X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিয়ে ভাবনা

বিথী হক
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:২১আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৪:৩৫

বিথী হক বিয়ে যেন নারী জীবনের চরমতম পরিণতির নাম। বিয়ে ছাড়া নারী জীবন বৃথা এমন একটি প্রচলিত অস্পৃশ্য ষড়যন্ত্র গুমোট বেঁধে সমাজের সর্বস্তরের নারীদের মানসিকতাকে ভয়াবহভাবে ধ্বংস করে ফেলছে। শিক্ষিত নারীরাও স্ব-নির্ধারিত শিক্ষার সীমা অতিক্রান্ত হলেই বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। অপরদিকে সমাজের অবহেলিত বা অন্যের বাসায় গৃহস্থালির কাজ করে যে মেয়েটা তারও দিনশেষে একই চিন্তা, বিয়েটা হওয়াই চাই। কিন্তু হওয়া চাই কেন? সে প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষিত মেয়েরাও যেন কিছুটা নেতিয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে কোনোমতে নিজেকে সামলে বলতে পারেন, নিরাপত্তার জন্য বিয়ে আবশ্যক। আর অপরপাশের গায়ে-গতরে খাটো মেয়েটা একগাল হেসে বলেন, একটা সংসার আর বাচ্চা না হলে কি নারী জীবন পূর্ণ হয়? উত্তর আলাদা হলেও ভাবার্থে দুটো উত্তরই এক, প্রয়োজন গভীর ভাবনা।
শিক্ষিত নারীরা আসলে কিসের নিরাপত্তা চান তা অবশ্য খোলাসা করে বলেন না। আগে অর্থাৎ আমাদের মা-খালারা যখন বিয়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিরাপদে রাখতে চাইতেন তখন বিষয়টা আমলে না নেওয়ার মতো ছিল। কিন্তু এখন তো বেশিরভাগ মেয়েরা পড়াশোনা করার সুযোগ পান, উচ্চ-শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করতে পারেন। শুধুমাত্র নিরাপত্তার ঘোল খাইয়ে বিয়েকে জীবনের একমাত্র উপজীব্য বানিয়ে ফেলাটা দারুণ হাস্যকর, প্রহসনও বটে। তাতে পাড়া-পড়শিসহ বাকি দুনিয়ার কিছু উল্টাবে না, করা হবে আত্মপ্রতারণা।
জীবনে বিয়ে ছাড়াও কত মজার মজার অভিজ্ঞতা আছে সেসবের খোঁজ ভুলেও কেন নারীরা কখনও করে না তা কে জানেন? ধর্মীয় বা সামাজিক কারণে প্রত্যেকটি না হলেও, বেশিরভাগ নারী-পুরুষ বিয়ে করেন সেটা মোটামুটি নিঃসন্দেহ। কে কী কারণে বিয়ে করবেন সেটাও যার যার অতি-ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করেই বিয়ে করবো, এই চিন্তা যখন আলাদা আলাদা করে সমাজের প্রত্যেকটি নারীর মাথায় ঢুকে স্থায়ী বসবাস শুরু করে তখন বোঝার বাকি থাকে না যে কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। কখনও কোনও পুরুষকে বলতে শুনিনি, সে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করবে। বিয়ে করে আদর্শ বাবা আর সঙ্গী হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে। কিন্তু অধিকাংশ নারীরই স্বপ্ন থাকে সে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করবে।

পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের দেখাশোনা করবে, ভাই-বোনের দায়িত্ব নেবে, নিজের স্বপ্ন ছোঁবে এমন চিন্তা কেন কোনও নারীর হয় না? কী এমন বস্তু প্রোগ্রামিং করে নারীর মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে নারীরা নিজেকে মানুষ না ভেবে শুধুমাত্র নারী ভাবেন? নারী ভাবলেও দোষ ছিল না। নারী-বৈশিষ্ট্যের শরীরকে শারীরিকভাবে নারী না ভেবে উপায়ান্তর নেই কিন্তু দ্বিতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ নেতিবাচক অর্থে নারী ভাবাটা শুধু অন্যায়ই না, অস্তিত্ব খুন করাটা অন্যায়ের চেয়েও গুরুতর।

জন্ম-মৃত্যু একটি চক্র, এতে সবাইকেই অংশ নিতে হয়। প্রথা অনুযায়ী এতে অংশগ্রহণ করতে হলে সমাজ প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে করতেই হবে। সমাজের চোখে অমোঘ হওয়ার কারণে অনেকেই ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত বিয়ে করাকে জীবনের কোনও না কোনও অংশে রাখেন। তবে এক এবং একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেন না। স্কুলের সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা, কলেজের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীটিকে যখন হঠাৎ করে ৫ বছর পরে পোলিও টিকার ক্যাম্পেইনের সময় কালি-ঝুলি মাখা শাড়ি-ওড়না গায়ে দিয়ে কাজল লেপটানো একটা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তখন এ হতাশা শুধু মেয়েটির নয়, তার পরিবারেরও নয়, এমনকি আমার-আপনারও নয়। এর দায় স্বয়ং রাষ্ট্রও এড়াতে পারেন না। যে মেয়েটির দেশের জন্য, সমাজের জন্য কাজ করার কথা ছিল তার একটি রান্নাঘর আর হাঁড়ি-পাতিল ছাড়া জীবনে কিছু নেই এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাটি আর কিইবা হতে পারে!

আজকাল অবশ্য পড়াশোনা করাটা অনেকাংশেই সার্টিফিকেট নির্ভর হয়ে গেছে। বিদেশ ফেরত ছেলেরা সুন্দর-শিক্ষিত নারীদের সঙ্গী হিসেবে বেশি প্রাধান্য দেন। কয়েকজন নারীর সঙ্গে একসঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়ার সুবাদে এই তথ্যটি কান পর্যন্ত পৌঁছালো। তখনই কুমিরের রচনাটি মনে পড়ে গেলো। ঘটনা যাই হোক খাঁজ কাটা অংশ খাঁজ কাটাই থাকবে। প্রতিনিয়ত আধুনিক হতে হতে এখন শিক্ষার মূল লক্ষ্যও বদলে গেছে। একটি প্রচলিত কথা আছে- ‘জ্ঞানার্জন আর সার্টিফিকেট অর্জন এক কথা নয়’। মানুষ সম্ভবত শুধুমাত্র এই দু’কারণেই পড়াশোনা করেন। ওহ বলতে ভুলে গেছিলাম, এই মানুষদের কাতারে পুরুষ ছাড়া অন্য কারও দাঁড়ানোর সাধ্য নেই অবশ্য। নারীরা এই দু’টির কোনও একটি কারণ ছাড়াই পড়াশোনা করে শুধুমাত্র ভালো বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। তবে এখানে পরোক্ষভাবে সার্টিফিকেটের প্রয়োজনীয়তা বিশাল, এর আবেদন কখনও ফুরায় না। পাশের বাসার ভাবী-সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসে গল্প করার সময়ও এই সার্টিফিকেটের অবদান কোনও অংশে হেলাফেলাযোগ্য নয়।

নারীদের এই বিয়েকেন্দ্রিক শিক্ষা-ভাবনাটা গুঁড়িয়ে না দিলে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে এর চরম মূল্য দিতে হবে। সুবিধাভোগী প্রথম লিঙ্গের মানুষ যাবে চাকরি করতে সার্টিফিকেট ধরতে, দ্বিতীয় লিঙ্গ যাবে প্রথম লিঙ্গকে জালে ফেলতে। শিক্ষাহীনতার শিক্ষা নিয়ে এই দু’শ্রেণিই পরে গড়ে তুলবে কাগজের খালি ঠোঙার মতো হালকা ওজনহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠী। নারীকে তাই শুধু রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নয়, পৃথিবীর প্রয়োজনেও বিয়েমুখী শিক্ষার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কোনও বিয়ে টাকার সঙ্গে না হোক, কোনও পড়াশোনাও বিয়ের জন্য না হোক। পড়াশোনা করতে গিয়ে যে বিশাল পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের পরিচয় হয় তা শুধু পুরুষদের একার দখলে না যাক, পুরুষদের পায়ের ছাপেই না ভরে উঠুক। সাথে থাকুক নারী, পুরুষের হাত ধরেই একই পৃথিবীতে হোক নারী-পুরুষের সহাবস্থানে রঙিন একটি বসবাসযোগ্য বিভেদহীন লিঙ্গ-বৈষম্যহীন সুন্দর পৃথিবী। নারীর শিক্ষা গ্রহণ হোক শিক্ষা অর্জনের জন্যই, বিয়ের জন্য নয়।

লেখক: সাংবাদিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ