X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ভয়ে ভয়ে একটি প্রশ্ন

চিররঞ্জন সরকার
১২ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৩৭আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৪০

  চিররঞ্জন সরকার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আজ পঁয়তাল্লিশ বছর পর ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, সে দিনের ‘স্বাধীনতা’ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল কি? স্বাধীনতা সবাইকে, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-ধনী-গরিব-নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে কি? নাকি ‘সংখ্যাগুরু’ জনগোষ্ঠীর আধিপত্য কায়েমের সুযোগ করে দিয়েছে?
পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ষোলই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা পেলাম। কে আমাদের সেই স্বাধীনতা দিল? স্বাধীনতা কি কেউ কাউকে দেয়? গচ্ছিত ধনের মতো অবয়ব ও ওজনদার কোনও বস্তু কি এই স্বাধীনতা, যার বিনিময় সম্ভব? নাকি স্বাধীনতা একটি ধারণা মাত্র, একটি নির্ধারিত পরিসরে, কিছু বিধিবন্ধন সাপেক্ষে তার অস্তিত্ব? স্বাধীনতা আসলে ঠিক কী? স্বেচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাই কি স্বাধীনতা? প্রতিষ্ঠান যে সিদ্ধান্ত নেয়, তার পেছনে থাকে মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত ইচ্ছার প্রকাশ! তা যেমন অবাধ হতে পারে না, তেমনই ব্যক্তির আত্মঘাতের মতো স্বেচ্ছা সিদ্ধান্তকেও আমরা স্বাধীনতার অধিকার হিসেবে মেনে নিতে পারি না। সুতরাং ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাই হোক, স্বাধীনতাকে একটা খোলা মাঠের সঙ্গেও তুলনা করা যায়, যার সীমা আছে। আবার পরিসরও আছে।
স্বাধীনতা আসলে সেই আশ্চর্য পুতুল, যে মেলায় ঘুরে ঘুরে খেলা যখন দেখায়, আলো আঁধারিতে তার নড়াচড়া স্বেচ্ছাকৃত মনে হয় এবং দর্শক এক কাহিনির মধ্যে ঢুকে পড়েন। সেই পুতুলের প্রত্যেকটি নড়াচড়া তৈরি হয় অন্তরালে বসে থাকা কোনও ব্যক্তির হাতে বাঁধা সুতোর টানে। আপাতদৃষ্টিতে যা চোখে পড়ে না।
এখানে সুতো নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি প্রতীক মাত্র। তার জায়গায় আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বসিয়ে দিতে পারি, সমাজ, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং জাতীয় ঋণ বা গড় জাতীয় আয়কেও বসিয়ে দিতে পারি। এমনকী, রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল প্রেম-প্রণয় বিষয়ে কোন নীতি বিশ্বাস করে, কাদের প্রতি তাদের মমত্ব, কাদের ব্যাপারে উদাসীনতা তাই দিয়েও স্বাধীনতার সুতো তৈরি করা যায়।
তা হলে ষোলই ডিসেম্বর আমরা কী পেলাম? সে দিনের সেই স্বাধীনতার নাম আসলে ক্ষমতার হস্তান্তর। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড শাসনের ক্ষমতা। এক রাষ্ট্রের জন্ম, যে রাষ্ট্র সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেই ভূখণ্ডজাত মানুষ। সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশবাসী এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাদের দেশ আমরাই শাসন করতে চাই। এরই নাম স্বাধীনতা।
কিন্তু সে দিনের ‘স্বাধীনতা’ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল কি? স্বাধীনতার পর একটু একটু করে রাজনীতির কুটিল প্রয়োগ কি দেশ সম্পর্কে ধারণাটি ছিন্নভিন্ন করে দেয়নি? একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সব মানুষের, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা যে অপ্রতিষ্ঠিত থেকেছে, তা কী গত ৪৫ বছরে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি? দেশ সম্পর্কিত বোধ, স্বাধীনতার ধারণা, ন্যায়-নৈতিকতা বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন আজও নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য উপসংহারে কি পৌঁছতে পেরেছে?
স্বাধীনতার পর দেশের প্রতিটি কোণায় গর্ব, আবেগ এবং দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে লালসবুজ পতাকা উড়েছে ঠিকই। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ নির্যাতন-সহিংসতা-অপমানের শিকার হয়ে নিঃসম্বল অবস্থায়, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে, চূড়ান্ত অসহায়তায় দেশত্যাগের নীরব অভিযাত্রায় শামিল হয়েছে! ‘স্বাধীনতা’-র বোধ এবং আবেগ তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার মানে সবার কাছে অর্থপূর্ণ করার, স্বাধীনতার স্বাদ যেন সবাই পায়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কী কারও নেই? বিষয়টি কী কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে, কোনো জ্ঞানী-গুণীর কাছে, কখনও আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে?

স্বাধীনতার মূল্য হিসেবে সেই সব মানুষকে যে ভূখণ্ড থেকে নীরবে বিতাড়ন করা হচ্ছে, সেই মাটিতেই তাদের জন্ম হয়েছিল, সেখানেই ছিল তাদের পিতৃপুরুষ ও মাতৃকুলের চিহ্ন, সেখানের জমি, ফসল, রোদ, বায়ু এবং সংস্কার নিয়ে বংশ পরম্পরায় যে জীবন প্রোথিত ছিল সেই ছিল তাদের ‘দেশ’। ‘স্বাধীন দেশ’ সম্পর্কিত গর্বের কিন্তু যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির গ্রাহ্যতা তাদের ক্ষেত্রে অন্তত সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল কি? তারাও নিশ্চয়ই পাকিস্তানের অধীনতা চাননি। কিন্তু দেশাত্মবোধ পাল্টাতেও কি চেয়েছিলেন?

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই যন্ত্রণার কথাটি খুব করে মনে জাগছে। স্বাধীনতার নানাবিধ সংজ্ঞা এবং প্রকৃতি আমাদের সামনে উদ্ভাসিত। পরাধীন পূর্ববাংলায় মনে হয়েছিল রাষ্ট্রিক স্বাধীনতাই নাগরিকের সার্বিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্রমশ মৌলবাদ ও ধর্মমুখী রাজনীতির মর্মান্তিক পরিণতি দেখিয়ে দেয়, স্বাধীনতার চেতনা রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিমানসে সর্বত্র এক বিন্দুতে মেলে না।

রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নাগরিকের জীবন এবং ভূখণ্ড রক্ষা করে। সেই ভূখণ্ড দেশ, সেই নাগরিকবৃন্দও দেশ। সেই দেশের মধ্যে আছে সমাজ, ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি। আছে নিয়ত বিবর্তনশীল মানবিক সত্তা। যা সমাজের প্রতিটি দিক, প্রতি ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মানুষের নৈতিকতা ও আচরণবিধির মধ্যে পরিবর্তন ঘটায়।

অর্থাৎ, দেশ সম্পর্কে ধারণার মধ্যে রাষ্ট্র সর্বত্র প্রবেশাধিকার পায় না। কারণ রাষ্ট্র সম্যক বিধি ও নিয়মকানুন তৈরি করে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে। সেটা বাইরের কাজ। বোধ ও বিশ্বাসে তার হাত নেই। সেখানে চিত্তবৃত্তির স্বাধীনতা। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা।

একজন ব্যক্তি প্রাথমিক ভাবে একজন একক সত্তা। তারপর সে সামাজিক সত্তা। এরপর সে এক রাষ্ট্রীয় পরিচিতি, যাকে জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু সেই ব্যক্তি ছবি আঁকবে কিনা, গান গাইবে কিনা, আমিষ ভোজন করবে কিনা, ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে কিনা ইত্যাদি বহুতর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকে না।

রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের গুরুত্ব সমান। কারণ রাষ্ট্র নৈর্ব্যক্তিক, একটি কাঠামো মাত্র। দেশবাসীর অধিকারগুলি সুরক্ষিত করার বিধিবন্ধন। সমাজের প্রয়োজনে নিয়ম সৃষ্টি করা হয়, সমাজ তার রক্ষক সৃষ্টি করে, শৃঙ্খলার নির্ণায়ক এবং পরিচালক। তাকে আমরা বলছি ‘সরকার’ বা গভর্নমেন্ট। যে পরিকাঠামো অবলম্বন করে শাসনপ্রক্রিয়া চালায় ‘সরকার’ সেই হল রাষ্ট্র। প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের অধীন এবং রাষ্ট্রের অংশ। রাষ্ট্র নাগরিকদের স্বাধীনতা, জীবন, অধিকার এবং নিরাপত্তার রক্ষক। অর্থাৎ দেশ ও দেশবাসীর জীবনের ও স্বাধীনতা রক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান।

অনেক সময় রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো নাগরিক অধিকার হরণ করতে থাকে। অর্থাৎ, এই দেশেরই কতিপয় নাগরিক, যাঁরা শাসনপ্রণালির পরিচালক, ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন। সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর স্বাধীন থাকতে পারে না। রাষ্ট্রীয় নীতি, সর্বজনস্বীকৃত সংবিধান ও আইন একটি মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তা হল মানবিক সততা। যে মুহূর্তে কোনও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়, রাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তার অপব্যবহার ঘটতে থাকে, নাগরিকবৃন্দও আর স্বাধীন থাকেন না। তখন একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে আরেকটি গোষ্ঠী ভূমিকা পালন করে। এতে করে অনেক মানুষরেই স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়।

তখন আসে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। অধিকার বোধের সঙ্গেই তাদের উদ্ভব। কারণ স্বাধীনতা মানে কেবল শাসন প্রক্রিয়ার ক্ষমতা হস্তান্তর নয়, স্বাধীনতা একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া যা সচেতন নাগরিককে অর্জন করে চলতে হয়। স্বাধীন দেশে আমরা ভোটাধিকার পাই এবং শাসনকার্যের প্রতিনিধি নির্বাচন করি (যদিও আমাদের দেশে সব সময় ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ মেলে না)। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশচালনার যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুধু ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নাগরিকের কর্তব্য শেষ হয় না। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নজরদারিও তার নিজের অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে। এই চেতনা যত বেশি করে উৎসারিত হয়, তত সমাজের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল। আমাদের দেশে সেটা খুব একটা উজ্জ্বল নয়।

রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের সীমা কতদূর, শাসকরূপী নাগরিকদের তা ভুললে চলে না। তাদের অবিমৃষকারী ভূমিকার কারণে কারও ন্যূনতম নাগরিক ও মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কি-না, তা-ও নাগরিক সচেতনতাই নির্ধারণ করে।

কর্তব্যের অঙ্গীকারে স্বাধীনতা প্রতি মুহূর্তে অর্জন করতে হয়, প্রতি ক্ষেত্রে, জীবনে এর চেয়ে বৃহৎ সত্য আর কিছু নেই। কিন্তু আমরা কি এই সত্যটি কখনও উপলব্ধি করি? স্বাধীন দেশেও যে এক শ্রেণির মানুষ আজও পরাধীন, অধিকারবঞ্চিত, সেই সত্য অনুভব করি? স্বীকার করি?

তা যদি না করি, তাহলে আর কিসের স্বাধীনতা, কিসের বিজয়!

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ