X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

একালের শাজাহান!

আহসান কবির
১০ মার্চ ২০১৭, ১৩:৪৭আপডেট : ১১ মার্চ ২০১৭, ১৩:৩৫

আহসান কবির আমাগো মন্ত্রী পানির মন্ত্রী/মাস্তানি তার সড়কে
কাদের সাবে তো নিজেই জানে না/ শক্তির দিকে বড় কে!
রিকশার লগে চোটপাট লন?/কোন মাস্তানি বাসে না
চক্ষু নামায়া হাঁটা দেন মিঞা/শাজাহান সাব আছে না?
- রোমেন রায়হান
শুধু রোমেন রায়হানের ছড়ায় না, কবিতায়ও আছেন শাহজাহান।  আমরা কবিতায় পড়েছি-‘তাজমহলের পাথর দেখেছ/দেখেছ কী তার প্রাণ? অন্তরে তার মমতাজ নারী বাহিরেতে শাজাহান!’ শাহজাহান শব্দটা ঐতিহ্যগত ভাবেই যেন মমতাজীয়! তবে আগ্রার তাজমহল দেখে যারা মমতাজ ও শাহজাহানকে বিচার করেন তারা খানিকটা ভুল করে বসেন!

অনেকে বলে থাকেন মোগলদের প্রেমের সিএসআর (সোশাল করপোরেট রেসপনসিবিলিটি।  বিখ্যাত লেখক অরুন্ধতী রায় সিএসআর এর একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- ধরুন কোনও একটা শান্তির গ্রামে কয়লা খনি স্থাপিত হলো।  খনির ছোবলে প্রথমে হারালো গ্রামের জমির ফসল তারপর পশুপাখি।  এরপর মানুষেরা রোগ শোকে ভোগা শুরু করলো।  খনির মালিকরা সিএসআর এর অংশ হিসেবে বিশ কোটি টাকা খরচ করে একটা হাসপাতাল বানিয়ে দিল সেই গ্রামে।  এরপর নব্বই হাজার কোটি টাকা লাভ করে মালিকরা খনি ছেড়ে চলে গেল; একদিন।বিরান সেই গ্রামে রোগ শোকে ভোগা মানুষের সঙ্গে পরে থাকলো সেই হাসপাতাল।  অসহায় মানুষেরা তাদের গাটের পয়সা খরচ করে সেই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে বাধ্য হলো।  এই হচ্ছে সিএসআর!) হচ্ছে তাজমহল।

বাইশ হাজার লোক বিশ বছর ধরে চাবুকের বাড়ি খেয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে তাজমহল বানিয়েছিলেন।এই অমানুষিক কষ্ট কয়জন মনে রেখেছে? যে মমতাজের জন্য সম্রাট শাহজাহানের এতো প্রেম সেই মমতাজের আসল নাম আরজুমান্দ বানু।  তার বিয়ে হয়েছিল কিশোরী বয়সে। শাহজাহান যখন তাকে দেখেন তখন আরজুমান্দ পরস্ত্রী ছিলেন।  নিন্দুকেরা বলেন শাহজাহান তার স্বামীকে খুন করিয়েছিলেন আরজুমান্দকে বিয়ে করার জন্য! যাই হোক আরজুমান্দকে বিয়ে করার পর সন্তান উৎপাদনে মেতে উঠেছিলেন শাহজাহান।  পনেরতম সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে মারা যান আরজুমান্দ ওরফে মমতাজ বেগম, যার জন্য তাজমহল বানিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান।  ভারতের ইতিহাস জানা মানুষেরা যেমন শাহজাহান ও মমতাজকে ভুলতে পারে না, তেমনি এদেশের মানুষেরাও  শাজাহান এবং মমতাজকে নিয়ে মাতামাতি করতে ভোলে না।  পরিবহন ধর্মঘট হলে এদেশের কেউ কেউ তাই ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয় এভাবে- এদেশের মমতাজরা এমপি হওয়ার পরেও গান গায় আর শাজাহানরা মন্ত্রী হওয়ার পরও ডাকে পরিবহন ধর্মঘট!

তবে অন্তত একজন ব্যতিক্রম শাজাহান (আমাদের নৌ পরিবহন মন্ত্রীও একদা জাসদ করতেন!) ছিলেন।  সম্ভবত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং জাসদের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম দিকে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন এবং পুলিশ কিংবা বিডিআরের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।  শাজাহানের মৃত্যুর পর দেয়াল লিখন লেখা হতো এভাবে-জ্বলছে আগুন লেলিহান/শাজাহান শাজাহান! সামরিক জান্তার বিদায় গান/শাজাহান শাজাহান!

তবে শাজাহান খান নামের শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ রয়েছেন যিনি নৌ-পরিবহন (আমরা অবশ্য জল পরিবহন মন্ত্রী বলি না) মন্ত্রী হলেও সড়ক বা রাস্তার ওপর যার দোর্দণ্ড প্রভাব রয়েছে।তিনি নিজেকে পরিবহন শ্রমিক নেতা পরিচয় দিতে খুব ভালোবাসেন! তিনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন এক সময়ের নৌ পরিবহন মন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবরের মতো তিনিও কোন লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটলে ডুবে মরা মানুষের জন্য টাকা আর ছাগল বরাদ্দ করতে ভোলেন না।

ভোলেন না সত্য এবং মজার কথা সুন্দর করে বলতে।  যেমন তিনি বলেছিলেন- যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সব সময়ে যোগ্য লোককেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়।  সড়ক দুর্ঘটনায় মিশুক মুনীর এবং চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নিহত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকরা দায়ী নন! চালকদের যে তিনি খুব বেশি ভালোবাসেন তা তিনি তার কথা দিয়ে বুঝিয়ে দেন।  যেমন চালকদের লেখাপড়া ও অভিজ্ঞতা এবং অবৈধ লাইসেন্স নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি অবলীলায় বলতে পারেন- রাস্তায় নেমে গরু ছাগল চিনতে পারলেই তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যাবে! ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি ও জামায়াত জোটের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে ৯২ জন বাসের চালক ও হেলপার নিহত হয়েছিলেন।  এই নিহত হওয়ার ঘটনাকে শাজাহান খান বলেছিলেন -এটা ছিল অন্যরকম মুক্তিযুদ্ধ।  যদি কাউকে শহীদ উপাধি দিতে হয় তাহলে এদেরকেই দিতে হবে!

তবে তার ভালো কথা অনেকেই বুঝতে পারেন না এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।  ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বর্ষবরণ উৎসবে নারী নিপীড়নের ঘটনাকে তিনি তেমন কোনও ব্যাপার না বলে উল্লেখ করেন।  তিনি বলেন এটা একটা টুকিটাকি ঘটনা হতে পারে, সংবাদ হবার মতো কোনও ঘটনাই না! তার বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন! ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বরে ছাপা হওয়া দৈনিক সমকাল পত্রিকার খবর অনুযায়ী বায়তুল মোকাররম মসজিদের মুসল্লিদের কয়েকজন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানকে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেন।  আগেরদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদে অনুষ্ঠিত হওয়া এক কেরাত অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন শাজাহান সাহেব।  অতিথির বক্তৃতায় বলেছিলেন- হযরত মোহাম্মদ(সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন।  কোনও রাজনীতি করেন নি! তার এই বক্তব্য শুনে উপস্থিত মুসল্লিরা কেন যে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল! ২০১৬ সালে বারভিডা কার এক্সপোর এক অনুষ্ঠানে শাজাহান সাহেব বলেছিলেন মাদ্রাসার ছাত্ররা ( ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খার বাড়ি ভাংচুর করা প্রসঙ্গে বলেছিলেন) বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না।  তাই এরা বাংলার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে চায়।

শাজাহান সাহেব মনে করেন সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে চালকদের বড়জোর তিন থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।  একারণে সড়ক দুর্ঘটনায় কারো যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড হলে তার মনে হয় চালকরা এমন শাস্তির হাতছানি মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না।  আর তাই পরিবহন ধর্মঘটকে শাজাহান সাহেব ধর্মঘট না বলে বলেন স্বেচ্ছা অবসর! সারা দেশের সব চালক নিঃশর্তে ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেও মন্ত্রী তখন চালকদের স্বেচ্ছা অবসরের কথা ভুলে যান! মন্ত্রী আরো ভুলে যান যে আদালতের রায়ের বিরোধিতা করছে তার সংগঠন পরিবহন ধর্মঘটের নামে! উল্লেখ্য মাত্র দুজন চালককে আদালত শাস্তি দিয়েছিল।  যার ফাঁসির রায় হয়েছে সেই চালক সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় এক মহিলার গায়ে ট্রাক তুলে দিয়েছিল! আর চালক জমিরের কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর।  আদালত জমিরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।  নৌ পরিবহন মন্ত্রী এই সব খুনি চালকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, পথচারিদের গরু ছাগলের সাথে তুলনা করেছেন।  সেই তিনি আবার নৌ পরিবহন মন্ত্রী হলেও শ্রমিক পরিবহন সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি।  জলের কুমির হলেও ডাঙার অশ্লীল বাঘের সঙ্গে তার বিরল বন্ধুত্ব।  একালের শাজাহানরা সম্ভবত এমনই হয়।  তাই তিনি অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন- ট্রাক বা বাস চালকদের সাবধান করা যাবে, উত্তেজিত করা যাবে না।

শাজাহান সাহেব গণ্যমান্য কিংবা মাননীয় মানুষ।  আমরা তার কথার বাইরে যেতে পারি না।  তাই একটা গল্প বলে বিদায় নেই।  দেশের বিখ্যাত এক হাজাম অবসরে গেছেন।  তিনি কোনও কিছুই ফেলেননি।  অবসরে যাওয়ার আগে এক মুচিকে দিয়েছেন এতদিন যা জমিয়ে রেখেছিলেন।  মুচি হাজাম সাহেবের জমানো জিনিস দিয়ে তাকে সুন্দর একটা মানিব্যাগ বানিয়ে দিল।  মানিব্যাগ নিয়ে হাজাম সাহেব মাঝেই মাঝেই প্রবলেমে পড়তেন।  উত্তেজনা ভর করলেই তার মানিব্যাগটা ব্রিফকেস হয়ে যেত!

এটা ঠিক যে পাবলিককে উত্তেজিত করা ঠিক না! তারা মানিব্যাগকে ব্রিফকেস বানিয়ে দিতে পারে। ভিখারিকে বানাতে পারে রাজা আর রাজাকে বানিয়ে দিতে পারে ভিখারি!

লেখক: রম্যলেখক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুবিতে উপাচার্য-ট্রেজারার-প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ৩ দফতরে তালা
কুবিতে উপাচার্য-ট্রেজারার-প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ৩ দফতরে তালা
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: ম্যাক্রোঁ
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: ম্যাক্রোঁ
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ