়, ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা হয় জোয়ান অব আর্ককে। নিষিদ্ধ হয়ে যান তসলিমা নাসরিন, ব্যক্তি জীবন উঠে আসে তুরুপের তাসে, মাথা নিলামে ওঠে।

তবু, পুরুষতান্ত্রিক ভাষার রাজনীতি ডিঙিয়েই শিখিয়ে দেওয়া প্রভুর ভাষা, প্রভুর কৌশল প্রত্যাখ্যান করে বা তাকে অতিক্রম করে গড়ে উঠছে নারীর নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব প্রতিবাদ। হাজার বছর ধরে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য এমন ভাষা তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নারীকে হেয় করা হয়েছে। যেমন নারীর জন্য ‘অবলা’ যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, সে অর্থে পুরুষকে ‘অবল’ বলা হয় না। ‘বেশ্যা-পতিতা-খানকি-ছিনাল-বনিতা-ভ্রষ্টা’ কত শব্দ তৈরি করেছে নারীকে কলঙ্কিত করতে, যেগুলোর কোনও পুরুষবাচক শব্দ নেই। এমনকি, রূপকথার সব খলচরিত্র ডাইনি অথবা পেত্নী, রাক্ষস হিসেবে যাদের চিত্র আঁকা হয়, তারাও নারী। তাই আজ যখন নারীরা সমান অধিকারের কথা বলছে, তখন লিঙ্গবৈষম্যের এসব শব্দ, বাক্য, ভাষা আর সাহিত্যের বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ করেই এগুতে হচ্ছে নারীদের।

পুরুষালি শব্দের শ্রেষ্ঠত্ব চ্যালেঞ্জ করে তাই ‘সুপারওমেন’, ‘শিরো’ (হিরো), ‘জেন্টলওমেন’, ‘ওমেনলি’, ‘সিস্টারহুড’, ‘ওমেনহুড’ ইত্যাদি নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে নারীবাদী লেখকদের অভিধানে। দাসজীবনের শৃঙ্খলমুক্ত ভাষা ব্যবহার করছে নারীরা। তাই ‘হাজব্যান্ড’ ‘স্বামী’ ‘কর্তা’ ‘ভাতার’ অথবা ‘স্ত্রী’ ‘ভার্যা’ বা ‘বধূ’ ‘ভরনীয়া’ এসব শব্দের দেয়াল ভেঙে নিজেদের পার্টনার বা সঙ্গী হিসেবেই পরিচিত করছে। বংশপরিচয়ের আধিপত্য বজায় রাখতে ‘পুরুষানুক্রম’ শব্দের পাশে চালু হয়েছে ‘নারীক্রম’ ‘পূর্বনারী’ ‘উত্তরনারী’। চারিত্র্যিক নিপীড়নের ভাষাকে উলটে দিয়ে মেয়েরা উচ্চারণ করছে এবার ‘পতিত’, ‘রক্ষিত’, ‘ভ্রষ্ট’ ও ‘নষ্ট’ । ‘প্রস্টিটিউট’ বললেও নারীর কথাই ভাবা হয়, তাই যৌনপেশার পুরুষের জন্য ‘জিগোলো’ শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে, ‘কলগার্ল’ হয়েছে ‘কলবয়’। ‘মেয়েলি’-‘পুরুষালী’ ভাষার লৈঙ্গিক রাজনীতি চ্যালেঞ্জ করে লিঙ্গসাম্যের প্রচলন করছে ভাষায়। প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ, অনারারি এগ্রিমেন্ট, আনক্লেইমড টেরিটোরি ইত্যাদি শব্দ এসেছে ম্যান অব দ্য ম্যাচ, জেন্টলম্যান এগ্রিমেন্ট, নো মেনস ল্যান্ড-এর বদলে। এমনকি কবি যখন কবিতায়ও নারীকে নিয়ন্ত্রণ করে বলেন, ‘সুরঞ্জনা ওইখানে যেওনাকো তুমি, বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে’, তখন নারী উচ্চারণ করে, ‘যাব না কেন? যাব।’

কেন ভাষা নিয়ে এই অহেতুক বিতর্ক, এসব যুক্তি দেখানোর সুযোগ দেওয়া যাবে না আর। কারণ এই ভাষা-সাহিত্যের সূক্ষ্ম রাজনীতিতেই এতকাল নির্ধারণ করা হয়েছে কে প্রভু আর কে দাসী, কে কর্তা আর কে কর্ম, কে শক্ত আর কে কোমল, কে যন্ত্রী আর কে যন্ত্র। এই ভাষার ব্যাকরণ দিয়েই নির্ধারণ করা হয়েছে প্রথম লিঙ্গ হচ্ছে পুংলিঙ্গ, যে প্রত্যক্ষ, ইতিবাচক, শক্তিমান, চালক। আর স্ত্রীলিঙ্গ হলো দ্বিতীয় লিঙ্গ, যে সবসময়ই পরোক্ষ, পুরুষের ছায়া, পুরুষের বিজয়ের পেছনের কায়া-প্রেরণাদাত্রী।

সমাজে পুরুষতন্ত্রের যে  ক্ষমতা, ভাষা সেই আধিপত্যের জমিনকে পোক্ত করেছে তার শব্দ, বাক্য অথবা প্রবাদ। ভাষাগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, নারীকে নিপীড়ন করতে ভাষার রাজনীতি কিভাবে পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসনকে পোক্ত করার মূল শক্তি হয়ে ওঠে তা বিশ্লেষণ করা। প্রতিপক্ষকে ওই ভাষার মুখোমুখি করা দরকার।

কারণ, পুরুষতন্ত্রের শেখানো অনুষঙ্গকে অতিক্রম করে প্রাণ আর শক্তির উৎস হিসেবে নারীর পুনর্নির্মাণ আগে যদি  অভিধানে না হয়, তবে কিভাবে হবে মানুষের সংস্কার আর মনস্তত্বে? নারী যতক্ষণ নিজে তার নিজস্ব শব্দ আর ভাষার নির্মাণ আর চর্চা করার সাহস না দেখাবে না, ততক্ষণ কেউ ‘সম্মান’ তার হাতে এনে তুলে দেবে না। নারীবাদী কবি ‘অ্যাড্রিয়েন রিচ’-এর মতোই আমরা বলি, ‘চেতনার জাগরণ সীমান্ত পেরোনোর মতো নয় যে, এক পা এগুলেই অন্যদেশে। অন্যের ভাষায় লিখে বা বলে নারীর জীবনকে বোঝা অসম্ভব। আমরা শেক্সপিয়রেরে চেয়ে অনেক বেশি জানি মেয়েদের জীবন। আমাদের জীবন তার চেয়ে অনেক জটিল। সুতরাং আমাদের কথা আমাদেরই বলতে হবে, আমাদের যেতে হবে এক দীর্ঘস্থায়ী রাগের মধ্য দিয়ে।

শুধু আমি নয়, আমরা সব মেয়েই আসলে তা-ই করছি। তাই সম্প্রতি মেয়েদের লেখায় শিরা টানটান করা রাগের কথা থাকে। যে কথাগুলো এতদিন অনুচ্চারিত ছিল, যে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা এতদিন উপেক্ষিত ছিল, সেসব কথাই আজ আমরা লিখছি। আমরা মেয়েরা একজায়গায় হলেই বুঝতে পারি আমাদের যন্ত্রণা এক, ক্ষোভ এক, বঞ্চনা এক, স্বপ্ন এক, অনুভূতিও এক। যে অনুভূতি, যে অভিজ্ঞতা মেয়েদেরই একান্ত, যা নারীর শরীর ও মন ছাড়া অনুভব করা সম্ভব নয়, তাকেই নতুন করে উদ্ধার করা হচ্ছে নারীর ভাষায়।

তাই আমাদের প্রতিবাদও হচ্ছে এক নারীবাদের ভাষায়, পুরুষের প্রেসক্রিপশনে নয়। তাতে যদি নারীর সঙ্গে পুরুষের, নারীর সঙ্গে নারীর বিরোধ হয়, হোক। সে বিরোধ যদি নারীর সঙ্গে পুরুষের, নারীর সঙ্গে নারীর নতুন বোঝাপড়া তৈরি করে, তবেই তা সার্থক। সেই বিরোধ আর সমঝোতা থেকে উঠে আসবে এক নতুন মহাকাশ ‘নারীর নিজস্ব ভাষা’। তৈরি হবে নতুন পাঠক, যারা নিজেকে যোগ্য করে তুলবে নারীর জন্য, নতুন ভাষার জন্য। 

(তথ্যসূত্র: তসলিমা নাসরিন, হাসান ইকবাল: ভাষা, নারী ও পুরুষপুরাণ)

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ, কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ