X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্প শাসনে কেমন হবে বিশ্ব পরিস্থিতি

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২৩আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৪৩

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী সোমবার (১৯ ডিসেম্বর)  ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচিত সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট দিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এটাই শেষ পর্ব। এখন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি শপথ নেবেন। বিশ্ববাসী  বিশেষ এক উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় আছে, তিনি কি আমেরিকার অন্যান্য প্রেসিডেন্টের মতো হবেন, না হিটলারের মাসতুতো ভাই হবেন, তা দেখার জন্য।
অ্যাডলফ হিটলারও কিন্তু মুক্ত ও অবাধ স্বাধীন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। তিনিও গ্রেট জার্মানির স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং মানুষকেও সে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। জার্মান জাতি আর্য, সে গর্বও ছিল তার। সম্ভবতো ৬০ আখ ইহুদি হত্যা করে তিনি জার্মানিকে আর্যদের জন্য প্রোমিজ ল্যান্ড বানাতে চেয়েছিলেন।
সমস্যা জর্জরিত জার্মানিতে অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে পুরানো সরকার যখন বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল এমতাবস্থায় জার্মানির সাধারণ জনগণ নাজি পার্টির হিটলারের বড় বড় কথায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং ১৯৩৩ সালের নির্বাচনে ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে হিটলার সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।একই অবস্থা বিরাজ করছিল আমেরিকায় এবং বড় বড় কথা বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পও নির্বাচিত হলেন। ২০০৮ সাল থেকে আমেরিকা চরম অর্থনৈতিক মন্দার মাঝে দিন অতিবাহিত করছিল।

২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারির ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের দিন। সম্ভবত সেদিন থেকে বিশ্ব এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে পথ চলা শুরু করবে। ট্রাম্প যে সব ব্যবসায়ী ও জেনারেলের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, তা দেখে মনে হচ্ছে বিশ্বের বিরাজমান সংকট নিরসন হওয়া তো দূরের কথা, যেকোনও ঠুনকো বিষয়েও বিশ্ব বড় বিপদের সম্মুখীন হতে পারে।

বিশ্লেষকেরা এমনও কথা বলছেন, ট্রাম্পের সময়ে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হওয়াও বিচিত্র নয়। শুধু একটা ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে যে, ট্রাম্প সম্ভবত রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে ইচ্ছুক। ইতোমধ্যে ট্রাম্প তার মন্ত্রিসভায় সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রেক্স টিলারসনকে। টিলারসন বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি এক্সন মবিলের প্রধান নির্বাহী এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বন্ধু। তিনি শুধু পুতিনের বন্ধু নন, রাশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তি আইগর ইভানোভিচ সেচিনেরও ব্যক্তিগত বন্ধু।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানি রোজনেফটে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এক্সন মবিল। ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তির পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন অবরোধে বসেছিল, তখন রেক্স টিলারসন তার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিলেন। রাশিয়া তার এ সাহসী ভূমিকার জন্য ২০১৩ সালে রেক্স টিনারসনকে ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন।

আমেরিকার প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষ রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার বৈরিতা দেখতে অভ্যস্ত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের উদ্যোগ আমেরিকার মানুষ কিভাবে গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ দেখে বোঝা যাবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে দুর্ভোগ পোহাবে সম্ভবত মুসলিম বিশ্ব। ট্রাম্প তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন মেরিন কর্পসের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল জেমস ম্যাটিসকে। তিনি ম্যাড ডগ (পাগলা কুকুর) নামে পরিচিত আবার কেউ কেউ তাকে তার যুদ্ধপ্রীতির জন্য যুদ্ধবাজ সন্ন্যাসী বলেও আখ্যায়িত করেন। মাট্টিস ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ ও ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা অভিযানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি অবসরে যান। তার বয়স এখন ৬৬ বছর। এই যুদ্ধবাজ লোকটি মুসলিমবিদ্বেষী, বিশেষ করে ইরান তার চক্ষুশূল।

ট্রাম্প তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইকেল ফ্লিনকে। মার্কিন গোয়েন্দা এজেন্সির সাবেক প্রধান ফ্লিন মুসলমানদের আমেরিকা প্রবেশেরও বিরোধী। অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ট্রাম্প নিয়োগ দিয়েছেন সিনেটর জেফ সেশন্সকে। তিনি ইসলামকে বিষাক্ত মতাদর্শ বলে মনে করেন। এছাড়া মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত মাইকেল পম্পিওকে সিআই-এর প্রধান হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন।

গুরুত্বপূর্ণ পদে যাদের ট্রাম্প নিয়োগ দিলেন, তারা সবাই একতরফা লোক। একতরফা লোকের বিচার-বিবেচনা একতরফাই থাকে। এ বিবেচনাহীন মানুষগুলো বিশ্বকে যেকোনও সময় বিপদের মুখে টেলে দিতে কুণ্ঠিত হবে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প এরই মাঝে ঘোষণা করেছেন প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের কোনও কিছুই তিনি মানবেন না।

১৯৯২ সালের ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলন থেকে কোনও কথাই আমলে নিচ্ছিল না আমেরিকা। শেষ পর্যন্ত বারাক ওবামা প্যারিস সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্পের সুস্পষ্ট ঘোষণা তিনি আমেরিকায় বেকার সৃষ্টিতে সহায়তা করে এমন কোনও পরিকল্পনায় সায় দেবেন না। তিনি আরও বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ কল্পনাপ্রসূত। জুনিয়ার বুশও প্রেসিডেন্ট থাকার সময় অনুরূপ কথাই বলতেন।

আমেরিকাকে কোনও কাজে বাধ্য করা বাদবাকি দুনিয়ার সাধ্যাতীত। তারা ভোগবাদী, তারা দুনিয়ার স্বনিয়োজিত অভিভাবক। তারা সহজে কারও মতামত গ্রাহ্য করে না। নগরে আগুন নাগলে যেমন দেবালয় রক্ষা পায় না, তেমনি পৃথিবীর এ সংকট থেকে সুখী দেশগুলোও রক্ষা পাবে না। এ সংকট তাদের ওপরও প্রতিশোধ নেবে।

কিন্তু  তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো এ সংকট সামাল দেই কিভাবে! এ সংকট সামাল দিতে তো প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। দারিদ্র্য তো বিপদ বুঝবে না। খেয়ে না খেয়ে হলেও এখাতে তো প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করতে হবে।

ইসরায়েল পশ্চিম তীরে পুনরায় ইহুদি বসতির জন্য গৃহ নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেছে। মিশর নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণের জন্য একটা প্রস্তাব এনেছিল। আমেরিকা এ প্রস্তাবের ভেটো দেবে না বুঝতে পেরে ট্রাম্প মিশরের প্রেসিডেন্ট শিশিকে টেলিফোন করেছেন নিন্দাপ্রস্তাব ভোটাভুটির আগে প্রত্যাহার করে নিতে। শিশিও ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প এর কথা না শুনলে বিপদ আসতে পারে—সম্ভবত তা চিন্তা করে নিন্দাপ্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়।

এ যাবৎ ইসরায়েল চেষ্টা করছে আমেরিকার দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের জন্য। কোনও প্রেসিডেন্ট সম্মত হননি কিন্তু ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর দূতাবাস জেরুজালেমে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেবেন। নিরাপত্তা পরিষদে মিশর প্রস্তাব প্রত্যাহারের কথা বলার পরও নিরাপত্তা পরিষদ ভোটাভুটি থেকে বিরত হয়নি। যথাযথ ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়নি অবশ্য,  বিরত ছিল। প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

ইহুদির ছেলের কাছে ট্রাম্প মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন আর তার ছেলেও বিয়ে করেছে ইহুদি সম্প্রদায় থেকে। ট্রাম্প পারিবারিক পরিবেশেও ইহুদি সম্প্রদায় কর্তৃক প্রভাবিত হবেন। এখন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কী করবে, তার একটা স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে গেছি। ফিলিস্তিনিরা কখনও আমেরকার সহানভূতি পায়নি। মাঝে মাঝে কাটার, ক্লিনটন আর ওবামার মতো প্রেসিডেন্টের ছিটেফোঁটা যে সহানভূতি পেতো, এবার ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে তাও জুটবে না। সুতরাং ফিলিস্তিন এলাকায় নিশ্চয়ই সন্ত্রাস বাড়বে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নীলনকশা ছিল, তার অস্থিত্বের প্রয়োজনে ইরাককে শেষ করা। ইরাক ধ্বংস হয়েছে এবং এখন তার প্রচেষ্টা হচ্ছে ইরানকে ধ্বংস করে দেওয়া। ইরানের দিকে নাকি ১০০ ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল তাক করে বসিয়ে রেখেছে। ট্রাম্পও এ ব্যাপারে একমত। পরাজিত প্রার্থী হিলারিও নির্বাচনি প্রচারের সময় বলেছিলেন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ইরান আক্রমণ করবেন। সুতরাং বলা যায় ইরান এখন ঝুঁকির মুখে।

ইরান যে পারমাণবিক চুক্তি করেছে, তা নাকি ট্রাম্প টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। অথচ এ চুক্তিটা জাতিসংঘ অনুমোদন দিয়েছে। ছয় জাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে যে পারমাণবিক চুক্তি করেছিল ইরান, শুরু থেকে এই চুক্তিবিরোধী ম্যাকফারল্যান্ডকে ট্রাম্প তার নিরাপত্তা উপ-উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দিয়েছেন। ইরানকে সামাল দেওয়া নাকি হবে তার কাজ। ইরান পরমাণুশক্তি চালিত জাহাজ নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেছে এবং তার আন্তর্জাতিক মিত্র রাশিয়াও চীনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে।

চীনকে নিয়ে ট্রাম্পের মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি। ট্রাম্প চীনের সঙ্গে আমেরিকার ব্যবসা বাণিজ্যের পুনর্বিন্যাস করবেন। এ কথা ঘোষণা দিয়েছেন। চীনও পাল্টা ব্যবস্থা আরম্ভ করে দিয়েছে। চীন আমেরিকা থেকে ৩২০ কোটি ডলার বার্ষিক খাদ্যশস্য কেনার একটা রুটিন ব্যবসা ছিল। চীন খাদ্য কেনার সে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে।

বিশ্ব চরম এক অস্থিতিশীল যুগে প্রবেশ করছে। সমগ্র বিশ্বের মানুষ চেয়ে আছে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর কী পদক্ষেপ  নেন তার দিকে। ট্রাম্প যে সব কথা বলছেন, তা যদি সত্যই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন, তবে বিশ্ব পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে এবং আমেরিকার অর্থনীতি ও মহামন্দার কবলে পড়বে।

বিশৃঙ্খলা ও মন্দার কবলে পড়লে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় কাঠামোই হুমকির মুখে পড়বে। বিশ্বশান্তি যেমন বিধ্বস্ত হবে, ঠিক তেমনি বিশ্বব্যবস্থাও ক্ষতবিক্ষত হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ