X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের মিনার মাহমুদ

ফজলুল বারী
১৫ মার্চ ২০১৭, ১৬:৪৫আপডেট : ১৫ মার্চ ২০১৭, ১৬:৪৯

ফজলুল বারী এখন নয়া পল্টনের গাজী ভবন যেখানে তখন সাদা রঙের পুরনো একতলা একটি বাড়ি ছিল। সে বাড়িতে ছিল সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার অফিস। কথা সাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার পত্রিকাটি দেখাশুনা করতেন। তখন সারাদেশ পায়ে হেঁটে ঘুরে ঢাকায় এসেছি। চোখেমুখে সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণের চনমনে স্বপ্ন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সারাদেশ আঠারো মাসে পায়ে হেঁটে ঘুরে আসা একজন পরিব্রাজকের বিশ্বভ্রমণে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন- সবকিছু ঠিকঠাক করতে মাস তিনেক সময় লাগতে পারে। তখন ইচ্ছে হলো এই সময়টায় ঢাকার কোনও কাগজে কাজ করার। ঢাকা থেকে তখন হাতেগোনা খুব সীমিত সংখ্যক পত্রিকা বেরুত। এরমাঝে সন্ধানীকে বেশ স্নিগ্ধ মনে হতো নিজের কাছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অমর সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ও ধারাবাহিক সন্ধানীতেই ছাপা হয়। প্রিয় পত্রিকাটিতে যদি একটা কাজ পাওয়া যায় এ আশাতেই সন্ধানীতে যাওয়া।
পিঠে তখন বাংলাদেশ ভ্রমণের ঝোলা ব্যাগ। হাতে সারাদেশের লোকজনের অটোগ্রাফের বিশাল সব খাতা। আর নিজের বানানো একটা বিজনেস কার্ড। সুশান্ত মজুমদারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলা হয় তার পত্রিকাটির সঙ্গে একটি সম্পর্ক করতে চাওয়া হচ্ছে। দাদা রস করে জবাব দিলেন, কী ধরনের সম্পর্ক? শারীরিক সম্পর্ক? বৈবাহিক সম্পর্ক? না আর্থিক সম্পর্ক? পরিব্রাজক হিসাবে সারাদেশে মানুষের অনেক খাতির-যত্ন পাওয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকার কোনও মিডিয়ায় তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিলো না। সুশান্ত মজুমদারের কথাতেও বেশ থতমত জব্দ হতে হয়।
সেই টেবিলে আড্ডায় থাকা একজন এক পর্যায়ে ডেকে বাইরে নিয়ে যান। নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমার নাম মিনার মাহমুদ। বিচিত্রায় এক সময় কাজ করতাম। এখন আর করি না। আপনি কী আমার লেখা পড়েছেন কখনও? বলা হয়, না। বললেন, ঠিক আছে। আমি বিচিন্তা নামের একটা পত্রিকা বের করার জন্যে ডিক্লারেশনের জন্যে আবেদন করেছি। কিন্তু ডিক্লারেশন পাচ্ছি না। সে কারণে আমি এখন বেশ হতাশ। আপনাকে দেখে মনে হলো আপনাকে নিয়ে বিচিন্তা নিউজ এজেন্সি নামের কিছু একটা করা যায়। যেখানে আপনাদের সারাদেশের অভিজ্ঞতাগুলো লিখে সেল করা যাবে। আপনি কী আমার সঙ্গে কাজ করতে রাজি? সম্মতির মাথা নাড়া হয়। মিনার মাহমুদ একটা ঠিকানা দিয়ে বললেন, কাল সকালে এখানে চলে আসবেন। আমরা আরও আলাপ করবো। আবার হ্যাঁ বলে চলে আসা হয় সেখান থেকে।

সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয় না। ঢাকায় প্রথম একটা চাকরির অফার। পরের সকালে চলে যাওয়া হয় ৪১/১ দিলু রোডের সেই ঠিকানায়। এটি একটি ভবনের গাড়ি পার্কিং লাগোয়া দুই কক্ষের ছোট একটি বাসা। দরজায় নক করতেই অপরূপা সুন্দরী এক নারী দরজা খুলে দাঁড়ান। মিনার মাহমুদের স্ত্রী কবিতা। তাকে পরিচয় দিয়ে বলা হয় মিনার ভাই আসতে বলেছিলেন। ভদ্রমহিলা বলেন- ওদিকে আরেকটি দরজা আছে। আপনি ওখানে যান। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।

ওপাশের দরজা খুলতেই চোখে পড়ে বিছানায় শুয়ে আছেন মিনার মাহমুদ। তিনি বললেন রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। তিনি একটু ঘুমাবেন। টেবিলের ওপর রাখা সেদিনের পত্রিকাগুলো পড়তে বলেন। মাথা নেড়ে পত্রিকা পড়ায় মন দেওয়া হয়। মিনার মাহমুদ মন দেন ঘুমে।

ঘুম থেকে উঠে তিনি তৈরি হয়ে নিয়ে বললেন- চলেন আমরা এক জায়গায় যাবো। একটা লাল মোরগের মতো মোটর সাইকেলের পেছনে বসতে বলা হয়। চলতে থাকে মোটর বাইক। শুরুতেই দুরন্ত গতি। বারবার তার পিঠে পড়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি আদেশের সুরে বলে বলেন, এভাবে বসতে হয় না। এভাবে বসতে হয়। নিজেকে শুধরে নিয়ে জবাব দোওয়া হয়, জ্বি ঠিক আছে।

মিনার মাহমুদ ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে গিয়ে থামে মোটরবাইক। তাকে অনুসরণ করে ঢোকা হয় বাড়ির ভেতর। এক কক্ষে বসে ছিলেন এক ভদ্র মহিলা। তার সামনে বসা তখনকার দিনের জনপ্রিয় অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল হোসেন। একটা চেয়ার টেনে বসা হয়। আফজাল ও মিনার মাহমুদ ভদ্র মহিলাকে ম্যাডাম সম্বোধন করে কথা বলছলেন। তারা তিনজন গল্প করেন। নতুন আগন্তুক যুবককে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেন না। চুপচাপ বসে থেকে টেবিলের পত্রিকা পড়তে মন দিতে হয়। পরে জানা হয়ে এই ভদ্র মহিলাই বিচিন্তায় লগ্নি করেছেন। আর আগন্তুক যুবককে যে সেখানে নেওয়া হয়েছিল এটা ছিল তার ইন্টারভিউ। ভদ্র মহিলা তাকে দেখতে চেয়েছিলেন।
এক পর্যায়ে মিনার মাহমুদ সেখান থেকে ডেকে নিয়ে গেলেন খাবারের টেবিলে। সেখানে দুপুরের খাবার দিতে বলা হয়। খাবার শেষ মিনার মাহমুদ বললেন, বদরুল আপনার নিশ্চয় টাকার দরকার। এ চিঠিটা নিয়ে আবার দিলু রোডের বাসায় চলে যান। আপনার ভাবী আপনাকে দুশো টাকা দেবেন। আর হ্যাঁ কাল সকালে আবার চলে আসবেন। উল্লেখ্য মিনার মাহমুদ ততক্ষণে তার নতুন কর্মীকে ডাকনাম বদরুল ডাকতে শুরু করেছেন। তার পরামর্শে আবার যাওয়া হয় দিলু রোডে। সেখান থেকে পাওয়া দুশো টাকা পকেটে পড়তেই মনে হয় এটি ঢাকার প্রথম বেতনের টাকা অথবা শুভেচ্ছা! তৃপ্তির এক ঢেঁকুর তুলে ফিরে যাওয়া হয় বুয়েটের ডেরায়।
উল্লেখ্য, তখন থাকা হতো বুয়েটের এক ছাত্রের কক্ষে। পায়ে হেঁটে ভ্রমণের সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কক্সবাজারে। এরমাঝে নতুন চাকরির বেতন নিয়েও ফয়সালা হয়। জানতে চাওয়া হয় বদরুল আপনার ঢাকায় থাকতে মাসে কত টাকা হলে চলবে। যেহেতু বুয়েটের কক্ষে একজনের সঙ্গে থাকা-খাওয়া হয় তাই ঢাকার ঘরভাড়া সহ খরচাপাতি নিয়ে কোনও ধারণা নেই। বলা হয় পনেরশ টাকা হলে চলবে। সঙ্গে সঙ্গে বেতন ফাইনাল! সঙ্গে একটি শর্ত। বলা হয় আপনাকে মাসের এক তারিখে পাঁচশ, দশ তারিখে পাঁচশ, কুড়ি তারিখে পাঁচশ টাকা দেওয়া হবে। এভাবে ভেঙে ভেঙে দেওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয় টাকা একসঙ্গে দিলে আপনি খরচ করে ফেলবেন। তাতেই রাজি। ঢাকায় একটি কাজ পাওয়া গেছে। সবকিছুতে রাজি।
পরের সকালে আবার যাওয়া হয় দিলু রোডের বাসায়। এভাবে প্রতিদিন যাওয়া হয়, পত্রিকা পড়া, খাওয়াদাওয়া শেষে চলে আসা হয়। কাজটা কী তা আর জানা হয় না। মিনার মাহমুদ একদিন বলেন আপনি কি টাইপ জানেন বদরুল? তখনও ঢাকার মিডিয়ায় কম্পিউটার, মোবাইল ফোন কিছুই আসেনি। টাইপ মানে টাইপ রাইটারের টাইপ। টাইপ জানা নেই বলতেই কিছু টাকা দিয়ে বলা হয় কোনও একটা টাইপ স্কুলে ভর্তি হয়ে যান। মগবাজারের গলিতে এক টাইপ রাইটারের দোকান কাম স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়ে যাওয়াও হয়। দু'তিন পর মিনার মাহমুদ জানতে চাইলেন টাইপ শিখতে আপনার কেমন লাগছে বদরুল? বলা হয়, ভালো না। মিনার মাহমুদ বললেন তাহলে কাল থেকে আর যাবেন না। জানতে চাওয়া হয়, কেন? মিনার মাহমুদ বলেন, যখন যা ভালো লাগবে না তা আর করবেন না। তার অনুগত ছাত্রটিও আর টাইপ স্কুলে গেলেন না।

এরমাঝে এক সকালে দিলু রোডে যেতেই বলা হয় বদরুল, খুশির একটা খবর আছে। আমাদের পত্রিকার ডিক্লারেশন হয়ে গেছে। আমাদের আর নিউজ এজেন্সি করা লাগবে না। আমরা বিচিন্তাই করবো। একদল নতুন ছেলেমেয়ে চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আর পত্রিকায় তখনও দ্বিতীয় ব্যক্তির হাতে দেওয়া হয় দু'শ টাকা। বলা হয় লোকজন আসলে চা খাওয়াবেন। দিলু রোডের সেই বাসারই একটি কক্ষে দুটো টেবিল, কিছু চেয়ার নিয়ে কাজ শুরু হয় বিচিন্তার অফিসের। পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে নতুন ছেলেমেয়েরা আসতেন। যায়যায়দিন নিষিদ্ধ থাকায় বাজারে চরম একটি শূন্যতা। সারাদেশের এজেন্টরা প্রতিযোগিতামূলক অগ্রিমের টাকা সহ অফিসে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েন।

মিনার মাহমুদের পরে দ্বিতীয় ব্যক্তিটি তখন সেই অফিসের রিসেপশনিস্ট, সার্কুলেশন ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার সবকিছু। একেকদিন টাকায় ড্রয়ার ভর্তি হয়ে উপচে পড়তো। রাতে সেই অফিস কক্ষেই থাকা-লেখালেখি শুরু হয়। বিচিন্তার প্রথম সংখ্যাতেই ঢাকার মিডিয়ার আনকোরা নতুন সাংবাদিকের ১৭ টি রিপোর্ট ছাপা হয়। আর পত্রিকার শেষ পাতায় ছাপা হয় তার নতুন এই সাংবাদিকটি সম্পর্কে মিনার মাহমুদের লেখা একটি ভূমিকা বর্ণনা। যাতে লেখা হয় বিচিন্তার প্রতিসংখ্যায় তার বাংলাদেশ ভ্রমণ বৃত্তান্ত ছাপা হবে ‘প্রজন্মের পরিভ্রমণ’ শিরোনামে। প্রজন্ম শব্দটি সেই থেকে এতো আপনার। মিনার মাহমুদের বিচিন্তার মাধ্যমে সৃষ্ট প্রিয় প্রজন্ম সাংবাদিকরাই আজ ঢাকার মূলধারার নানা মিডিয়ার নেতৃত্বে। ঢাকার মিডিয়ায় নানানভাবে সৃষ্ট নতুন ধারার মধ্যে উজ্জ্বল বেঁচে আছেন মিনার মাহমুদ। বেঁচে থাকবেন। ১০ মার্চ ছিল তার জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন মিনার ভাই। ভালো থাকুন না ফেরার দেশে।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ